এসব সাদা-কালো মিশিয়েই একজন মানুষ প্রকৃত শিল্পী হয়ে ওঠেন, নিজস্ব কফির ব্র্যান্ড তৈরি করেন, চার-চারবার বিয়ে ভেঙে যায়, জনসাধারণের জন্য ট্রান্সেনডেন্টাল মেডিটেশন সেন্টার গড়ে তোলেন, ওয়েদার রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ইউটিউব চ্যানেল খোলেন, মিউজিক বানান, পেইন্টিং করেন, বই লেখেন, অভিনয় করেন, অ্যাকাডেমিশিয়ানদের ‘লিঞ্চিয়ান’ বলে একটা শব্দ দান করেন, টেলিভিশনকে বদলে দেন আমূল আর আমাদের দেন সাহস, কুলকুল সাহস, ঝমঝম সাহস, চাবুক চাবুক সাহস। যখন সবাই আমাদের হাত ছেড়ে দেয়, আমাদের আগাগোড়াহীন উদ্ভট ভাবনাগুলো নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আমরা বুঝতে পারি না, তখন তিনি আমাদের জন্য একজন ডেল কুপারকে পাঠিয়ে দেন, যে বলে দেয় উবু দশ কুড়ি গুণে, খুনী কে?
ধাঁধা ৩
১৯৭৩, পয়লা জুলাই, সকাল ১১টা
ঝলমল মানস সরোবরের পারে রিনরিন প্লাস্টিকে মোড়া টলটলে লরা পামারের নিথর শরীরখানা যখন লালু মাল আবিষ্কার করছে, তখন হেনরি স্পেন্সর তার চিররুগ্ন সন্তানের মাথাকাটা দেহখানা নিয়ে মা পার্বতীর পায়ের কাছে বসে আছে বিলকুল! পিছনে বন্ধু অ্যাঞ্জেলো বাদালামেনতি নরম আর বোকা অসুরগণের সঙ্গে মিহি সিন্থেসাইজার বাজিয়ে চলেছেন অবিরাম। এ এক অদ্ভুত মায়াহীন দিন। কৈলাসের মাথায় মহাঋষি ধ্যানে অতিবাহিত করে চলেছেন কালের পর কাল, মহাকালের পর মহাকাল, যমসময়ের পর যমসময়। একটু পরেই তিনি রেস্টুরেন্টের পিছনে দেখা একটা বিরল প্রজাতির স্বপ্নদৃশ্য নিয়ে ডিটেকটিভ জ্যাকের সঙ্গে শুরু করবেন ঠান্ডা তুষারের মতো শিরশির কিছু অবান্তর কথোপকথন। সেই রেস্তোরাঁর পিছনের গলিতে আমরা দাঁড়িয়ে পড়ব একে একে, তারপর দেখে ফেলব নিজেদের ফেলে আসা গতজন্মের ভয়ালতম ডানা মেলা ও জটাধারী একজন ভয়কে। মহাঋষি এখানেই হেনরি স্পেন্সরের দুর্বল সন্তানের ঘাড়ের ওপর বসিয়ে দেবেন জোসেফ মেরিকের মাথা। লোকে তাকে নিয়ে সিনেমা বানাবে প্রতিটা সাদা-কালো দিনে, নাম দেবে ‘সরল হাতির মাথা’। উত্তর দিকে, ব্রহ্মকমলের রেণুর সঙ্গে চামরি গাইয়ের দুধ মিশিয়ে, তা সোনার বাটিতে করে সেসব সময়কালে ইসাবেলা রোসালিনি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকবেন নীল ভেলভেটের একটা গাউন পরে। তিনি ১৯৯১-এর পরেও গাউন কেচে রোদে মেলে দেবেন, জলখাবারে কিনোয়া বানিয়ে অপেক্ষা করবেন তার বন্ধু ডিটেকটিভ জ্যাকের জন্য। বন্ধুরা তো এমনই হয়। তাঁরা জীবন আর স্বপনের দুই ধারেই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল তৈরি করে রাখেন, ভালোবাসবেন বলে। ভালোবাসা তো ফুরয় না, শুধু একদিকে পাশ ফিরে শোয় যখন অন্য পাশটা ব্যথা করে ওঠে।
এলভিন এইভাবেই একদিন এইটুকু ‘বন্ধু’ শব্দটার মান রেখেছিল, ছুটে গিয়েছিল ভাইয়ের কাছে। ব্যাপারটা এতটাই জটিলতম যে, তাকে বোঝার জন্য কাছের মানুষগুলোর কাছে কোনও একদিন ছুটে ছুটে যেতে হবে আমাদের। কোনও এক নিস্তেজ রাতে তারপর দু’জনে পাশাপাশি বসে চুপচাপ চা খাব খামোকা। সবশেষে দেখা যাবে ‘স্টেজকোচ’-এর ঘোড়াগুলোর পিঠের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে ই.টি. আমাদের সিনেমা বোঝাচ্ছে, বলছে, ওই কালো পেইন্টিংটার মধ্যে থাকা সবুজ গাছগুলোকে হাওয়ায় দুলিয়ে দাও দেখি মনা। তারপর আগুপিছু আগুনের শব্দ জুড়ে জুড়ে হাঁটতে শুরু করো ছবিটার দিগন্তরেখা বরাবর, যেটা কোনওভাবেই চিত্রের মধ্যভাগে অবস্থান করবে না।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে সেই আগুন পৌঁছে যাবে লরা পামারের নখের ভিতর। সেই নখের গভীরে কোটি কোটি মেয়েকে তাদের কোটি কোটি বাবারা ধর্ষণ করে চলেছে প্রতি রাতে। এই সিনেমার মেকিং আবার যুবক তারিনবাবুর ভালো লাগে না যেন। যেমনটা টিমটিমে ডুন নিয়ে ডিটেকটিভ জ্যাক বা জডোরস্কি বেমালুম কী ভাবেন আমার আর জানা হয় না। আমরা শুধু জানি, একটা বাচ্চা ছেলের দীন দয়াল ঠাকুমা খাটের তলায় দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে একটা গাছে পরিণত হয়। এরপর শুরু হয় শহরে কাটা-কানের বৃষ্টি। মৃদুমন্দ বন্দুক হাতে টসটসে মনখানা কেমন করে ওঠে বাঁদরটার। গাছের গুঁড়ির কাছ থেকে ডিটেকটিভ বুঝতে চায়, বারুদের প্রকৃত স্বাদ আসলেই বা কীরকম? গ্লিন্ডা পরি কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে যায়, “Don’t turn away from love.”
ধাঁধা ১০
১৯৪৬, বিশে জানুয়ারি, মনটানা
২০০১ সালে নির্মিত ‘মুলহল্যান্ড ড্রাইভ’ ছবিটি আমার কাছে আদপেই অর্ধ শতাব্দী আগে নির্মিত ‘সানসেট বুলেভার্ড’ এবং ২০০৭-এ থাইল্যান্ডে নির্মিত ‘প্লয়’– এই ছবি দু’টিরই একটি অত্যাশ্চর্য প্রিকোয়েল। নর্মা, বেটি এবং ডাং আসলে একটাই চরিত্র, যাকে তিনজন পুরুষ শিল্পী তাদের চোখ দিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে দেখছে। ছবিগুলো জুড়ে আমরা দেখি, পুরুষতান্ত্রিক একটা বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে আসা নারী শিল্পীদের এক বিচিত্র মনোজগৎকে। মুলহল্যান্ড ড্রাইভে নবাগতা অভিনেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করতে আসা, তখনও তথাকথিত বিখ্যাত না হওয়া নাওমি ওয়াটসকে আমরা যখন শুটিংয়ের বাইরে দেখি, পরিচালক তাকে পরিচালকের গালে চড় মারতে বলছেন, তখন এই ঘটনাটুকু আমার মতে আর সিনেমাটার বাইরের ঘটনা থাকে না। আমরা সেই সময়ে তাদের সম্পর্কের সমীকরণ জানি না ঠিকই, কিছুক্ষণ পর এও বোঝা যায়, যে পরিচালক অভিনেত্রীর সঙ্গে মশকরা করছিলেন, তবু কোথাও একটা ‘কিন্তু’ থেকে যায়। যেমন ‘কিন্তু’ থেকে যায়, ২১ বছর ধরে স্মোকিং ছেড়ে দেওয়ার পরেও একটা মেডিটেশনে অভ্যস্ত ব্রেন কেন আবার সিগারেটে ফিরে যায় এবং কীভাবে তার ফুসফুস Emphysema-তে আক্রান্ত হয়? যেভাবে তিনি ‘স্টার ওয়ার্স’-এর অফার ফিরিয়ে দেন, সেভাবে কেন ‘ডুন’-কে নাকচ করতে পারেন না?
এসব সাদা-কালো মিশিয়েই একজন মানুষ প্রকৃত শিল্পী হয়ে ওঠেন, নিজস্ব কফির ব্র্যান্ড তৈরি করেন, চার-চারবার বিয়ে ভেঙে যায়, জনসাধারণের জন্য ট্রান্সেনডেন্টাল মেডিটেশন সেন্টার গড়ে তোলেন, ওয়েদার রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ইউটিউব চ্যানেল খোলেন, মিউজিক বানান, পেইন্টিং করেন, বই লেখেন, অভিনয় করেন, অ্যাকাডেমিশিয়ানদের ‘লিঞ্চিয়ান’ বলে একটা শব্দ দান করেন, টেলিভিশনকে বদলে দেন আমূল আর আমাদের দেন সাহস, কুলকুল সাহস, ঝমঝম সাহস, চাবুক চাবুক সাহস। যখন সবাই আমাদের হাত ছেড়ে দেয়, আমাদের আগাগোড়াহীন উদ্ভট ভাবনাগুলো নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আমরা বুঝতে পারি না, তখন তিনি আমাদের জন্য একজন ডেল কুপারকে পাঠিয়ে দেন, যে বলে দেয় উবু দশ কুড়ি গুণে, খুনী কে?
ধাঁধা ৪
২০২৫, সিকি জানুয়ারি, তুরীয়
আমাদের চৈতন্য যদি একটা গল্ফ বলের মতো হয়, তাহলে আমরা একটা বই পড়লাম বা একটা সিনেমা দেখলাম বা আমাদের চারপাশে যা যা কিছু ঘটল, সেসব কিছুকেই আমরা বিচার করব বা অনুভব করব ও তাতে প্রতিক্রিয়া দেব, আমাদের ওই গল্ফ বলের মতো আকারের চৈতন্য দিয়েই। এবার মেডিটেশনের মাধ্যমে আমরা যদি আমাদের সেই চৈতন্যকে ধীরে ধীরে একটা ফুটবল বা তার থেকেও আরও বড় জলের ট্যাঙ্ক কিংবা কোনও মদের ব্যারেলের আকার দিতে পারি, অথবা সেটাকে একটা গোটা প্ল্যানেটের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারি, তবে আমাদের বোধের ক্ষেত্রটা যেমন বাড়বে, তেমন আমাদের আচরণগুলোও হয়ে উঠবে ওই গ্রহের আকারের মতোই অনেক বেশি বিচক্ষণ, দ্রুত এবং ততটাই; যতখানি প্রয়োজন।
আসলে আমাদের যত কামনা, বাসনা, দুশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন, নেগেটিভ ভাবনা, এই সবকিছুই থাকে আমাদের মনের উপরি ভাগটায়, আর আমাদের বুদ্ধি, সুখ, ক্রিয়েটিভিটি ও যা কিছু ভালো অনুভূতি, সে সবের জায়গা মনের অনেক গহনে। দিনে দু’বার কুড়ি মিনিট করে মেডিটেশন করলে যেটা হবে, সেটা হল প্রথমেই আমাদের মনের ওপর থেকে আস্তে আস্তে ডিপ্রেশন, পুরনো ট্রমা, বাজে চিন্তাভাবনা, এইসব খারাপ জিনিসগুলো সরে গিয়ে মনের অজানা গহ্বর থেকে উঠে আসবে ক্রিয়েটিভিটি, শান্তি এবং পরম তুরীয় এক আরাম ও অপার অসীম আনন্দ।
চারপাশের এই কোলাহল, একাকিত্ব এবং টক্সিক আবহাওয়া থেকে বাঁচতে, ট্রান্সেনডেন্টাল মেডিটেশনকে এতটাই সহজভাবে ডেভিড লিঞ্চ আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে যান। তিনি বৈদিক দর্শনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন যে, সুখের খোঁজ বাইরে নয়, নিজের ভিতরেই আমাদের তা করতে হবে। তাঁর সিনেমা ও পেন্টিংকে যতটা তিনি আমাদের কাছে দুর্বোধ্য করে তোলেন, এই সহজ জীবনশৈলীকে তিনি ততটাই সহজতর করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে কিন্তু আমরণ বদ্ধপরিকর থাকেন। প্রথম জীবনে লিঞ্চের অ্যাঙ্গার ইস্যু ছিল, তারপর একদিন তাঁর প্রথম স্ত্রীর বাবা তাকে একটা বৌদ্ধ দর্শনের বই পড়তে দেন এবং এর কিছু পর থেকেই তিনি মেডিটেশনের পথে হাঁটতে শুরু করেন। একটা মানুষের মেন্টাল হেল্থকে ঠিক রাখতে প্রতিদিনের জীবনে মেডিটেশন যে কতখানি দরকার, তা ডেভিড তাঁর সম্পূর্ণ যাপন দিয়ে আমাদের বলে দিয়ে গেলেন। ইন্টারনেটে এইজন্য গাদাগাদা ইন্টারভিউ রেখে গিয়েছেন তিনি আমাদের জন্য। তাঁর শিল্পকর্ম যতখানি দর্শককে ভাবাবে, তাঁর এই সাক্ষাৎকারগুলো ততটাই অক্সিজেন দেবে আমজনতার মানসিক স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখতে।
পুনশ্চ
তিনি বলছেন, যেখানে জীবনেরই কোনও মানে নেই, সেখানে শিল্পের মানে খুঁজতে যাওয়াটা বোকামির। তিনি ন্যারিটিভের থেকেও সিনেমায় বরাবর মুডের ওপর বেশি বিশ্বাস রাখছেন। এই খাপছাড়া প্রণামটিও সেরকমই হয়তো বা…