নয়াদিল্লির উপকণ্ঠে দ্বারকার ২১ বছরের ছেলে উদিত ব্যানার্জি। প্রবাসী বাঙালি। মা শুভা ব্যানার্জি রাষ্ট্রপতি ভবনের আধিকারিক। বাবা অভিজিৎ ব্যানার্জি চাকরি করেন দিল্লি এয়ারপোর্টে। সেই অভিজিৎ-শুভার ছেলে উদিত এবার প্যারিস অলিম্পিক্সে। একমাত্র বাঙালি হিসেবে। তবে প্রতিযোগী রূপে নয়, প্যারিস অলিম্পিক্সে উদিত যোগ দিয়েছেন অ্যান্টি ডোপিং এজেন্সির ভলেন্টিয়ার হিসেবে। আর সেই সুবাদে এক স্বপ্নের দুনিয়ার সিংহদুয়ার খুলে গিয়েছে তাঁর সামনে। চোখের সামনে দেখছেন নীরজ চোপড়া, রাফায়েন নাদালদের। তাঁদের খোশগল্প, হাসিঠাট্টায় গমগমে গেমস ভিলেজ দেখে উদিতের মনে হচ্ছে, যেন গোটা স্পোর্টস ওয়ার্ল্ডটাই একটা বৃহৎ পরিবার। আর সেই পরিবারের সদস্য সে নিজেও। ব্যস্তময় প্রতিদিনের ফাঁকে উদিতের মন ভরছে অজস্র সুখস্মৃতিতে। কাজের ফাঁকেই সেই অনন্য অভিজ্ঞতা তিনি ভাগ করে নিলেন রোববার.ইন-এর পাঠকদের সঙ্গে।
‘খুশির সপ্তম স্বর্গ’ বলে একটা কথা আছে। বাবা-মার মুখে অনেকবার শুনেছি। আগে মানেটা ঠিক না বুঝলেও, এখন বুঝি। যখন অফুরান আনন্দে বাস্তব আর স্বপ্নের মধ্যে ফারাক মুছে যায়, তখনই মনে হয়, খুশির সপ্তম স্বর্গে রয়েছি। ঠিক এই মুহূর্তে আমারও সেইরকম ফিলিং!অলিম্পিকের মতো এত বড় একটা ইভেন্ট, যাকে কি না বলা হয় ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’, সেই ইভেন্টের আমি শরিক হব, এমনটা কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। শুধু স্বপ্ন কেন, এক বছর আগেও যদি আমায় কেউ বলত, আমি প্যারিস অলিম্পিক্সে যাব, হেসে উড়িয়ে দিতাম। অথচ সেই অকল্পনীয় ব্যাপারটাই আমার সঙ্গে ঘটেছে। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি।
অলিম্পিকের মতো ইভেন্টে ওয়াডার অ্যান্টি ডোপিং টিমের ভলেন্টিয়ার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান তো বটেই। পাশাপাশি অনেক গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে। ভারতের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আমি গেমসের সঙ্গে যুক্ত, এটা যেমন গর্বের, তেমনই সম্মানের ব্যাপার। দেশের সম্মানটা যাতে রাখতে পারি, অলিম্পিকের শেষ দিন পর্যন্ত সেই চেষ্টা করে যাব। প্যারিসে আসার পর থেকে স্বপ্নের মতোই দিনগুলো কাটছে। গেমস ভিলেজে আমাদের অর্থাৎ ভলেন্টিয়ারদের নানা কাজ, নানা দায়িত্ব। আমি মূলত ওয়াডা (WADA) ও আইটি-র (International Testing Agency) সঙ্গে যুক্ত। ফলে প্রতিদিনই আমাকে গেমস ভিলেজে যেতে হয়। আর সেই সূত্রে চোখের সামনে দেখতে পারছি নিজের স্বপ্নের তারকাদের। কখনও ছুটে যেতে হচ্ছে পিভি সিন্ধুর কাছে। কখনও আবার ফ্রান্সের সোনাজয়ী সাঁতারু লিও মারশঁ-র রুমে। এমনই এক ব্যস্তময় দিনে খেয়াল করলাম ভিলেজের ভিতর পার্কে বসে আছেন স্বয়ং জিনেদিন জিদান। হ্যাঁ, ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী তারকা। মুহূর্তের জন্য আমার পা-দুটো নিশ্চল হয়ে গিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি ফুটবলের অন্ধভক্ত। রিয়াল মাদ্রিদকে সাপোর্ট করি। জিদান রিয়াল-লেজেন্ড। কোচ হিসেবে রিয়ালকে তিন-তিনটে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দিয়েছেন। তাঁকে চোখের সামনে দেখব ভাবিনি কখনও। নিজের অজান্তেই ‘জিদান’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলাম। হতচকিত হয়ে জিদানও আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। তারপর মুখে একগাল হাসি। এরপর একটা সেলফি না তুলে পারি বলুন তো! ছবিটা আজীবন আমার সঙ্গে থাকবে। একই গেমস ভিলেজে দূর থেকে হেঁটে যেতে দেখেছি রাফায়েল নাদালকে। আমেরিকার বাস্কেটবল টিম থেকে ভারতীয় হকি দল– সবাইকে চোখে পড়ছে কখনও না কখনও। মনে হচ্ছে, গোটা স্পোর্টস-ওয়ার্ল্ডটাই একটা পরিবার। সবাই কী সুন্দর মিলেমিশে আছে, গল্পগুজব করছে। আমিও যেন সেই পরিবারের কেউ একটা।
এর মধ্যেই দারুণ একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। কাজের সূত্রে এক অ্যাথলিটের রুমে যেতে গিয়ে অন্য একটা রুমে নক করে ফেলেছিলাম। দরজা খুলতেই দেখলাম এক ভারতীয়। জানালেন, এটা নীরজ চোপড়ার রুম। শুনলাম, রেস্ট নিচ্ছেন। সেই ভদ্রলোক যদিও আমাকে বলেছিলেন, সেলফি তুলতে চাইলে বলতে পারেন নীরজকে। আমি ডিস্টার্ব করতে চাইনি। জানি, গোটা ভারত নীরজের সোনা জয়ের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। আমিও। ঈশ্বরের কাছে এখন একটাই প্রার্থনা, চোখের সামনে নীরজ চোপড়াকে সোনা জিততে দেখতে চাই। তারপর ‘সোনার ছেলে’র সঙ্গে নিশ্চয়ই সেলফি তুলব।
………………………………………………………………
প্যারিসে আসার পর থেকে স্বপ্নের মতোই দিনগুলো কাটছে। গেমস ভিলেজে আমাদের অর্থাৎ ভলিন্টিয়ারদের নানা কাজ, নানা দায়িত্ব। আমি মূলত ওয়াডা (WADA) ও আইটি-র (International Testing Agency) সঙ্গে যুক্ত। ফলে প্রতিদিনই আমাকে গেমস ভিলেজে যেতে হয়। আর সেই সূত্রে চোখের সামনে দেখতে পারছি নিজের স্বপ্নের তারকাদের। কখনও ছুটে যেতে হচ্ছে পিভি সিন্ধুর কাছে। কখনও আবার ফ্রান্সের সোনাজয়ী সাঁতারু লিও মারশঁ-র রুমে। এমনই এক ব্যস্তময় দিনে খেয়াল করলাম ভিলেজের ভিতর পার্কে বসে আছেন স্বয়ং জিনেদিন জিদান।
………………………………………………………………
দেখুন কথায় কথায় আমার কাজের ব্যাপারেই কিছু বলা হল না। আগেই বলেছি, আমি ওয়াডা এবং আইটি সঙ্গে যুক্ত। অ্যান্টি ডোপিং ভলেন্টিয়ার হিসেবে প্যারিস অলিম্পিক্সে আমি কাজ করছি। অলিম্পিকের মতো ইভেন্টকে ডোপিংমুক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর ওয়াডা। অতীতে ডোপিংয়ের কালো ছায়া পড়তে দেখা গিয়েছে অলিম্পিকের আসরে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না হয়, স্পোর্টসে সমস্ত অ্যাথলিট যাতে সমান সুবিধা পায়, সেটা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর ওয়াডা। এর জন্য র্যানডম টেস্টের মধ্যে দিয়ে অ্যাথলিটদের যেতে হয়। এমনকী, সেটা অলিম্পিকের মধ্যেও। লক্ষ্য একটাই, অলিম্পিক্সকে ডোপমুক্ত রাখা। আর সেটা নিশ্চিত করতে অ্যাথলিটদের নিয়মিত ব্লাড, ইউরিন টেস্ট হয়। আমাদের অর্থাৎ অ্যান্টি ডোপিং ভলেন্টিয়ারদের দায়িত্ব অ্যাথলিটদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। তাঁদের ইনফর্ম করা, কবে, কখন তাঁদের টেস্ট হবে। এজেন্সির তরফ থেকে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়, যে সকল অ্যাথলিটকে নমুনা সংগ্রহ করা হবে, তাঁদের গেমস ভিলেজে গিয়ে ইনফর্ম করতে। আমরা সেই মতো তাঁদের খবর পৌঁছে দিই। আবার অনেক সময় অ্যাথলিটদের সঙ্গে করে নমুনা সংগ্রাহকের রুমে নিয়েও আসি।
সমস্যা একটাই। সেটা হল ভাষার আদানপ্রদানে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অ্যাথলিটরা এসেছেন। এই ভিলেজে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত তাঁরা রয়েছেন। সবাই ইংরেজি জানেন না। ফলে কমিউনিকেট করতে সমস্যা হয় বইকি। সেটা অনেকটাই কেটে যায় অ্যাথলিটের সঙ্গে দোভাষী থাকলে। তবে ভারতীয় অ্যাথলিটদের সঙ্গে সে-সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি। কাজ করাটাও তাই উপভোগের। যাদের টিমমেট হিসেবে পেয়েছি তারাও খুব সাহায্য করছে, সিনিয়র-জুনিয়র সবাই মিলে। কেউ বেলজিয়াম থেকে এসেছে, কেউ আবার কোরিয়ার। অল্প কয়েক দিনেই সকলের সঙ্গে দারুণ বন্ডিং তৈরি হয়ে গিয়েছে। শুরুর দিকে যে জড়তা কিংবা ভয় কাজ করত যে, আমি পারব কি না, সেটা একদম কেটে গিয়েছে। অলিম্পিক শেষ হলে আমরা আবার যে যার মতো ফিরে যাব দেশে, একসঙ্গে কাজ করা হবে না, ভাবলেই এখন কষ্ট লাগছে। আসলে প্যারিস অলিম্পিক্সকে এভাবে চোখের সামনে চাক্ষুষ করব, তা স্বপ্নেও যে ভাবিনি। সুযোগটা আচমকাই চলে এসেছিল।
…………………………………………………………………….
আরও পড়ুন রোদ্দুর মিত্র-র লেখা: পদক না পেলে দর্শকই বলত, অলিম্পিক্স কি চ্যাংড়ামির জায়গা?
…………………………………………………………………….
দিল্লির দ্বারকায় আমার বেড়ে ওঠা। ওখানকার মাউন্ট কারমেল স্কুলে পড়াশোনা করেছি। তারপর স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কোর্স। ইচ্ছে ছিল স্পোর্টসম্যান হব। ফুটবল ভালোবাসতাম। ক্রিকেটও ভালো খেলতাম। যদিও একটা সময় পর বুঝতে পারলাম, পেশাদার ফুটবলার কিংবা ক্রিকেটার হতে গেলে যে এবিলিটি, যে-ডেডিকেশন লাগে, সেটা আমার মধ্যে নেই। গেমস ভিলেজে অ্যাথলিটদের দেখে সেটা আরও বুঝতে পারছি। জেতার খিদে কোন পর্যায়ে থাকলে তবেই অলিম্পিকে অংশ নেওয়া যায়, সেটা বিশ্বের এই তাবড় তাবড় অ্যাথলিটকে না দেখলে বিশ্বাস হত না। পদক যাঁরা পাচ্ছেন, যাঁরা পাবেন, তাঁদের কুর্নিশ জানাতেই হয়। আর যাঁরা পেলেন না, তাঁদের হার্ডওয়ার্কটাও ফেলনা নয়। সেটাও ভীষণ রকম শিক্ষণীয় একটা ব্যাপার।
এই সব টুকরো-টুকরো স্মৃতি এখন আমার সঙ্গী। গেমস ভিলেজে পা রাখা মানেই যেন একটার পর এক বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে। মাঝে মাঝে গায়ে চিমটি কেটে দেখতে হচ্ছে করে, এসব স্বপ্ন নয় তো। হোক স্বপ্ন, আমি এই স্বপ্নের দুনিয়াকে আঁকড়েই বাঁচতে চাই।
…………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………