কোয়ারান্টাইনের নিয়মকানুন ক্রমশ আমাদের চেনা এক ডিসটোপিক পৃথিবীর ঝলক দেখায়। ’২০ সালের বিষাক্ত অতিমারীকালের সেই লকডাউনের স্মৃতি ফেরায়। স্পেকুলেটিভ ফিকশনের এখানেই ক্ষমতা, সে বারবার ফিরিয়ে আনে মানুষের মানবী ভ্রান্তি, অন্যায়, ত্রুটিযুক্ত সিদ্ধান্তের কুফলের কথা, ভবিষ্যতকে একটা পর্দা বানিয়ে তার ওপর বড় করে আরও ভয়াবহ করে প্রজেকশন করে বর্তমানের কিছু প্রবণতার।
১৫.
সারা বেয়ার এলিজাবেথ উইশনেভস্কির জন্ম সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে। মার্কিন এই লেখকের কলমি নাম হল এলিজাবেথ বেয়ার। স্পেকুলেটিভ ফিকশনের স্থানটিকে তিনি পাকা করে নিয়েছেন বহুদিন। ২০০৫ সালে ‘জন ক্যাম্পবেল অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট নিউ রাইটার’ পান, আর ২০০৮ সালে পান ‘হুগো’ পুরস্কার। এ যাবৎ এ পুরস্কারই হল কল্পবিজ্ঞান বা স্পেকুলেটিভ রচনার শ্রেষ্ঠ শিরোপা। যে গল্পটির জন্য এ পুরস্কার পেলেন, তার নাম ‘টাইডলাইন’। এক আশ্চর্য কাব্যময় ডিসটোপিয়াতে এই কাহিনি চোবানো আছে নষ্ট হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতিদের সমাজের নিঃসঙ্গতার বোধে। প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতা যেদিন ক্ষয়িত, অবসন্ন আর অন্তিমদশায়।
প্রকৃতির কাছে ফিরে আসার কথা তো সেই মেরি শেলির থেকেই বারবার স্পেকুফিকের আওতায় আসছে।
এলিজাবেথ বেয়ারে এই গল্প এসে দাঁড়ায় এক সমুদ্রতীরে।
গল্প শুরু হয় এইভাবে–
ক্যালসিডনির কান্নাকাটি আসে না। ওই ব্যাপারটাই তার মধ্যে নেই, অবশ্য এক যদি না এই পাগলা গরমের জন্য তার শরীরে গলে গিয়ে আবার জমে যাওয়া কাচের পলকাটা ডিজাইনকে অশ্রু বলে ধরা হয়।
ওগুলো সত্যিকারের কান্নার ফোঁটার মতো তার গা বেয়ে, তার জ্বলে যাওয়া সেন্সর বেয়ে নিঃশব্দে ঝরে পড়তে পারে না, পারে কি? অবশ্য ঝরে পড়লে সে-ই আবার মুঠো করে কুড়িয়ে নিত, নিয়ে তার তোবড়ানো খোলসকে বেঁধে রাখা দড়িটায় গেঁথে রেখে দিত। ওর কুড়োনো টুকরোটাকরা সুন্দর জিনিসগুলো সেভাবেই থাকে।
ঝড়তিপড়তি যন্ত্রপাতি উদ্ধার করে নতুন করে ব্যবহার করার মতো কেউ আর বেঁচে থাকলে, এদ্দিনে ওকে সেটা করে ফেলত। কিন্তু ক্যালসিডনি হল আধুনিক যুদ্ধ-যন্ত্রগুলোর শেষতম। একটা তিনপেয়ে, অশ্রুবিন্দুর আকারের, ট্যাঙ্কের মতো বিশাল যন্ত্র– তার সামনে দুটো দাঁড়া আর ছুঁচলো মুখটার নিচে একটা জটিল কাজ করার উপযুক্ত আঁকশি; শরীরের উপরের জালিকাকৃতি ডিজাইনের পলিসেরামিক বর্ম। রিমোট দিয়ে চালানোর মতো কেউ বেঁচে না থাকায়, সে একাই একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া পা টেনে টেনে সমুদ্রতীরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
সেখানেই বেলভেডারের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল।
এই অপূর্ব গল্পটির এর পরের যাত্রাপথ– বেলভেডার নামে সেই অনাথ ছেলেটির সঙ্গে এই যুদ্ধযন্ত্রটির বন্ধুত্ব নিয়ে অনেকদূর হেঁটে যাওয়া।
‘ক্যালসিডনি প্রথম প্রথম জাল ছুঁড়ে পাখি ধরে এনে মাইক্রোওয়েভে রোস্ট করে দিত, তারপর আস্তে আস্তে ওকে শেখাল কী করে আগুন জ্বালাতে হয়, ধুনি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। ওর ডাটাবেসের হাল খারাপ হয়ে এসেছিল, তবু হাতড়ে হাতড়ে বাড়ন্ত বাচ্চার স্বাস্থ্য কীভাবে ভালো রাখা যায় বার করতে লাগল ও। কী তাড়াতাড়ি বাড়ছে ছেলেটা, প্রায় চোখের সামনেই প্রতিদিন আরেকটু লম্বা হয়ে যাচ্ছে যেন! সমুদ্রে যেটুকু যা পুষ্টিকর লতাপাতা পাওয়া যায়, সেসব বেলভেডারকে খেতে শেখাল ও। সে-ও অবশ্য প্রতিদান দিত, যা যা টুকরোটাকরা সহজে কুড়োনো যেত না সেগুলো তুলে আনত ওর জন্য। কিছু কিছু অমন চকচকে টুকরোর মধ্যে ক্যালসিডনির ডিটেক্টর রেডিয়েশন ধরতে পারত। তাতে ওর নিজের কিছু হয় না, কিন্তু এখন সেগুলো ও ফেলে দিত। একটা মানুষ সঙ্গী আছে যখন, তখন তাকে সুস্থ রাখাটাই উচিত।’
সে মানুষসঙ্গীকে নিয়ে একটি কুকুরছানাকে বাঁচিয়ে তোলে, গাঁথে মালা… স্মৃতির মালা। মানুষের শেষ হয়ে যাওয়া সভ্যতার ইতিহাসই সেই স্মৃতি। যাকে মালার ভেতরে গেঁথে তোলে তারা দু’জনে। আর তারপর,
‘এদের মালিক খুঁজে বার করো।’
‘তারা তো সবাই মরে গেছে!’
‘যোদ্ধারা মরে গেছে, কিন্তু তাদের গল্প ফুরিয়ে যায়নি! তুমি কুকুরছানাটাকে বাঁচাতে চেয়েছিলে কেন?’
বেলভেডার ঠোঁট চাটল, প্যাটারসনের মালাটা আরেকবার ছুঁল, ‘কারণ… তুমি আমায় বাঁচিয়েছিলে। আর এইসব গল্প বলেছিলে। ভালো যোদ্ধা, খারাপ যোদ্ধা– শিখিয়েছিলে।’
যুদ্ধের আবহ না রেখেও গ্যালান্ট্রি বা বীরত্বের নতুন এক অর্থে উপনীত হয়েছেন বেয়ার। পরাজয়ের কথা নয়, জয়ের কথাই বলেছেন। কিন্তু সেই জয় মানুষ খুন করে পায় না কেউ, বরং বাঁচিয়ে তুলে, সেবা যত্ন করে, মনোযোগ দিয়ে পায়। নারীবাদী প্রকল্প খুঁজতে চাইলে যে কেউ খুঁজতেই পারি আমরা এই বিশেষ দিকটায়।
গল্পের শেষটি ফাঁস না করেই বলা যায়, এক মেদুর অনুভূতিময় কাহিনি বুনেছেন এলিজাবেথ। এবং অনুবাদটি যাঁর , সেই অনুষ্টুপ শেঠের কলমে লেখাটির বাংলা ভার্সান হয়ে উঠেছে চমৎকার। বেয়ারের বেশ কিছু গল্পের একটা গোটা সংকলন আমাদের হাতে আসে অনষ্টুপের স্বচ্ছল সাবলীল অনুবাদে। এলিজাবেথের বিষয় ভাবনাগুলি একটু দেখা যাক।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যুদ্ধের আবহ না রেখেও গ্যালান্ট্রি বা বীরত্বের নতুন এক অর্থে উপনীত হয়েছেন বেয়ার। পরাজয়ের কথা নয়, জয়ের কথাই বলেছেন। কিন্তু সেই জয় মানুষ খুন করে পায় না কেউ, বরং বাঁচিয়ে তুলে, সেবা যত্ন করে, মনোযোগ দিয়ে পায়। নারীবাদী প্রকল্প খুঁজতে চাইলে যে কেউ খুঁজতেই পারি আমরা এই বিশেষ দিকটায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
একটি গল্পে আছে এক স্বয়ংক্রিয় বাড়ির কথা। সে যেন আজকের জমানায় পুনর্লিখিত হল, রে ব্রাডবেরির সময়ের, অর্থাৎ পাঁচের দশকের সেই বিখ্যাত বাড়িটির কথা… যে বাড়ি কথা বলে, গান শোনায়। রে ব্রাডবেরি দেখিয়েছিলেন আণবিক যুদ্ধের পরবর্তীতে মানুষহীন বাড়িটির একলা একলা মরে যাবার গল্প। সেখানেও আজকের রোবটসভ্যতার এআই অ্যাসিস্টেন্ট-এর মতো এক প্রায়জীবন্ত কথাবলা বাড়ি আদেশ দিলেই খাবার বেড়ে দেয় বা পছন্দের কবিতা শোনায়।
হালের এই গল্পে এলিজাবেথ দেখান, চার্লি চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমসের আদলে, বাড়িটি ক্রমশ গ্লিচ বা ত্রুটিতে ভরে যাচ্ছে। ক্রমশ সে তার বাসিন্দাকে বন্দি করে ফেলছে যেভাবে ঝিনুক তার দুটি খোল বন্ধ করে ফেলে… তাকে নানা অজুহাত, আইনকানুন, স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওরের দোহাই দিয়ে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, কারও-র সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয় না… বন্ধ দরজা দিয়ে বের হতে দেয় না। কোয়ারান্টাইনের নিয়মকানুন ক্রমশ আমাদের চেনা এক ডিসটোপিক পৃথিবীর ঝলক দেখায়। ’২০ সালের বিষাক্ত অতিমারীকালের সেই লকডাউনের স্মৃতি ফেরায়। স্পেকুলেটিভ ফিকশনের এখানেই ক্ষমতা, সে বারবার ফিরিয়ে আনে মানুষের মানবী ভ্রান্তি, অন্যায়, ত্রুটিযুক্ত সিদ্ধান্তের কুফলের কথা, ভবিষ্যতকে একটা পর্দা বানিয়ে তার ওপর বড় করে আরও ভয়াবহ করে প্রজেকশন করে বর্তমানের কিছু প্রবণতার।
তাই, আমাদের দৈনন্দিনে ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছে যে ‘হাই আলেক্সা’ বা ‘ওকে সিরি’-রা, তাদেরই এক্সটেনশন বা অগ্রগতি আমরা দেখি ‘ওকে গ্লোরি’ গল্পে।
“আমি চাদর টাদর ছুড়ে ফেলে আমার মোবাইলটা খুঁজে তুলে নিলাম। এখনও সিগনাল নেই। অবিশ্বাস্য, কারণ দেওয়াল জোড়া কাচের জানলা দিয়ে সেলফোন টাওয়ারটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম– অতিরিক্ত সিমেট্রিকাল একটা খাড়া পাইন গাছের মতো কামোফ্লাজ করা, ভোরের নীল আকাশের আলো আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে।
দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। হতচ্ছাড়া ফোন কিছুতেই সিগন্যাল নিচ্ছিল না।
‘অলরাইট, গ্লোরি। নির্দেশ ৭২-টা কী?’
‘নির্দেশ ৭২, প্যারাগ্রাফ সি, সাবপ্যারাগ্রাফ ৬, সেকশন ১-১৭– অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, নাশকতা ও অন্যান্য বিপদের সময়ে এই বাড়ির বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ও ভালো থাকার ব্যবস্থা। এমন কিছু ইমার্জেন্সি যদি ঘটে, যাতে মিস্টার কোফম্যানের জীবন ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, তাহলে সফটওয়্যার মানুষের কম্যান্ড অগ্রাহ্য করে নিজের লজিক অনুযায়ী বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যাতে সবচেয়ে বেশি সেইভাবে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুকাবিলা করবে।’ ”
এইবার গল্পটি বাঁক নেয় এক অপরাধমূলক রহস্য গল্পের দিকে, একটি মুক্তিপণের দাবি ও কোন অজানা হ্যাকার গ্রুপের কবলে পড়েছে গ্লোরির সেন্ট্রাল সিস্টেম, এ কথা বোঝার পাশাপাশি নায়ক এ বাড়ির কবল থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে, তা নিয়ে টেনশনের সৃষ্টি হয়। সাসপেন্সের তুঙ্গে তুলে দেয় পাঠককে। ক্রমশ জালের মতো ঘিরে আসছে গ্লোরি বাড়িটি।
‘এককথায় বলতে গেলে, ওরা কিছু ভুল বলেনি। একটাও বাইরের দরজা খোলা গেল না। টিভি চলছিল। ইন্টারনেট… শুনুন, আমি একগুচ্ছের টাকা দিই প্রতিমাসে যাতে এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরেও বিদ্যুতের গতিতে কনেকশন পাই, আর শুধুমাত্র আমার জন্যই একটা আলাদা করে তার লাগানো আছে এই পাহাড়ে।’ কিন্তু সে বাড়ির ইন্টারনেট একমুখী। কোনও ইমেল বা মেসেজ বাইরে পাঠাতে পারে না কোফম্যান।
‘বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করার পর বুঝলাম, ওরা গ্লোরিকে কিছু নির্দেশ পাঠিয়েছে, যার ফলে গ্লোরি সমস্ত এখান থেকে বেরোনো মেসেজ, ডাটা চেক করছে। ফরমায়েসী ডিপ-লার্নড সেন্সরশিপ।
মাইরি!’
গভীর সেনসরশিপের এই তটস্থ করা কাহিনিটির পরিসমাপ্তিও আমরা আজ জানাব না। সেজন্যে এলিজাবেথ বেয়ারের বইটি পড়ে নেওয়া জরুরি।
(চলবে)
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৪। শরীরের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দৌড়তে থাকে যারা
পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই