ওঁর ছবিতে কুশীলব, মানুষ কিংবা জন্তু জানোয়ার, তাসে পাখি কিংবা বানর, সাপ বাঘ, বেজি বা শিয়াল, হাঁস-মুরগি-ছাগল-ভেড়া– সবার নাকে-মুখে-গালে-চুলে যত্রতত্র অস্বাভাবিক সব রং মাখানোর প্রবণতা। এটা এল কোত্থেকে? নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়ে তাঁর রচনার চরিত্রের মধ্যে সুচিন্তিত ডায়ালগের আয়োজন। মানুষ ও প্রাকৃতিক জগতের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এমনকী, মানুষের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ছবির সীমারেখার মধ্যে ঠিকঠাক সম্পর্ক স্থাপন। সমন্বয়পূর্ণ সহাবস্থান।
কে জি সুব্রহ্মণ্যন। কেরলের কার্তিক ঠাকুর। আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় মাণিদা। ওঁকে চিনতাম। দু’-একবার মুখোমুখি বসে কথা বলারও সৌভাগ্য হয়েছে। তা বলে মানুষটাকে জানি– সে কথা বলার সাহস হয় না। জানতে হলে একটাই সহজ আর ভালো রাস্তা হল, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মানুষের ওঁর সম্পর্কে লিখিত রচনা পড়া। আরও একটা রাস্তা খোলা আছে– ওঁর বিশাল কর্মভাণ্ডার অবিরত ব্যবচ্ছেদ করে গোটা মানুষটাকে নিজের মতো করে খুঁজে পাওয়া। একজনের শিল্পকর্ম এবং বিভিন্ন স্থান-কালে তাদের বিষয়, আঙ্গিক, উপকরণ পর্যবেক্ষণে মানুষটির চরিত্র আবিষ্কার করার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে মাণিদার কাজের কিছু খণ্ডচিত্র জুড়ে জুড়ে খানিকটা জানার চেষ্টা করা যাক।
কাজের আগেই যেটা মাথায় আসছে, সেটা হল মাণিদা পরিযায়ী শিল্পী। সাধারণ নাগরিকের বাসস্থলের স্থানান্তর ঘটে অনেক কারণে, কিন্তু পরিযায়ী শিল্পীর ক্ষেত্রে মূলত কারণ, দু’টি– কর্মসন্ধান কিংবা শিক্ষা। বহুমুখী প্রতিভার জন্য পরিচিত মানুষটির কথা উঠলেই একটা শব্দ মনে আসবে, সেটা হল ‘লেনদেন’। অর্থাৎ, স্থানান্তরিত হয়ে তিনি যেখানে যাবেন, সেখানে তিনি দেবেন, না সেখান থেকে নেবেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তার কতটা দিতে হবে আর কতটা নিতে হবে, সেটার ওপর নির্ভর করছে সেই দু’জায়গার নিজস্ব সংস্কৃতির আর শিল্পের সমৃদ্ধি। শিকড় কেরলে। আসলে তাঁর পরিবার তামিলনাড়ুর কিন্তু কেরলে বসবাস। শৈশব-কৈশোর কেরলে, যৌবনে মাদ্রাজ, পরবর্তী সময়ে বাংলার শান্তিনিকেতন, গুজরাতের বরোদা আর মহারাষ্ট্রের বম্বে (মুম্বই)। প্রশ্ন উঠবে, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ কোথায় থাকবেন, সেটা কি খুব জরুরি ব্যাপার? হ্যাঁ, জরুরি। কারণ সৃষ্টিশীলতা মানুষের পারিপার্শিক অবস্থার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এই পরিযায়ী শিল্পী ক্রমে পরিব্রাজক হয়ে উঠলেন। তাঁর মনন, চেতনার বদল হল। শুধু দেশ-দেশান্তরে নয়, ছবির অন্তরেও তিনি হয়ে উঠলেন পরিযায়ী, পরিব্রাজক।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
মাণিদা পরিযায়ী শিল্পী। সাধারণ নাগরিকের বাসস্থলের স্থানান্তর ঘটে অনেক কারণে কিন্তু পরিযায়ী শিল্পীর ক্ষেত্রে মূলত কারণ, দু’টি– কর্মসন্ধান কিংবা শিক্ষা। বহুমুখী প্রতিভার জন্য পরিচিত মানুষটির কথা উঠলেই একটা শব্দ মনে আসবে, সেটা হল ‘লেনদেন’। অর্থাৎ, স্থানান্তরিত হয়ে তিনি যেখানে যাবেন, সেখানে তিনি দেবেন, না সেখান থেকে নেবেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তার কতটা দিতে হবে আর কতটা নিতে হবে, সেটার ওপর নির্ভর করছে সেই দু’জায়গার নিজস্ব সংস্কৃতির আর শিল্পের সমৃদ্ধি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘ঔৎসুক্য’ আর ‘উৎসাহ’– শব্দ দুটো যেন কেবলমাত্র মাণিদার জন্যই তৈরি। যেখানেই গিয়েছেন সেখানকার সব ভালোটুকু নিংড়ে নিয়েছেন। ফলত আমরা পেলাম, পেইন্টিং, ছাপাই ছবি থেকে শুরু করে ম্যুরাল। কবিতা, চিঠি। পুতুল, খেলনা, মুখোশ বানানো। সাহিত্যে সচিত্রকরণ, যেখানে পৌরাণিক-রূপকথা-শিশুসাহিত্য– কোনটাই বাদ নেই। কাচ এবং অ্যাক্রালিক দুটোতেই উল্টো পদ্ধতি ব্যবহারে রঙিন ছবি। এমনকী, তিনি কালীঘাট পট ইত্যাদি অনুশীলন করেছিলেন। বিভিন্ন মাধ্যমে ভাস্কর্য, বিশেষ করে টেরাকোটায় অসামান্য কাজ করেছেন। মিশ্র মাধ্যমে মুখোশ, খেলনা ইত্যাদিতে আদিবাসী স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতি তাঁর মনোনিবেশ এবং শ্রদ্ধা।
সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর চারিত্রিক গুণাবলির একটা বিশেষ দিকে নজর ঘোরাতে চাই এবার। সেটা নাটক থেকে রসদ নিয়ে আবার নাটক তৈরি। প্রসঙ্গত, আমি আর্ট কলেজে পড়াকালীন পাশাপাশি মূকাভিনয়ের পাঠ নিয়েছিলাম শিল্পী যোগেশ দত্তের কাছে এবং মাধ্যমটিকে ভিস্যুয়াল আর্ট হিসেবে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছায় কেরলের কলামণ্ডলমের কলকাতা শাখায় গুরু গোবিন্দন কুট্টির কাছে নিচ্ছিলাম ‘কথাকলি’ নাচের তালিম। প্রসঙ্গটা এই কারণে টানলাম, কথাকলি যতটা আমার কাছে নাচ বা নাটক ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল জোরালো ভিস্যুয়াল ফর্ম। চিত্রিত মুখমণ্ডল, বেশভূষা আর অঙ্গ সঞ্চালন মিলে ঠিক যেন বর্ণময় চলমান চিত্রকলা। পরবর্তীতে আমি আবার যখন দক্ষিণ ভারতে প্রবাসী তখন ভূতম্, তৈয়াম্, কথাকলির মতো অজস্র উচ্চাঙ্গের নৃত্য, লোকনৃত্য, লোকনাট্য আর লোককলা চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হয়েছে। রং মেখে, সং সেজে, দেহ চিত্রিত করে, দেহ বিস্তারে ফুল-পাতা-গাছপালা মায় ধাতুর নানা নকশা মিলে শরীর জুড়ে চালচিত্র। নানা বিচিত্র মেকআপ, কত না প্রপ্। অসংখ্য জীব জানোয়ার, মাছ পাখি, সাপ, ব্যাঙ– প্রত্যেকের সঙ্গে সহাবস্থান। গরু, ঘোড়া কিংবা হাতি– প্রত্যেককে রাঙিয়ে, সাজিয়ে একাকার। ফুলে ফুলে আলপনা। বারো মাসে তেরো তো নয়, তেরো শ’ পার্বণে লাঠি খেলা, অসি খেলা, নৌকা বাইচ। ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব, দেবতা-অপদেবতা। জীবনযাপনে আনন্দে দুঃখে, সংস্কৃতি, সংস্কার, কুসংস্কারে, সর্বত্র অহরহ দৃশ্যকলার জলসা।
শৈশবে, কৈশোরে চারপাশ ঘিরে যে ঘটমান বিচিত্রানুষ্ঠান তার কিছুই কি দেখেননি সুব্রহ্মণ্যন? মনে হয়, হাঁ করেই দেখেছেন সব। হয়তো সারা জীবনের কাজের খসড়া খাতাখানি তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, আর তিনি সেটা তাঁর ধমনিতে বয়ে বেড়িয়েছেন। দর্শক লক্ষ করবেন, ওঁর ছবিতে কুশীলব, মানুষ কিংবা জন্তু জানোয়ার, তাসে পাখি কিংবা বানর, সাপ বাঘ, বেজি বা শিয়াল, হাঁস-মুরগি-ছাগল-ভেড়া– সবার নাকে-মুখে-গালে-চুলে যত্রতত্র অস্বাভাবিক সব রং মাখানোর প্রবণতা। এটা এল কোত্থেকে? নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়ে তাঁর রচনার চরিত্রের মধ্যে সুচিন্তিত ডায়ালগের আয়োজন। মানুষ ও প্রাকৃতিক জগতের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এমনকী, মানুষের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ছবির সীমারেখার মধ্যে ঠিকঠাক সম্পর্ক স্থাপন। সমন্বয়পূর্ণ সহাবস্থান। দেহাংশের মধ্যে ও যেন সংলাপ আর সম্পর্ক। অন্যদিকে জমি বিভাজন, ছবির কাঠামো নির্মাণ, রেখার বাঁধুনি, মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো! ওঁর রেখা বলিষ্ঠ ও সাবলীল যেমন, তেমনই পরিমিত ও শান্ত। শিল্প সৃষ্টিতে রেখা তাঁর চিত্র উৎকর্ষে হয়ে উঠেছিল যাদুদণ্ড! এসবই পরবর্তী কালে শিল্পশিক্ষার ক্ষেত্রে গিয়ে আরও জোরালো এবং অর্থপূর্ণভাবে সংগঠিত হয়েছিল।
শান্তিনিকেতনের পাঠের ধারা সুব্রহ্মণ্যনের মেজাজ এবং বিশ্বাসের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে গিয়েছিল। তার মূল কারণটা হল, এটা ছিল ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আর অন্য দেশের শিল্পকলা পর্যবেক্ষণে গোঁড়ামিমুক্ত। শান্তিনিকেতন পর্বে তিন শিক্ষকের কথা উঠে আসছে বার বার। নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও রামকিঙ্কর বেইজ। ওঁরা তাঁর শিল্পবোধ ও আদর্শে ছাপ ফেলেন। চিত্রচর্চার দিগন্তকে প্রসারিত এবং আধুনিক বোধ ও বুদ্ধির পথ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন, হয়ে ওঠেন নানা ধরনের ব্যবধান সত্ত্বেও তাঁর আদর্শ। নন্দলাল বসুর কেবলমাত্র সহজপাঠের অলংকরণ আর হরিপুরা পোস্টার যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন ফ্রেমবন্দি ছবির বিন্যাস কাকে বলে।
বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় বলতে, ম্যুরাল। বিনোদবিহারীর নির্দেশনায় সুব্রহ্মণ্যন ম্যুরাল তৈরি-সহ নানা উপকরণ এবং কৌশল নিয়ে পরীক্ষা করতে শিখলেন। প্রাথমিকভাবে বেঙ্গল স্কুলের ধারায় তাঁর পথ চলা শুরু হয়েছিল। অল্প বয়সেই শিক্ষক বিনোদবিহারীর শিল্পভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তৈরি করলেন কাজের অন্য বৈশিষ্ট্য, আলাদা স্টাইল, যা তাঁর নিজস্ব। একই গণ্ডির মধ্যে আর আটকে থাকেননি। অনুশীলন ও সাধনালব্ধ বোধবুদ্ধির তাড়নায় তিনি বেঙ্গল স্কুলের ধারা থেকে বেরিয়ে এলেন। নানা মাধ্যমে ছিল তাঁর আগ্রহ। অবিরাম অজস্র কাজ করে নির্মাণ করলেন নিজস্ব চিত্রভাষা। মাণিদার কথায়– বিনোদদার মতো খুব কম লোকই দেখেছি, যিনি অন্য লোক কী বলতে চাইছেন সেটা বুঝে, জেনে তারপর নিজের কথাটি বলতেন। তাঁর ছবি বা চিত্রকলা সম্পর্কে জ্ঞান যে অপরিসীম ছিল, সেটা নিয়েও নতুন কিছু বলার নেই। পাশাপাশি, সাহিত্য সম্পর্কেও তাঁর উৎসাহ ছিল দৃষ্টান্তমূলক। যে-বইটি তিনি পড়ে ফেলেছেন, তার পাতায় পাতায় কী লেখা আছে, বইটি না দেখে বলতে পারতেন বিনোদদা। এরকম ভিজুয়াল মেমোরিসম্পন্ন লোককে তো পাওয়াই মুশকিল। আরও একটা গুণ ছিল ওঁর, সকল বিষয় নিয়েই খোলামেলা কথা বলতে পছন্দ করতেন তিনি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সমীর মণ্ডলের আরও লেখা : কাঠ খোদাইয়ের কবি, আমার শিক্ষক হরেন দাস
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
রামকিঙ্কর বেইজ বলতে শান্তিনিকেতনের নিসর্গ, জ্ঞানতৃষ্ণা এবং স্কেচ। প্রকৃতির নানা রূপ, রং, রস, প্রাণভরে আহরণ। জীবনের রসদ কুড়োনো যেন। এক সাক্ষাৎকারে সুব্রহ্মণ্যন এ নিয়ে বলেছেন– শান্তিনিকেতনে গোড়ার দিকে খুব স্কেচ করতে ভালো লাগত। কিঙ্করদার সঙ্গে বহুদিন ঘুরে-ঘুরে ছবি এঁকেছি। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। পরে নিসর্গ অনুশীলনে বাস্তবের হুবহু অনুকরণ প্রসঙ্গে বলেছেন, কল্পনা নয়, আসলে আমরা যা দেখি সবই চিত্র রচনায় প্রয়োজনীয় ভিস্যুয়াল ফর্ম। আমরা যাকে বাস্তব বলি তা নিজেই এক ধরনের চিত্র।
বরোদা পর্বে সুব্রহ্মণ্যনের শিল্প ও শিল্পাদর্শ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত শক্তি ও সৃজনের কোন দিক তাঁর সম্ভাবনার দিগন্তকে উন্মোচিত করবে, শিক্ষার্থীর শিল্পচেতনা গভীর হবে, এ নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণশক্তি ছিল অসাধারণ। বিদ্যার্থীকে তিনি সেভাবে চালনা করতেন এবং শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। যাঁরা সান্নিধ্যে এসেছিলেন, তাঁরা কোনও দিন তাঁর শিল্পাদর্শকে ভোলেননি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সমীর মণ্ডলের আরও লেখা: ড্রইং শুরু করার আগে পেনসিলকে প্রণাম করতে বলেছিলেন
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কে. জি. সুব্রমাণিয়ান ভারতের আধুনিকতাবাদী ও অগ্রণী শিল্পীদের অন্যতম। তিনি ছিলেন লোককলা ও উপজাতীয় শিল্পের বিশেষজ্ঞ আর শিল্পকলা বিষয়ক গ্রন্থের লেখক। শতবর্ষের আলোয় আমদের প্রিয় মাণিদাকে স্নেহের সঙ্গে স্মরণ করি, শ্রদ্ধা জানাই। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্বাদ আর মস্তিষ্কগ্রাহ্য বোধে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন অসাধারণ শিল্পী, বন্ধু ও প্রভাবশালী শিক্ষক। তাঁর বিশাল কর্মকাণ্ড কয়েক প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে রইল।
লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিগুলি কে জি সুব্রহ্মণ্যন-এর। ছবিসূত্র: ইন্টারনেট