কেক যখন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেল, তখন শুরু হল কেক নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা নতুন করে। ১৭৬৪ সালে ডা. জেমস বেকার আর জন হ্যানন গরম গ্রানাইটের স্ল্যাবের মধ্যে কোকো বিন্ ফেলে গুঁড়িয়ে চকোলেট বানালেন আর সেই পেস্ট জলের সঙ্গে গুলে কেকের সঙ্গে মিশিয়ে প্রথম চকোলেট কেক বানালেন, কিন্তু সেই কেকে কোকো-র তিক্ত স্বাদ রয়ে গেল, তাই অনেকেই মুখ ফিরিয়ে রইল।
২০.
যিশুখ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগের দিন শিষ্যদের সঙ্গে শেষবার খেতে বসে রুটি খেয়েছিলেন। জর্ডনের কাছে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় পনেরো হাজার বছর আগেও মানুষ রুটি খেত। সবে বড়দিন গিয়েছে, সামনে নতুন বছর। এই সময়ে কবে থেকে মানুষ রুটি খাচ্ছে, এই ভেবে সুস্থ শরীর ব্যস্ত না করে বরং কেক নিয়ে গল্প হোক– যা খেতে খেতে পুরনো বছর থেকে আমরা নতুন বছর পাড়ি দিয়ে থাকি।
‘কেক’ নামটা এসেছে দেড় হাজার বছর আগের ইউরোপ দাপিয়ে বেড়ানো ভাইকিংদের নর্স ভাষা থেকে– যেখানে ‘কাকা’ নামে এক ধরনের রুটি ছিল, যা আজকের কেকের পূর্বপুরুষ। তার মানে কি দেড় হাজার বছর আগে কেক ছিল না? আলবাত ছিল, তবে তখন সেটা আজকের কেকের মতো দেখতে ছিল না। প্রাচীন মিশরের মানুষ রান্নার ওপর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে– তারাই প্রথম ওভেন বানায়। সুজির আটা, মধু, মাখন আর ডিম দিয়ে তারা ওভেনে যে রুটি বানাত, সেটা মিশরীয় দেবদেবীদের নিবেদন করার জন্যে আর ফ্যারাওদের খাবার জন্যেই বানানো হত। ক্বচিৎ সাধারণ মানুষের শেষপাতে এই রুটি জুটত। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর গ্রিক পুঁথিতে যে কেকের পূর্বসূরির উল্লেখ রয়েছে, সেটাও আটা আর মধু দিয়ে বানানো। রোমানরা এই ‘কেক’কে আরও মিষ্টি খেতে ভালোবাসত– তারা কেক বানাত আটা, অলিভ অয়েল আর ডিম দিয়ে, তাতে ফল আর বাদাম দিত আর মধুতে চুবিয়ে রাখত।
মধ্যযুগ অবধি কেক বড়লোকদের খাবার হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল, কারণ সাধারণ মানুষের সামর্থের বাইরে ছিল এই খাবার। চিনি ছিল দুষ্প্রাপ্য, তাই মধু দিয়েই হত সেই আমলের কেক। ইউরোপের রেনেসাঁর সময় সাধারণ মানুষের কাছে চিনি পৌঁছল আর তারপর কেক হয়ে উঠল সবার খুশির আর উদযাপনের খাবার– সে জন্মদিন হোক বা বিবাহবার্ষিকী, কেক সেখানে থাকবেই। কেকের সঙ্গে যেহেতু আনন্দ উদযাপন জড়িত হয়ে গেল, কেক বানানো হয়ে উঠল এক পারিবারিক উৎসব, যেখানে পরিবারের সবাই কম-বেশি যোগদান করতে থাকল। ক্রিস্টমাসের সময় যেহেতু বেজায় ঠান্ডা পড়ে যায়, কেক বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত খ্রিস্টমাসের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে ‘কেক মিক্সিং উৎসব’ শুরু হয়েছিল মূলত সেই কারণেই। ক্রিস্টমাসের ফ্রুট কেক তৈরিতে যে উপাদান লাগে, প্রবল শীতের মরশুমে সেগুলো পাওয়া মুশকিল। তাই আগের বছরের ফসলের কিছু জিনিস সরিয়ে রাখা হত এই কেক বানানোর জন্য। এছাড়াও আসন্ন ফসলের মরশুম যাতে ভালো হয়, পরিবারের সবাই সেই প্রার্থনা মনে নিয়ে এই কেক মিক্সিং উৎসব শুরু করেছিল। বিভিন্ন রকমের বাদাম, গরম মশলা, চেরি, খেজুর, শুকনো আদা, ডিম, চিনি আর আটা সঠিক পরিমাপে মিশিয়ে সেটা রাম, ব্র্যান্ডি বা ফলের রসে চুবিয়ে জাড় দেওয়া হত আর এই কাজে হাত লাগাত পরিবারের সবাই– অ্যালকোহলে ডুবিয়ে রাখার জন্যে এই ফলগুলো নষ্ট হয়ে যেত না, উল্টে কেকে এক আলাদা স্বাদ এনে দিত। ঈদ-উল-আদা’তে যেমন মাংস প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করার প্রথা, এই কেক মিক্সের কিছুটা প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করার প্রথা ছিল সেই সময়ের ইংল্যান্ডে। এই কেক মিক্সিং সেরিমনি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, কিছুদিনের মধ্যে সারা ইউরোপে এই উৎসব পালন শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন এই দেশের বিভিন্ন শহরের নামী হোটেলে বা প্রতিষ্ঠানেও এই উৎসব পালন করা হয় রীতিমত ঘটা করে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন ভাজারদুয়ারির আগের পর্ব: গোস্ত কা হালুয়া, বলেন কী!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কেক যখন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেল, তখন শুরু হল কেক নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা নতুন করে। ১৭৬৪ সালে ডা. জেমস বেকার আর জন হ্যানন গরম গ্রানাইটের স্ল্যাবের মধ্যে কোকো বিন্ ফেলে গুঁড়িয়ে চকোলেট বানালেন আর সেই পেস্ট জলের সঙ্গে গুলে কেকের সঙ্গে মিশিয়ে প্রথম চকোলেট কেক বানালেন, কিন্তু সেই কেকে কোকো-র তিক্ত স্বাদ রয়ে গেল, তাই অনেকেই মুখ ফিরিয়ে রইল। ১৮২৮ সালে এক ওলন্দাজ রসায়নবিদ কোকো বিন্-এর সঙ্গে বিভিন্ন নুন মিশিয়ে তিক্ততা কমিয়ে ফেললেন আর তার সঙ্গে আগের চেয়ে অনেক বেশি দ্রবণীয় করে ফেললেন। এই পদ্ধতিতে তৈরি হল আজকের কোকো পাউডার, যা হয়ে উঠল সবচেয়ে জনপ্রিয় কেক, চকোলেট কেক বানানোর অপরিহার্য অঙ্গ। আর আমাদের দেশে কবে প্রথম কেক তৈরি হয়েছিল? ১৮৮৩ সালে কেরলের তেল্লিচেরি-র মাম্বাল্লি বেকারিতে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন ভাজারদুয়ারির অন্য পর্ব: আরে, এ তো লিট্টির বৈমাত্রেয় ভাই!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এই রে! কেক নিয়ে গপ্প করতে গিয়ে এই বছর আর বোধহয় হগ মার্কেট, থুড়ি নিউ মার্কেট যাওয়া হল না, যে মার্কেট একশো বিশ বছর ধরে কলকাতাকে কেক খাওয়াচ্ছে। অবশ্য ক্ষতি নেই, এখন তো পাড়ার মোড়ে, বাড়ির নিচে কেকের দোকান সর্বত্র! নতুন বছর সবার ভালো হোক– এই কামনা করে আমি কেক খেতে বসলাম!