বয়েজ হাই স্কুলের দাপুটে বদরাগি অঙ্কের মাস্টার নিত্যহরিবাবু স্টোনম্যানের কবল থেকে ছাড়া পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে হেডস্যরকে বলেন– ‘‘ক’দিনই বা বাঁচব, আর এই যোগ-বিয়োগ, লাভ-ক্ষতি, তোমার চারটে আপেল আমি নিয়ে নিলাম, আমার চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে তোমার জল কতখানি বেড়িয়ে গেল ইত্যাদি জাগতিক বিষয়ে আবদ্ধ থাকতে চাই না। মা ডেকেছেন। এখন থেকে শুধু বাংলা কবিতা পড়াব।’’
৮.
সুকান্ত তোতলাতে শুরু করলেও কমল বললে, ‘বোস। কী চাস বল। পেয়ারা খাবি? আমাদের গাছের বিখ্যাত কাশীর পেয়ারা?’ টিপু নাক-মুখ কুঁচকে তাচ্ছিল্য সহকারে জবাব দিলে, ‘ছোঃ, সে তো রোজই খাই। কাকিমা আপেলের মোরব্বা করেছে, তা-ই দাও দেখি! কাল চাইলাম, বললে এখনও মজেনি। এদিকে আমার…।’ কমল ওকে মাঝপথে কেটে বললে, ‘কীসের দল জানিস?’ টিপু হাতে ধরা বেজির ছানাটাকে বুকপকেটে পুরে খিঁচিয়ে উঠল, ‘‘হেডস্যরের বাড়িতে চলো, সেখানেই বলি। খামোখা দু’বার শুনতে হবে না। যত্তসব!’’
কমল কথা না বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে– ‘স্টোনম্যান সাজবি?’ টিপু বললে, ‘নাঃ। আমার যা সাইজ, তাতে বেশিরভাগ লোকের বুক অবধি হাত উঠবে না। ভয় দেখানোর জন্য আগে রাস্তায় শুতে বলা যায় না। স্টোনম্যান তোমরাই সাজো– শুধু আমি যাদের নামের লিস্টি দেব, তাদেরকে আগে ভয় দেখাতে হবে।’ ‘এ আর এমন কী’ বলে সুকান্ত লাফিয়ে উঠল।
পরে বোঝা গেছিল যে, টিপুর দাবিদাওয়া-সংক্রান্ত সনদের সবটা সুকান্তর পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হয়নি। বয়েজ হাই স্কুলের দাপুটে বদরাগি অঙ্কের মাস্টার নিত্যহরিবাবু স্টোনম্যানের কবল থেকে ছাড়া পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে হেডস্যরকে বলেন– ‘‘ক’দিনই বা বাঁচব, আর এই যোগ-বিয়োগ, লাভ-ক্ষতি, তোমার চারটে আপেল আমি নিয়ে নিলাম, আমার চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে তোমার জল কতখানি বেড়িয়ে গেল ইত্যাদি জাগতিক বিষয়ে আবদ্ধ থাকতে চাই না। মা ডেকেছেন। এখন থেকে শুধু বাংলা কবিতা পড়াব, মেরে সপনোঁ কি রানি কব আয়েগি তু না কীসব আছে, সে আমার মুখস্থ করতে বেশি সময় লাগবে না। হয় তুমি ব্যবস্থা করে দাও, নয়তো পেনশন নিয়ে কাশী চলে যাই। ভিক্ষে করে খাব, তাও ভালো, তবু এই হাউহাউহাউ উরিবাবারেমারে হাউহাউহাউ…।’
তারপর ফের সেই ‘জল আন’, ‘বাতাস কর’, ‘হাতে প্রিয় বেতটা ধরিয়ে দেখ জ্ঞান ফেরে কি না’– সে একেবারে কুরুক্ষেত্র! একটু ধাতস্থ হয়ে যা বললেন, তাতে বাকি মাস্টারদের চক্ষু চরগ্গাছ! ইতিহাসের দিদিমণির দাঁতে দাঁত লেগে গেল– ওঁর অবিশ্যি সবেতেই দাঁতে দাঁত লেগে যেত, তাই ওঁকে একরকম যত্ন সহকারেই ঘরের এককোণে রোল করে ঠেলে সরিয়ে রেখে সকলে নিত্যহরিবাবুকে নিয়ে পড়ল। সে রোল করে রাখা নিয়েও কম কুচুটেপনা হয়নি– ‘হ্যাঁ, আমাকে তো কেউ দেখলই না’ বলে উনি রোজ পথে-ঘাটে সুচিত্রা সেনের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে অভিমান দেখাতে শুরু করলেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
জল-টল খেয়ে নিত্যহরিবাবু যা বললেন, তার সারমর্ম হচ্ছে, উনি সন্ধেবেলা ছাত্র পড়িয়ে ফিরছিলেন, এমন সময় ঘোষেদের আমবাগানে কে বা কারা ওকে সাইকেল থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। প্রবল পরাক্রমী শত্রুকে অকুতোভয়ে সম্মুখসমরে মোকাবিলা করতে যাবেন, এমন সময় পশ্চিম রণাঙ্গনের লেলিহান শিখার আলোছায়া ভেদ করে বক্ষপিঞ্জরের দু’দিকে পা দিয়ে স্টোনম্যান পাথর চাগিয়ে দাঁড়াল (ভাষাটা বাংলার স্যর অমলবাবুর– ওকে দেখলেই আমরা দূর থেকে ‘দই চাই, দই’ বলে চিৎকার করতাম)। সে বিষয়ে পরে কথা হবে, এখন আসল গল্পে ফিরি। তদপশ্চাৎ প্রস্তরদানবটি– বোঝাই যাচ্ছে নিশ্চয়ই এই নামটাও দই স্যরের দেওয়া, সরল নিষ্পাপ শিশুদের অঙ্ক শেখানোর নামে নানাবিধ অত্যাচারের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করে, এবং মৃত্যুই যে তার একমাত্র শাস্তি, সেটি ঘোষণার পর, আমাকে ৬২.৭৯৫-এর ঘরের নামতা বলতে নির্দেশ দেয়– মুখে ক্যাবল অসইব্য কথা, আমাকে চুয়াত্তরবার, মানে ওই প্লাস মাইনাস সাত আটবার রে পামর বলেছে। উরিবাবা সে কী ভয়ংকর কণ্ঠস্বর! উরিবাবা সে কী ভয়ানক দৃশ্য! বিশাল পাথর, তা একশো কিলো তো হবেই, মানে প্লাস মাইনাস টুয়েন্টি-ফট্টি কিলোজ– মাথার ওপর তুলে দৈত্যাকার নররাক্ষস, দশ বারো হাত লম্বা– মানে গিভ অ্যান্ড টেক প্লাস মাইনাস তিন চার হাত, কেবল গর্জন করছে ‘শিগ্গির নামতা বল, গরগরগর, নইলে দিলাম থেঁতো করে, গরগরগর!’ পাশ থেকে কারা সব বলছে ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, ৬২.৭৯৫ দরকার নেই, শুধু ৬২.৭৯ ঘরের নামতা হলেই হবে, জলদি কর, গরগরগর। উরিবাবা হাউহাউহাউ!’
বোঝাই যাচ্ছে, এরপর আমরা প্রত্যেকে আবার দুই দলে ভাগ হয়ে গেলাম। একদলের বক্তব্য স্টোনম্যান একটা নয় অনেকগুলো, অপরপক্ষ মুখ বেঁকিয়ে বললে, ‘আরে ধুর, দলের পান্ডার সঙ্গে বাকিরা অ্যাসিসট্যান্ট। চাকরবাকর। পাথর-ফাথর গুছিয়ে রাখে। এই যেমন আমাদের নবীনটা বড় সায়েবের ইসে, মানে কেরানি। কাগজপত্তর গুছিয়ে দিলে, সকালে বাজার করে দিলে, বউদির ডালের বড়ি তুলে দিলে, আপিসে বেলা বারোটার পরে গেলে, এটা নাড়লে সেটা চাড়লে আবার মাস গেলে মাইনেও পেলে।’ নবীনবাবুর তাতে সে কী রাগ! তপনের দোকানে চা খাওয়াই ছেড়ে দিলে। ‘কী, আমি ইসে? পাথর গুছিয়ে দিই?’ ‘তা কেন? ডালের বড়ি তুলে দেওয়ার কথাও তো বলা হয়েছে! আশ্চয্য যা হোক! কথায় কথায় কেবল অন্যায্য ক্রোধ!’ নবীন তবু ফোঁসফোঁস করে। কে একটা এমনিই, সরল মনে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আচ্ছা, এই ওয়েদারে ডালের বড়ি দিলে শুকোবে?’ ব্যস, আর যাবে কোথায়! একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে তেড়ে মারতে যায়। সে সময় এরকম ইনডিসিপ্লিন্ড লোকও প্রচুর ছিল।
টিপুর তালিকাটিতে ক্রমশ নামের পাশে ঢেঁড়া পরতে থাকে, এবং আমাদের ছোট্ট গ্রাম্য মফসসলে ভয় খেয়ে চমকে ভ্যাবাচ্যাকা লোকেদের সংখ্যা আশ্চর্যরকম বৃদ্ধি পায়। মিনতি কাকিমা একদিন ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এল। স্টোনম্যানদের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করে মালিক পক্ষের সৈন্যদের খতম করা যায় কি না, সে নিয়ে নরেশদা অনেকদূর এগিয়েও দলে যথেষ্ট সমর্থন জোটাতে না পেরে ‘ধুত্তোর’ বলে বাঙালির জন্য আর কিছু না করার সিদ্ধান্ত নেন। এসব অনেককাল আগেকার কথা। তখনও একদল মানুষের হাতে পাথর তুলে আর একদল মানুষের মাথা তাক করে ছুড়তে বলা এত সহজ ছিল না। দিনের বেলায়, বাজারের মধ্যে, হাজার হাজার মানুষের মাঝখানে– যারা স্বাধীনতার জন্য, নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার্থে লড়াই করেছিল, সেরকম মানুষ– মহিলাদের পাথর ছুড়ে খুন করার নিদান বাঙালি দিল আরও কিছুকাল পর। সে গল্পে আসছি।