কেমন করে জন্ম নেয় ছবি? এই প্রশ্নের উত্তরে অশীতিপর শিল্পী যোগেন চৌধুরী পরিষ্কার জানিয়েছেন, ‘কী আঁকব– ছবি আঁকতে বসে আমার হাত কোনদিকে যাবে, কীভাবে ঘুরবে, আমি জানি না।’ এই অনিশ্চয়তা হয়তো একজন প্রকৃত শিল্পীর অর্জন। যা প্রতিনিয়ত নতুন শিল্পের প্রেরণা জুগিয়ে চলতে থাকে।
‘আমার রেখা মাটি কামড়ে কামড়ে এগোতে থাকে। এরকম আর্থলি ফিলিং আমার চলে আসে। মাটির অনুভব।’ তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। কিন্তু তাঁর বুকের ভিতরে জেগে রয়েছে এমনই অনুভূতি। শৈশবে বাংলাদেশের ফরিদপুরে প্রকৃতির অপার সান্নিধ্যলাভের স্মৃতি দেশভাগের পরও তাঁর সত্তায় বুনে দিয়েছে মাটির স্পর্শ। এভাবেই গড়ে উঠেছে যোগেন চৌধুরীর অন্তর্জগৎ। দেশ-কালের প্রভাব ও ব্যক্তিগত যাপনের ছায়ায় কীভাবে তৈরি হয়ে ওঠেন একজন শিল্পী? দেবভাষা থেকে প্রকাশিত ‘সাক্ষাৎকার যোগেন চৌধুরী’ নামের বইটি আমাদের সেইসব প্রশ্নেরই উত্তর দিতে চেষ্টা করে।
যোগেন চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার এই গ্রন্থের উপজীব্য। ১৬০ পাতার বইজুড়ে প্রশ্নোত্তরের আকারে সাজানো শিল্পীর মনের কথা, যা শুরু হয় একেবারে ফরিদপুর থেকে। পূর্ববঙ্গের গ্রামে কুমোরদের মাটির মূর্তি গড়া দেখে নিজেও মূর্তি তৈরি করতে শুরু করেন শিল্পী। পাশাপাশি চণ্ডীমণ্ডপের পাশে থিয়েটার, রাসযাত্রা, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প বা পুরাণের কাহিনি থেকে নির্মিত যাত্রা, মেলার রঙিন চরিত্র, বহুরূপী সমৃদ্ধ করতে থাকে তাঁর দৃশ্যজগৎকে। তিনি বলছেন, ‘ফরিদপুর মাঝে মাঝেই আমার ভিতরে হানা দিয়ে যায়। ছবিগুলো জ্যান্ত হয়ে আছে।’ আরেক জায়গায় শিল্পীকে বলতে দেখা যায়, ‘সম্ভবত, ওখানে না থাকলে কোনও ভাবেই শিল্পকে এত নিবিড় ভাবে দেখার অভ্যেস আমার তৈরি হত না।’ এই দেখা যে আজও অব্যাহত, সেকথাও মনে করিয়ে দেন তিনি, ‘পিঁপড়ে কীভাবে হেঁটে যাচ্ছে কিংবা গাছের পাতার উপর চকমকিয়ে গেল একটা রঙিন পোকা– আজও দেখি। সেই সবকিছু দেখার প্রবণতা– এখনও সমানে রয়ে গেছে।’
ফরিদপুরে তাঁদের ছিল জমিদারি। অথচ দেশভাগের কারণে ৮-৯ বছর বয়সে কলকাতায় চলে আসার পর মুখোমুখি হতে হয়েছিল চরম দারিদ্রের। বারবার বাড়ি বদল, অর্থকষ্টের মধ্যেই নাগরিক জীবনের নতুনত্বও তাঁর ভিতরে জমা হতে লাগল। পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথের ‘শাহজাহানের মৃত্যুশয্যায়’, পিকাসোর ‘শ্বেতকপোত’ দেখে মগ্ন হওয়া। কাগজ বা পত্রিকা থেকে সেইসব ছবি কেটে খাতায় জমানো। যে খাতা আজও তিনি হারাননি। এরপর শুরু হয় ছবি আঁকা। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকার অলংকরণ কিংবা দেওয়ালে লাল-নীল পেনসিলে ময়ূর আঁকার মধ্য দিয়ে যে যাত্রা শুরু, তা আজও বিদ্যমান।
কেমন করে জন্ম নেয় ছবি? এই প্রশ্নের উত্তরে অশীতিপর শিল্পী পরিষ্কার জানিয়েছেন, ‘কী আঁকব– ছবি আঁকতে বসে আমার হাত কোনদিকে যাবে, কীভাবে ঘুরবে, আমি জানি না।’ এই অনিশ্চয়তা হয়তো একজন প্রকৃত শিল্পীর অর্জন। যা প্রতিনিয়ত নতুন শিল্পের প্রেরণা জুগিয়ে চলতে থাকে। যদিও এই অর্জনের জন্য জীবনে অনেক মূল্য চোকাতে হয়। যোগেন চৌধুরীর হয়ে ওঠা সেই পথেই। আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নিউজ প্রিন্টের উপর ড্রইং করতে বাধ্য হয়েছেন। শিল্পীর কথায়, ‘কলেজের সময় ক্যানভাসে আমি খুব কমই কাজ করেছি। আমার পরিবারের যে অর্থনৈতিক কাঠামো, সেখানে পছন্দমতো রং, তুলি, কাগজ কিংবা ক্যানভাস কেনার মতো অবস্থা ছিল না।’ কিন্তু এত সবের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস এতটুকু কমেনি তাঁর। নিজেই জানাচ্ছেন, ‘প্রথম থেকেই আমি নিখুঁত ভাবে ছবি আঁকতে পারতাম। এই পর্যায়ে পৌঁছোতে অনেকেরই প্রথম দিকে অসুবিধে হত।’
আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে ‘আলিয়স ফ্রাঁসে’-তে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পাঠক্রম সম্পূর্ণ না করেই ঢুকে পড়তে হয়েছিল স্কুল শিক্ষকের কাজে। পরে ১৯৬৩ সালে অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ডে চাকরি। কিন্তু সেই সরকারি চাকরিও ছেড়ে দেন প্যারিসে ‘এক্কল ন্যাশনেল সুপেরিয়ে দ্য ব্যোজ আরত্’-এ ছাত্র হিসেবে ভর্তি হওয়ার স্কলারশিপ পেয়ে। নিজেই বলছেন, ‘আমি যে বেতন পাচ্ছি, তা ছেড়ে ওই ভাবে চলে যাওয়া খুব একটা সহজ কথা নয়।’ যদিও পরক্ষণেই জানাচ্ছেন, ‘যেটা আমার ঠিক মনে হয়, সেটাই আমার পথ হয়ে ওঠে।’ এভাবেই বইয়ের পাতা জুড়ে তাঁর জীবনের একের পর এক অধ্যায়ের কথা বলেছেন শিল্পী। আমরা জানতে পারছি প্রায় দেড় দশক রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর কিউরেটর অফ পেইন্টিং পদে যুক্ত থাকার কথা। আন্তর্জাতিক আঙিনায় কীভাবে স্বীকৃতি পেল তাঁর সৃষ্টি। কিংবা কীভাবে এই বয়সে পৌঁছেও নতুন নতুন ছবি আঁকার ইচ্ছে তাঁর মনের ভিতরে জন্ম নিচ্ছে অবিরত।
এসবেরই পাশাপাশি এই বইয়ের অন্যতম প্রাপ্তি আর্ট কলেজে পড়ার সময় গোপাল ঘোষের মতো প্রবাদপ্রতিম শিল্পী বা আরও অনেককে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতার বর্ণনা। পাশাপাশি পিকাসো থেকে ভ্যান গঘ কিংবা পল ক্লি-র শিল্পচেতনা, অবনীন্দ্র-রবীন্দ্রনাথের ছবি, জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে যোগেন চৌধুরীর অসামান্য মূল্যায়ন। সেই সঙ্গে গ্রন্থের একেবারে শেষদিকে শিল্পী মুখোমুখি হয়েছেন বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্নের। কোথা থেকে তিনি ছবি পান কিংবা তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস, শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতা, শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে আধুনিকতার সম্পর্কের কথা বিস্তৃত ভাবে বলেছেন তিনি। কেবল শিল্পানুরাগীই নন, জীবনরসের রসিক যে কোনও মানুষই বইটি হাতে তুলে নিলে চট করে নামিয়ে রাখতে পারবেন না।
যোগেন চৌধুরীর আঁকা প্রচ্ছদপট-সহ বইটির সামগ্রিক নির্মাণ চমৎকার। আরেক কিংবদন্তি শিল্পী কৃষ্ণেন্দু চাকীর করা গ্রন্থসজ্জা এবং বইয়ের ভিতরে যোগেন চৌধুরীর আঁকা অসংখ্য স্কেচ শিল্পসৌকর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। যা পাঠকের অন্যতম প্রাপ্তি। ছাপার ভুলও তেমন চোখে পড়ে না। তবু যদি কোনও অতৃপ্তির কথা বলতেই হয়, তা হল শিল্পীকে নিয়ে অন্য শিল্পী বা শিল্পরসিকের লেখা ভূমিকা কিংবা শিল্পীর একটি সংক্ষিপ্ত জীবনীপঞ্জী। এই সংযোজন হয়তো বইটির আকর্ষণ আরও কিছুটা বাড়িয়ে তুলত।
সাক্ষাৎকার: যোগেন চৌধুরী
দেবভাষা। মূল্য ৪৫০