এক চুমুক চায়ের চুমুকে বঙ্গ জীবনের অঙ্গ ‘ল্যাদ’-এ ঝটকা লাগতে শুরু করল আর নিজেকে জাগ্রত রাখতে মাঝেমাঝেই চা-তেষ্টা পাওয়া শুরু হল। বাড়ির হেঁশেল বারবার চা সাপ্লাই করতে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চা গেরস্তের চার দেওয়াল পেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল, সেখানে গজিয়ে উঠল একের পর এক চায়ের দোকান। সেখানে শুধু চা নয়, বিভিন্ন রকম বিস্কুটও পাওয়া যায়, এক এক বিস্কুটের এক একরকম স্বাদ। আর তার সঙ্গে পাওয়া যায় কেক আর কোয়ার্টার পাউন্ড পাউরুটি চায়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্য।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
‘বাঙালি জাগো!’ বললে ‘জেগেছি, চা-টা দে!’ বলে যে উত্তরটা আসে, সেটা কিন্তু বেশি দিনের পুরনো উত্তর নয়। চায়ের সঙ্গে মধ্যবিত্ত বাঙালির সখ্য বেশ হালের– উনিশ শতক থেকেই শুরু হয়েছে। ব্রিটিশরা এই দেশে এসেছিল ব্যবসা করার আর মুনাফা লোটার লক্ষ্য নিয়ে, আর কোনও দিন সেই লক্ষ্য থেকে সাহেবদের নজর সরেনি। শাসনব্যবস্থা যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটেনের মহারানির হাতে গেল, তখনও মূল লক্ষ্য থেকেছে ব্যবসায় ফায়দা লোটা, বাকি সবকিছুই গৌণ। সাহেবরা মুনাফার ব্যাপারে ‘অধিকন্তু ন দোষায়’ পন্থাই মেনে এসেছে– একেবারে গাছেরও খাব, তলারও কুড়ব।
আফিমের চাষ করতে গিয়ে যখন দেখা গেল গাছের বীজ হিসাবে পাওয়া দানাগুলো অতি সুস্বাদু আর পূর্ব ভারতে যেখানে ভাত হচ্ছে মুখ্য খাদ্য, সেখানে ভাতের সঙ্গে এই পোস্ত গাছের বীজ একসঙ্গে খেলে একেবারে জমে কুলপি, তাই সেখান থেকেও যদি পয়সা আসে, ক্ষতি কোথায়! পোস্তর গপ্প এখানে ইতি দিয়ে চায়ের দিকে একটু চাওয়া যাক।
ইউরোপে চা ছিল অতি মহার্ঘ, খুব বড়লোক না হলে চায়ের আসরের কথা ছিল কল্পনার বাইরে! চিন থেকে আসা টং আ-চিউ ১৭৭৮ সালে কলকাতায় পৌঁছে তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে যখন বেশ কয়েক পেটি চায়ের বাক্স উপঢৌকন হিসেবে তুলে দিলেন, ধুরন্ধর হেস্টিংস বুঝে গিয়েছিলেন, জ্যাকপট পেয়ে গিয়েছেন!
উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দেখা গেল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমদানির ৯০ শতাংশ চা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোম্পানি চিনকে আফিম সাপ্লাই দিত আর বিনিময়ে চা নিত– চমৎকার এক বিনিময় ব্যবস্থা। কিন্তু চিরকাল সুখের দিন থাকে না। চিনের সম্রাটের ফরমানে আফিমের সাপ্লাই চেনটা আটকে গেল আর তার অর্থ– ব্রিটিশদের নগদ টাকা দিয়ে চা কিনতে হবে। সাহেবরা বের করে ফেললেন যে, দার্জিলিং আর অসম অঞ্চলের প্রকৃতিতে চায়ের চাষ ভালো হয়। তাই অপেক্ষা না-করে চায়ের চাষ শুরু হল আর অচিরেই কলকাতা চা নিলামের বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াল। ডালহৌসি অঞ্চলে আন্দ্রিউ ইউল, ডানকান, উইলিয়ামসন মেগর প্রমুখ চা বাগানের মালিক আর জে থমাস থেকে শুরু নিল্হাত হৌস, চারদিকে চায়ের নিলামের ডাক, চায়ের আমেজ চারদিকে। নিলামে প্রায় সব চা বিক্রি হয়ে গেলেও বাদ সাধল এই ‘প্রায়’ শব্দটা। খুচরো কিছু চা অবিক্রীত থেকে যায়– সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দিতে পারলে পুরোটাই লাভ। মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের কাছে ইতিমধ্যে চায়ের খবর পৌঁছে গিয়েছে– সাহেব মেমসাহেবদের ‘টি-পার্টি’ দেখে বাঙালি বাবুসাহেবরাও টি-পার্টি দিতে শুরু করেছেন। মধ্যবিত্ত বাঙালি জুলজুল করে সেসব দেখলেও চা সেবন ছিল শুধু জ্বরের ওষুধ হিসাবে সীমাবদ্ধ। সাহেবদের লিপটন বা ব্রুকবন্ড কোম্পানি থেকে আশুতোষ ঘোষের ‘এ. টস্’ সবাই হাত ধুয়ে বাঙালিকে চায়ের নেশায় চোবানোর প্রচেষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়ল বিনে পয়সায় চা খাইয়ে আর তার গুণগান গেয়ে। আর কে না জানে– বিনি পয়সার স্বাদই আলাদা!
চা এবার দিব্বি বাঙালি হেঁশেলে ঢুকে পড়ল। এমন এক পানীয়, যা খেলে নেশা হয় না, তাই দিব্যি বাড়ির গুরুজনদের সঙ্গে খাওয়া যায়। বাড়িতে অতিথি অভ্যাগত এলে যে বেলের পানা বা শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করার রীতি ছিল, তাতে ঝামেলা অনেক। সেই তুলনায় অতিথি এলে চা দিলে আভিজাত্যও আছে, ঝামেলাও কম। দুধে জল মিশিয়ে ফুটিয়ে চা পাতা আর চিনি ফেলে দাও, খানিক বাদে ছেঁকে নিয়ে পরিবেশন করে দাও। বাঙালির পিত্ত আর চিত্ত দুই-ই ভীষণ চঞ্চল– তাড়াহুড়ো করে বা অন্যমনস্ক হয়ে চায়ে চুমুক দিলে জিভ পুড়তে পারে। আর আমাদের চিরকালের বিশ্বাস খুব গরম কিছু খেলে পিত্ত প্রকোপ হয়। সাহেবরা চায়ের সঙ্গে এই কারণেই নিশ্চয়ই বিস্কুট খায়– এই বিশ্বাসে চায়ের সঙ্গে সঙ্গী করা হল বিস্কুটকে। কিন্তু সাহেবরা চায়ে ডুবিয়ে খায় নাকি ‘আমি তো এমনি এমনি খাই’ বলে কামড় দেয়, সেটা জানা নেই আর তাই নিয়ে হল এক বিভ্রাট। অনেক ভেবে-চিন্তে চায়ে অল্প ডুবিয়ে বিস্কুটে কামড় দিয়ে দেখা গেল বেশ চায়ের স্বাদ এসে যাচ্ছে বিস্কুটে আর নরম তুলতুলেও হচ্ছে, বেশ অন্যরকম এক স্বাদ হয়ে যাচ্ছে বিস্কুটের। শুরু হল চা-বিস্কুটের যুগলবন্দি। হারমোনিয়ামে চা আর সারেঙ্গীতে বিস্কুট। আর এর মধ্যে একটা স্মার্টনেসও আছে; বিস্কুট একটু বেশ ডোবালেই সে বিলীন হয় চায়ের সমুদ্রে আর আশপাশের লোকের দৃষ্টিতে ‘ক্যালানে’ শব্দটা ফুটে ওঠে।
মধ্য কলকাতায় বাঙালি গেরস্তর হেঁশেলের সামনে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রতিবেশীর জানালা, আর সেখান থেকে দেখা যায় চায়ের সঙ্গে শুধু বিস্কুট নয়, পাউরুটি আর কেকও আছে– গোরা আর কালা সাহেবরা অনেক সময় পাউরুটি বা কেকের সঙ্গেও চা খায় কি না! বড়ুয়া কোম্পানি বাঙালির চায়ের সঙ্গে কেক খাওয়ার ইচ্ছে মিটিয়ে দিল কম দামে গেরস্তের পছন্দের কেক বানিয়ে। আর সাতের দশকে এক ফিনফিনে কাগজে মোড়া বাপুজী কেক শহরতলিতেও পৌঁছে দিল চায়ের সঙ্গে খাওয়ার কেক।
এক চুমুক চায়ের চুমুকে বঙ্গ জীবনের অঙ্গ ‘ল্যাদ’-এ ঝটকা লাগতে শুরু করল আর নিজেকে জাগ্রত রাখতে মাঝেমাঝেই চা-তেষ্টা পাওয়া শুরু হল। বাড়ির হেঁশেল বারবার চা সাপ্লাই করতে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চা গেরস্তের চার দেওয়াল পেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল, সেখানে গজিয়ে উঠল একের পর এক চায়ের দোকান। সেখানে শুধু চা নয়, বিভিন্ন রকম বিস্কুটও পাওয়া যায়, এক এক বিস্কুটের এক একরকম স্বাদ। আর তার সঙ্গে পাওয়া যায় কেক আর কোয়ার্টার পাউন্ড পাউরুটি চায়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্য। চা তো আর বেলের পানা বা শরবত নয়, যে এক চুমুকেই শেষ! চা খেতে সময় লাগে, সিপ্ করে করে খেতে হয় যাতে জিভ না পুড়ে যায়– তাই চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা, রাজা-উজির মারা চলতে লাগল চায়ের গেলাসে প্রথম চুমুকে বিপ্লবের শুরু, শেষ চুমুকে বিপ্লব অস্তমিত। মাঝেমাঝে দ্বিতীয় চায়ের গেলাস এসে যায় যখন বিপ্লব দীর্ঘজীবী হয়, আর তার সঙ্গে লেরে বিস্কুট।
দোকানে চায়ের গেলাসে চুমুক কি শুধু এলাকার বাসিন্দারাই দেয়? তারা অনেক সময় শুধু চায়ে থেমে গেলেও কিছু মানুষ আছে যাদের দিন শুরু হয় এই দোকানগুলোয় চায়ের গেলাস হাতে নিয়ে। ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালাদের মতো শ্রমজীবী মানুষেরা দিন শুরু করে এই দোকানগুলোয় চায়ের গেলাসে পাউরুটি ডুবিয়ে। এই খেয়ে বেরিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ে দিন গুজরানের আশায়।
চা কি শুধু বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে? একেবারেই না– বরং ছড়িয়ে পড়েছে শহর জুড়ে, দেশ জুড়ে। পাউরুটি, কেক বা বিস্কুট, এই সব বেকারিতে হয়– আর বেকারিতে নাকি ডিম দেওয়া হয় এগুলো বানানোর সময়। পশ্চিম ভারতের মানুষ তাই এগুলো সন্তর্পণে এড়িয়ে চায়ের সঙ্গে এক নতুন এক্কাগাড়ি জুতে দিল– চানাচুর। দেশের ওই প্রান্তে মানুষ পরোটার সঙ্গেও চানাচুর খায়, এখানে তো আপাত মিষ্টি চায়ের সঙ্গে ঝাল চানাচুরের স্বাদ-বৈচিত্রে একেবারে কুদরত রংবেরঙ্গি! এর সঙ্গে যোগ দিল সামোসা– এমনই সেই শাহী যোগ যে বাঙালি শিঙাড়া প্রায় হারিয়ে যেতে বসল। লোকাল ট্রেনে ভাঁড়ের চায়ের সঙ্গে আজও দৈবাৎ যখন সেই বাঙালি শিঙাড়া দেখা হয়ে যায়, তখন ট্রেনের কামরা সোনার কেল্লা হয়ে যায় আর যাত্রীরা মুকুল হয়ে ওঠে।
পুনশ্চ: (কিছুটা ব্যক্তিগত) অনেক তো হল চায়ের সঙ্গতকারীদের কথা– কখনও বিস্কুট, কখনও চানাচুর, কেক, সামোসা। কিন্তু আমার সেরা সঙ্গতকারী নিঃশব্দে তার কাজ করে যায় বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। শীতের সকালে কড়াইশুঁটিকে সঙ্গী করে, বর্ষায় তেলেভাজাকে সঙ্গী করে, আর সারা বছর ধরে বিভিন্ন রূপে, কখনও নিরাভরণ হয়ে আবার কখনও সামান্য তেল মেখে লঙ্কা আর কাঁচা পিঁয়াজকে সঙ্গী করে। হ্যাঁ, আমি মুড়ির কথাই বলছি। এক খাবলা মুড়ি মুখে পুরে এক চুমুক চা। র্যাপারটা একটু ভালোভাবে জড়িয়ে।
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?
…………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………..