২০২৪-এর জানুয়ারিতে যখন আচমকাই বিদ্যুৎচমকের মতো তার মনে পড়ে, এ বছরই তো লেনিনের মৃত্যুশতবার্ষিকী, ঘটনাচক্রে ঠিক তখনই সরাসরি মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ইজরায়েলি সেনা গাজাস্ট্রিপের হাসপাতালগুলোয় বোমা ফেলে প্রতিদিন প্যালেস্তানীয় শিশুদের খুন করে চলেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে ধর্মস্থানে বদলে যাচ্ছে রক্ত জল করা ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনির সঙ্গতে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ঘুমন্ত প্রেতের মতো টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের দিকে, তখন সে আবার নতুন করে ফিরে যায় তার কৈশোরের ‘গুড বাই লেনিন’-এর কাছে।
সে বছর প্যারিসে রেকর্ড তুষারপাত হয়েছিল। কিন্তু ১৯১১ সালের ৩ ডিসেম্বর সেই হাড়কাঁপানো শীত অগ্রাহ্য করেই কালো পোশাক আর অর্ধনমিত লাল পতাকা হাতে যে অসংখ্য প্যারিসবাসী পল লাফার্গ আর ল্যরা মার্কস-এর অন্ত্যেষ্টিতে ভিড় করে এসেছিলেন, তাঁরা হয়তো শুধুমাত্র দু’জন বিপ্লবীর মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপনের জন্যই নয়, এসেছিলেন একটা গোটা প্রজন্মের শেষ অঙ্কের দুই কুশীলবের জন্য; যে প্রজন্ম ইউরোপ জুড়ে গজিয়ে ওঠা কারখানার প্রবাদপ্রতিম মুভিং অ্যাসেম্বলি লাইন আর রাজতন্ত্র-বেনিয়াতন্ত্রর ‘টাগ অফ ওয়ার’-এর ঠিক নাকের ডগায়, পচা সবজি আর সস্তা তামাকের গন্ধে ম-ম করে ওঠা ঘিঞ্জি পানশালায়, আর্ক ল্যাম্পের ঘোলাটে আলোয় বসে তর্ক করতে করতে দুনিয়াকে সেই প্রথমবারের মতো বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল যে, পৃথিবী বদলানো সম্ভব।
কার্ল মার্কস আর ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর প্রজন্ম।
কিন্তু এ-ও কি নিছক সমাপতন যে, বিপ্লবের ভবিষ্যৎ আশঙ্কায় মুহ্যমান প্যারিসবাসীর হাতে অর্ধনমিত লাল পতাকা যখন শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে, ঠিক তখনই পোডিয়ামে উঠে দাঁড়াচ্ছেন এক নিতান্তই অনুল্লেখযোগ্য চেহারার দেশান্তরী, যাঁর ওভারকোটে গাঢ়ভাবে তখনও লেগে আছে তাঁর দেশের রাজকুমারী স্নেগুরোচকার শ্বাসের গন্ধ, রূপকথার সেই স্নেগুরোচকা, যাঁর নামের আক্ষরিক অনুবাদ ‘বরফের তৈরি মেয়ে’, আর উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে যিনি বলছেন, ‘কমরেডস, লাফার্গ সারাজীবন যে স্বপ্নের জন্য লড়েছেন, রাশিয়ায় খুব শিগগিরি সে স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দেব আমরা’, লোকটাকে কেউই সেভাবে চিনছে না তখন। পুলিশের গোপন রিপোর্টে লেখা হচ্ছে, ‘রাশিয়ান। সেরকম কেউকেটা কেউ নয়। তবে বক্তা ভালো। নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন।’
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ধূসর ইস্টার্ন ব্লকের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তিতে ভূত-পূর্ব জার্মানিতে হুড়মুড় করে, তার সবটুকু চোখ ঝলসানি সমেত পুঁজিবাদ ঢুকে পড়ে। যদিও অশক্ত শরীরে তখনও টিমটিম করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামটুকু জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু পশ্চিমি দুনিয়া তদ্দিনে বুঝে গ্যাছে, প্রায় পাঁচ দশকের ঠান্ডা যুদ্ধ অবশেষে জিতে যাচ্ছে নয়া উদারনীতিবাদ। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা আর কয়েক দিনেই লিখে ফেলবেন তাঁর সেই বহু চর্চিত রাজনৈতিক দর্শনের কেতাব, ‘দ্য এন্ড অফ হিসট্রি অ্যান্ড লাস্ট ম্যান’। বলবেন এই তো ইতিহাস শেষ! কমিউনিজম মৃত।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তারপর ইতিহাস গড়াচ্ছে। ১৯১৭ সালে, পরাধীন ভারতবর্ষ থেকে বহু ক্রোশ দূরে, মেক্সিকো সিটিতে একটা ছোট্ট চিনা রেস্তরাঁয় ব্রিটিশ পুলিশের তাড়া খেয়ে এক দেশ থেকে আর এক দেশে ছুটে চলা বিপ্লবী এম. এন. রায় এসে পৌঁছেছিলেন স্রেফ লাঞ্চ করার জন্য। লাঞ্চ ফুরতে না ফুরতেই আজন্মের মতো সখ্য পাতিয়ে ফেলেন সদ্য আলাপ হওয়া বয়োজ্যেষ্ঠ মেক্সিকান সমাজতান্ত্রিক অ্যাডোল্ফো সান্টিবানিয়েজের সঙ্গে। ততক্ষণে দু’জনেই স্থির করে ফেলেছেন ‘মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টি’ স্থাপনের কথা; রাশিয়ার বাইরে, রাশিয়ান ভিন্ন, প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি। আর তারপর ১৯২০ গড়াতে না গড়াতেই মেদিনীপুরের এক অখ্যাত গ্রামে জন্মানো সেই বঙ্গ বিপ্লবীকে মস্কোয় কমিন্টার্নের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে বিপ্লবী অভিনন্দন জানিয়ে বুকে টেনে নিচ্ছেন স্বয়ং লেনিন। বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ হাতবদল হতে হতে কখন না জানি পৌঁছে যাচ্ছে সুদূর তাসখন্দে। মাত্র সাতজন কমরেড মিলে এক বিশাল মহীরুহ-র বীজবপন করছেন, যার নাম ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া’। তারপর পরাধীন দেশে পা ফেলতে না ফেলতেই তাঁদের একাধিক জন কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে যাচ্ছেন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে। অথচ তাঁদের লেখা ম্যানিফেস্টো চোরাগোপ্তা পথে ঘুরতে ঘুরতে তাদের আগেই এসে পড়েছে পূর্ববঙ্গের কোনও এক পাণ্ডববর্জিত মুসাপুরের তরুণের হাতে। উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় আসা সে যুবক অচিরেই নিজের পথ আবিষ্কার করে ফেলবে, মুজাফফর আহমেদ ব্যক্তিপরিচয় থেকে ক্রমে যৌথের ‘কাকাবাবু’ হয়ে ওঠার সময়ক্রমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য নিভে আসবে। কিন্তু স্বাধীনতার বদলে যারা উপহার পেয়েছিল দেশভাগ আর অসহনীয় সাম্প্রদায়িকতা, রিফিউজি কলোনির কালশিটেময় রাতগুলোয় স্বজনহারার অস্পষ্ট গোঙানি শুনে যাঁদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠত, রাষ্ট্রীয় উৎসবের আওয়াজের প্রত্যুত্তরে তাঁরা ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’– ছাড়া কিচ্ছুটি কখনও চিৎকার করে বলে উঠতে পারেনি। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে তাঁরা ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা পেয়েছিল। আর এমনই এক খালিপেটে দিনবদলের স্বপ্ন দ্যাখা তরুণ দম্পতির ঘরে এক ঝড়-জলের রাতে দরজার কড়া নড়ে উঠবে। জ্বরের ঘোরে টলতে টলতে সে যুবা কোনওক্রমে ছিটকিনি খুলে গলায় স্টেথোস্কোপ-সহ এক ডাক্তারকে আবিষ্কার করে প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে বিষাদে ভর করে বলবে, ‘ফিজ দিতে পারব না। ঘরে একটা পয়সাও নেই।’ আর তা শুনে ডাক্তারবাবু স্থির গলায় বলবেন, ‘‘জানি সে কথা। ফিজ দিতে হবে না। আগে দু’জনে সুস্থ হও। আমাকে কাকাবাবু পাঠিয়েছেন।’’
তারপর সময়ের নিয়মে সে যুবক আর যুবক থাকে না। শতাব্দী ফুরিয়ে আসার আশপাশেই সে তার বিস্ময়ে হাঁ নাতনিকে কুমোরটুলিতে নিয়ে যায়। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর আলো গড়ানো মুখাবয়বের ঠিক পিছন দিকে, অর্থাৎ যেদিকে শুধুমাত্র খাঁ খাঁ করা বাঁশ আর খড়ের কাঠামো, সেদিকে আঙুল তুলে উত্তর-প্রজন্মকে বোঝায় ‘দ্যাখো। এগুলোও কিন্তু শুধু পুতুলই।’ আর সেই উত্তর-প্রজন্ম বর্ণপরিচয়, সহজ পাঠ, কিশলয়-এর সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে শেখে দেওয়ালের ফ্রেমে উজ্জ্বল হয়ে থাকা ‘লেনিন দাদু’-কে। আর সে শেখে এক আশ্চর্য সব-পেয়েছির-দেশের গল্প, যে দেশের নাম সোভিয়েত রাশিয়া। যদিও সে বুঝে পায় না কেন এক করুণ ডিসেম্বরে খবরের কাগজের পাতা বন্ধ করে তার দাদু কাঁপা কাঁপা গলায় তাকে বলে, ‘আজ তুমি একটু একা একা খেলো, ক্যামন?’ আর সে দ্যাখে তার জীবনের প্রথম ও শেষ অপরাজেয় সুপারহিরোর চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।
জাম্প কাটে এরপর প্রায় দু’দশক এগিয়ে এলে দ্যাখা যায়, ইতিহাসের অর্থোদ্ধার করতে ব্যর্থ সেদিনের সেই শিশু তখনও প্রায় শৈশবের বিস্ময়ে বড়পর্দায় নড়েচড়ে ওঠা দৃশ্যগুলোকে গিলে ফেলতে চাইছে, যে পর্দায় তৎকালীন পূর্ব-জার্মানির পার্টিজান মা ক্রিস্টিয়্যান নিজের ছেলে অ্যালেক্সকে সরকার বিরোধী মিছিলে হাঁটতে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। হতভম্ব অ্যালেক্সকে হাসপাতাল জানিয়েছে, হার্ট অ্যাটাক হয়ে ক্রিস্টিয়ান এখন কোমায়। ক্রিস্টিয়ানের অসাড় শরীরকে প্রেক্ষাপটে রেখে পৃথিবী দ্রুততর গতিতে তার খোলনলচে বদলে ফ্যালে। বার্লিনের দেওয়াল ভেঙে পড়ে। ধূসর ইস্টার্ন ব্লকের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তিতে ভূত-পূর্ব জার্মানিতে হুড়মুড় করে, তার সবটুকু চোখ ঝলসানি সমেত পুঁজিবাদ ঢুকে পড়ে। যদিও অশক্ত শরীরে তখনও টিমটিম করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামটুকু জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু পশ্চিমি দুনিয়া তদ্দিনে বুঝে গ্যাছে, প্রায় পাঁচ দশকের ঠান্ডা যুদ্ধ অবশেষে জিতে যাচ্ছে নয়া উদারনীতিবাদ। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা আর কয়েক দিনেই লিখে ফেলবেন তাঁর সেই বহু চর্চিত রাজনৈতিক দর্শনের কেতাব, ‘দ্য এন্ড অফ হিসট্রি অ্যান্ড লাস্ট ম্যান’। বলবেন এই তো ইতিহাস শেষ! কমিউনিজম মৃত। পুঁজিবাদ জিতে গ্যাছে। নয়া উদারনীতিবাদ হল সভ্যতার শিখর। কারও আর কোত্থাও যাওয়ার নেই। আর যারা যারাই এ সত্যি মেনে নিতে পারছে না, তাদের অবস্থাও ওই কোমায় আচ্ছন্ন ক্রিস্টিয়ানের মতো হবে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: প্রকৃতি সংরক্ষণে ভ্লাদিমির লেনিনের দূরদৃষ্টি আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক
………………………………………………………………………………………………………………………………….
আট মাস বাদে যখন ক্রিস্টিয়ানের জ্ঞান ফিরবে তখন ঘোরতর সিনেম্যাটিক ক্লিশেতে ভর করে ডাক্তার জানাবেন তাঁর হৃদয় দুর্বল, যে কোনওরকম মানসিক অভিঘাতই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, তখন অ্যালেক্স ভেবে পায় না কীভাবে তার অসুস্থ মা-কে সে জানাবে যে, তার মায়ের বিশ্বাস আর দেশ– এই কয়েক মাসেই পাকাপাকি বাতিলের খাতায় চলে গ্যাছে! তাই অ্যালেক্স, অ্যালেক্সের বোন আরিয়ান আর বান্ধবী লরা মিলে ক্রিস্টিয়ানের ঘরে একটা কাল্পনিক পূর্ব জার্মানিকে জিইয়ে রাখে। পুরনো আসবাব, নিতান্ত বিবর্ণ পোশাক আর আক্ষরিক অর্থেই আস্তাকুঁড় ঘেঁটে তুলে আনা পুরনো খাবারের টিন দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো সেই দেশ– চার দেওয়ালের মধ্যে যে দেশের অস্তিত্ব সেটুকুই, যেটুকুর অনুমতি নয়া উদারনীতিবাদ তাকে দিয়েছে। এরপর কীভাবে বাইরের পৃথিবী হুড়মুড় করে ঢুকে আসতে চায় অ্যালেক্সের সযত্নে তৈরি করা এই এক টুকরো জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক, কীভাবে পতাকার লালকে চোখের সামনে কোকা কোলার লালে বদলে যেতে থাকা দেখে হতভম্ব ক্রিস্টিয়ানকে মনগড়া ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায় অ্যালেক্সের দলবল– সেসব নিয়েই গল্প এগোয়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: ‘কাল আবার বিপ্লব জেগে উঠবে, আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব’ রোজা লুক্সেমবার্গ
……………………………………………………………………………………………………………………………………
আর তারপরই পর্দায় দ্যাখা যায় সেই অননুকরণীয় শট, যখন বিকেলের পড়ন্ত আলোয় স্তব্ধ হয়ে ক্রিস্টিয়ান দ্যাখে হেলিকপ্টার থেকে শূন্যে দুলছেন মহামতি লেনিন। ক্রিস্টিয়ান, নাকি ক্রিস্টিয়ানের চোখ দিয়ে আদতে অ্যালেক্স, নাকি অ্যালেক্সের চোখ দিয়ে আদতে সেই মেয়েটিই দ্যাখে লেনিনকে ওরা দিগন্তের ওপারে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর তার মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় সেই কবে, এক করুণ ডিসেম্বরে খবরের কাগজের পাতা বন্ধ করে তার দাদু কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল, ‘আজ তুমি একটু একা একা খেলো, ক্যামন?’ আর সে দেখেছিল তার জীবনের প্রথম ও শেষ, অপরাজেয় সুপারহিরোর চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ১৯২৭ সালে সের্গেই আইজেনস্টাইন তাঁর ‘অক্টোবর’ সিনেমায় জাঁর তৃতীয় আলেকজান্ডারের মূর্তি উপড়ে ফেলার পর সিনেমার ইতিহাসও যেন এবার এক বৃত্ত সম্পূর্ণ করে থমকে দাঁড়ায়।
দর্শকাসনের সেই কিশোরী তদ্দিনে পড়ে ফেলেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’, সেলিনা হোসেনের ‘ধূসর মস্কো’। সে জেনে ফেলেছে গুলাগ, স্তালিনের পার্জ, স্ট্যাসির ভয় দ্যাখানো রক্তচক্ষু, তাই সে নতুন করে আর বিস্মিত হয় না! শুধু সিনেমা শেষে বাড়ি ফেরার গোটা পথটুকু এক গভীর বিষাদ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কিন্তু যা সে তখনও জানে না তা হল– সে একা নয়, তার বিষাদ এমন কিছু অভিনব নয়। সে তখনও জানে না যা সে অনুভব করছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই শতাব্দীর প্রথম নাগরিক চিন্তাবিদ ওয়াল্টার বেঞ্জামিন তাকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘লেফট উইং মেলানকোলিয়া’ হিসেবে। একুশ শতকের শুরুতে স্টুয়ার্ট হল থেকে শুরু করে এঞ্জো ট্র্যাভার্সোর মতো বামপন্থী চিন্তাবিদ যে ধারণাকে ইতিহাসের রেখা ধরে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ব্যাখ্যা করে ফেলেছেন, কীভাবে ’৮৯ পরবর্তী পৃথিবীতে বামপন্থীরা ভবিষ্যৎ লড়ে নেওয়ার প্রবণতার বদলে পূর্ব ব্যর্থতার অপরাধবোধে ডুবে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। যা হয়নি, যা হতে পারত-র নিশ্চিন্ত স্থবিরতা, পরাজয়ের নিভৃত উৎযাপন, ক্রিস্টিয়ানের ছোট্ট বেডরুমের মতো আরামদায়ক এক মেলানকোলিয়া, যে মেলানকোলিয়ার বঙ্গানুবাদ হয় না, যে মেলানকোলিয়া ইতিহাসের কাচে বর্তমানকে বিশ্লেষণ করার বদলে আবিষ্টকে বলে, দ্যাখো নস্টালজিয়া কতটা ঘুমপাড়ানি গানের মতো নরম আর উষ্ণ! ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অপরাধবোধ ঝেড়ে ফেলার চেয়ে কতটা আকর্ষণীয় এই ট্র্যাজিক অক্ষমতা! সে তখনও জানে না ফুকুয়ামাও একদিন স্বীকার করে নেবেন, ঘটনাচক্রে ইতিহাস ফুরোয়নি। সে জানে না ওয়াল স্ট্রিটে ধস নামলে আবারও ‘বেস্টসেলার’ হয়ে উঠবে মার্কসের ‘ক্যাপিটাল’, ২০২০-র এক সমীক্ষায় রাশিয়ার ৭৫% জনমত জানাবে ‘সোভিয়েত’ তাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
আর আজ প্রায় মধ্য তিরিশে এসে যখন সে দ্যাখে গোটা পৃথিবীর তাবড় চিন্তাবিদ প্রায় একবাক্যে স্বীকার করে নিচ্ছেন, পুঁজিবাদের এই সর্বগ্রাসী খিদের মুখে গোটা গ্রহটাই প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মুখে, ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্সের বাইরে কিশোরী পরিবেশবিদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকছে ‘গ্রোথ ফর গ্রোথস সেক ইজ দ্য আইডিওলজি অফ ক্যানসার’, সর্বগ্রাসী সোশ্যাল মিডিয়ার ইথারে ইতিউতি মিম ভেসে আসছে, ‘ইট ইজ ইজিয়ার টু ইমাজিন দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড দ্যান দ্য এন্ড অফ ক্যাপিটালিজম’, স্লাভয় জিজেকের মতো দাপুটে দার্শনিক আবার নতুন করে লেনিনকে নিয়ে বই লিখছেন, তর্ক করছেন কেন লেনিনের পুনর্পাঠ আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। আর তাঁর নিজের দেশের ফ্যাসিস্ট শক্তিরা আবার নতুন করে লেনিনের মূর্তি উপড়ে ফেলছে। আর সে দৃশ্য মোবাইলের পর্দায় দেখে সে আপন মনেই ভাবছে, সত্যি তো, এই একটা লোকের মূর্তি আর কদ্দিন ধরে ভাঙবে ওরা? আর তার মনে পড়ে যাচ্ছে ব্রেখটের সেই অনবদ্য কবিতার শেষ লাইন, ‘এবার তবে দেওয়ালটাকেই ভাঙো!’
আর তার মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘ওয়ান্স অ্যাজ আ ট্র্যাজেডি, দেন অ্যাজ আ ফার্স’।
এরপর ২০২৪-এর জানুয়ারিতে যখন আচমকাই বিদ্যুৎচমকের মতো তার মনে পড়ে, এ বছরই তো লেনিনের মৃত্যুশতবার্ষিকী, ঘটনাচক্রে ঠিক তখনই সরাসরি মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ইজরায়েলি সেনা গাজাস্ট্রিপের হাসপাতালগুলোয় বোমা ফেলে প্রতিদিন প্যালেস্তানীয় শিশুদের খুন করে চলেছে। দু’বছর, চার বছর থেকে মাত্র কয়েক মাসের শহিদের হাসি মুখের অজস্র ছবি সহ্য করতে না পেরে সে ইন্সটাগ্রামের জানলা বন্ধ করে দিচ্ছে। গাঙ্গেয় উপত্যকার এক বহুল বিতর্কিত অপরাধ স্থান সবার চোখের সামনে, প্রকাশ্য দিবালোকে ধর্মস্থানে বদলে যাচ্ছে রক্ত জল করা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির সঙ্গতে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ঘুমন্ত প্রেতের মতো টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের দিকে, তখন সে আবার নতুন করে ফিরে যায় তার কৈশোরের ‘গুড বাই লেনিন’-এর কাছে। সে ফিরে যায় সেই অননুকরণীয় শটে, যখন বিকেলের পড়ন্ত আলোয় স্তব্ধ হয়ে ক্রিস্টিয়ান দেখেছিল হেলিকপ্টার থেকে শূন্যে দুলছেন মহামতি লেনিন। তার মনে হয়, আসলে বিদায় নয়। তার মনে হয়, ক্রিস্টিঅ্যান, নাকি ক্রিস্টিঅ্যানের চোখ দিয়ে আদতে অ্যালেক্স, নাকি অ্যালেক্সের চোখ দিয়ে আদতে তাকেই, দিগন্তে বিলীন হয়ে যাওয়ার ঠিক আগে তর্জনী তুলে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানিভ প্রশ্ন করছেন, সে নিজে কোন পথ বেছে নেবে? আদতে ক্রিস্টিঅ্যানের চোখ দিয়ে দেখা সমাজতন্ত্রকে অ্যালেক্স কি নিজের অজান্তেই নিজের মতো করে পুনরাবিষ্কার করেনি? অ্যালেক্সের নিজের হাতে যত্ন করে বানানো সেই দেশ কি পুরোটাই সাজানো বিভ্রম না কি অন্য কোনও উজ্জ্বল এক দেশের ধারণামাত্র? অথবা সে এক নিখাদ স্বপ্ন? যে স্বপ্ন জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, উজবেকিস্তান থেকে ভারতে, আঠেরোশো উনিশশো দু’হাজার দশ কুড়ি সন পেরিয়েও ঠিক জেগে থাকে একটা জ্বলজ্বলে উপগ্রহর মতো, বিবর্তন আছে অথচ বিনাশ নেই এমন এক স্বতঃসিদ্ধের মতো? সে ভাবে; ভাবতে ভাবতে হাতে কলম তুলে নেয়। আর তার কানের কাছে সুদূর অতীত অথবা ভবিষ্যতের কেউ ফিসফিস করে আউড়ে যায় মায়াকোভস্কির কবিতার সেই অভ্রান্ত লাইন, ‘লেনিন লিভড, লেনিন লিভস, লেনিন ইজ টু লিভ ফরেভার।’