মুজাহিদিন সরকারের আমলেই প্রথমবারের জন্য গড়ে উঠেছিল ‘দোষ ও গুণ দপ্তর’। সেই প্রথম নারীদের সব কিছু থেকে বাদ দেওয়া শুরু হয়। হয়তো তখনই বিষয়টা তালিবানি সংস্কৃতির মতো ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বীজটা তখনই পোঁতা হয়েছিল।
আফগানিস্তান। বললেই মনে পড়ে, পাথুরে রুক্ষতায় ঘেরা এক পার্বত্য ভূখণ্ডের কথা। মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলী, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বর্ণনা। অথবা সবুজ চোখের সেই আফগান তরুণী শরবত গুলাকে। কিন্তু হালফিলে আফগানিস্তানের সঙ্গে সবচেয়ে সমার্থক বোধহয় একটাই নাম। তালিবান।
গত শতাব্দীর নয়ের দশকে প্রথমবার শোনা গিয়েছিল এই শব্দটি। কী অর্থ এই নামটির? তালিবান মানে হল ‘ছাত্র’। শুনে যতই আঁতকে উঠুন, বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়ানো এই পশতু শব্দটির আসল অর্থ এটাই। আর তাদেরই দখলে এখন আফগানভূম। ১৫ আগস্ট, ২০২১ সালে তারা দখল করেছিল কাবুল। আফগানিস্তান কেমন আছে তাদের আমলে? সত্যিই কি এদেশের দুর্দশার জন্য কেবল তারাই দায়ী? আফগান নারীদের দুরবস্থার কথা তো আমরা কমবেশি জানি। কিন্তু আফগান পুরুষরা? তাঁদের কতটা নির্যাতন সইতে হয় তালিবানের হাতে? ‘বিষয় আফগানিস্তান’ এমনই নানা দিকে আলো ফেলে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
স্বাভাবিকভাবেই, এই বইয়ে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্কও। পার্থপ্রতিম বসুর ‘ভারতের আফগানিস্তান নীতি: দ্বিধা ও দ্বন্দ্বে’ এবং অন্বেষা ঘোষের ‘চাওয়া-পাওয়া: ভারতে আফগান শিখ ও হিন্দুদের অভিজ্ঞতা’– এই দুই রচনার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। প্রথম প্রবন্ধে দুই দেশের সম্পর্কের ওঠাপড়ার রেখাচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল চালিকাশক্তিকে চিহ্নিত করেছেন লেখক।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অনিন্দ্যজোতি মজুমদার, সৌরীশ ঘোষ, আনিসুল হক সম্পাদিত এই বই, বহু বিষয়েই কথা বলে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান ছিল তালিবানের দখলে। নতুন করে তারা ক্ষমতা দখল করে ২০২১ সালের আগস্টে। সময়ের হিসেবে তারপর থেকে, অর্থাৎ গত ২ বছরের থেকে সামান্য বেশি সময়কালে, সারা পৃথিবীর সংবাদমাধ্যম বারবার তুলে ধরেছে তালিবান শাসনে, আফগানিস্তানে নতুন করে নেমে আসা অন্ধকার যুগের কথা। কিন্তু সত্যিই কি তালিবানই কেবলমাত্র সেদেশের মুক্তচিন্তার উন্মেষ ও প্রগতির অন্তরায়?
অনহিতা মজুমদার তাঁর ‘নারী: অর্ধেক আফগান আকাশ’ রচনায় তুলে ধরেছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। বেশ কয়েক বছর সেখানে থেকে তিনি কাছ থেকে দেখেছিলেন, সেদেশের মেয়েদের দুরবস্থা। আর এপ্রসঙ্গে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ ‘…তালিবানের সমালোচনা করা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু মূল পরিপ্রেক্ষিত বোঝার চেষ্টা খুব একটা করা হয়নি। আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার খারিজ করে দেওয়াকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে তালিবানের সঙ্গে এক করে দেখা হত… এর পিছনে নানান রাজনৈতিক কারণ ছিল।’ তাঁর মতে, একদিকে আফগানিস্তানে তাদের সামরিক আগ্রাসনের জন্য আফগান নারীর মুক্তির কথা বলেছিল আমেরিকা। কেন-না মার্কিন প্রশাসন আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন নিয়ে যেতে তালিবানের সঙ্গে সমঝোতা করতে আপত্তি করেনি। আবার মুজাহিদিন সরকারের আমলেই প্রথমবারের জন্য গড়ে উঠেছিল ‘দোষ ও গুণ দপ্তর’। সেই প্রথম নারীদের সব কিছু থেকে বাদ দেওয়া শুরু হয়। হয়তো তখনই বিষয়টা তালিবানি সংস্কৃতির মতো ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বীজটা তখনই পোঁতা হয়েছিল। কাজেই ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ তালিবান, একথা, সম্পূর্ণ ছবিটা তুলে ধরে না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: নামে নয়, সর্বনামে যায় আসে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সৌরীশ ঘোষের ‘তালিবান ও আফগান রাজনীতি’ সাম্প্রতিক সময় থেকে পিছিয়ে একেবারে মৌর্য-শাসনাধীন ভারতের সময়কাল পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত পরিসর ধরে রাখতে শেষপর্যন্ত তাঁর বিশ্লেষণ শুরু হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কাল থেকে। লেখক লিখছেন, ‘এই সময়কালকে বেছে নেওয়ার আরও একটি কারণ হল, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার চিরন্তন বিরোধ এবং আফগানিস্তানে তালিবান গোষ্ঠীর উত্থানের ইতিহাস, এদের মধ্যে একটি সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে।’ সেই পরিস্থিতি থেকে তালিবানের জন্ম ও বর্তমান সংকটের জন্ম পর্যন্ত যেতে যেতে বোঝা যায়, কীভাবে এই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়া, কার্যতই ‘বিদেশি শক্তির হাতের পুতুল’ আফগানিস্তানের জন্য অবধারিত ছিল। মনে রাখতে হবে, ‘শান্তি এখনও সেদেশের মানুষের কাছে সুদূর মরীচিকা মাত্র।’
কেন আবার প্রত্যাবর্তন ঘটল তালিবানের? এর দায় যে আমেরিকা এড়াতে পারে না, সেকথা উঠে আসে ‘তখ্ত-এ তালিবান: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরই ফসল’ রচনায়। সৌভিক ঘোষ লিখছেন, “আমেরিকার ‘ওয়ান অন টেরর’-এর ব্যর্থতার জেরেই যে তালিবান আবার মাথাচাড়া দিয়েছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছিল ২০০৯-এর মার্কিন সেনেটের রিপোর্টই।… মার্কিন ব্যর্থতার মাশুল হিসেবে আফগানিস্তানে এখন স্বমহিমায় তালিবান রাজ।”
এই বইয়ে উঠে এসেছে আফগান তরুণদের উপরে হওয়া নিপীড়নের কথাও। সে অত্যাচারের মাত্রা এমনই যে, ‘সন্ত্রাসের ভয়ে’ বাবা-মা ছেলেদের বাড়ি থেকে বেরোতে দিতে চায় না। বলা হচ্ছে, ২০০৪ সালের কথা, যখন তালিবান ক্ষমতাতেও নেই। অনহিতা তাঁর লেখায় লিখেছেন, ‘যারা বাইরে বের হত, তাদের মাঝেমধ্যে প্রার্থনার সময় মসজিদে চাবুক মারা হত– চাবুক মারা হত, ঠিকঠাক মাপের দাড়ি না রাখার জন্য… স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড দেখতে বাধ্য করা হত। আর হ্যাঁ, ব্যভিচারের অভিযোগে পুরুষদেরও পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হত।’ কিন্তু এই সব বীভৎসতা সেভাবে মূলস্রোতের আলোচনায় আসত না ‘কেননা সেই আলোচনা একমাত্র নারীদের বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকত।’
স্বাভাবিকভাবেই, এই বইয়ে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্কও। পার্থপ্রতিম বসুর ‘ভারতের আফগানিস্তান নীতি: দ্বিধা ও দ্বন্দ্বে’ এবং অন্বেষা ঘোষের ‘চাওয়া-পাওয়া: ভারতে আফগান শিখ ও হিন্দুদের অভিজ্ঞতা’– এই দুই রচনার কথা এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। প্রথম প্রবন্ধে দুই দেশের সম্পর্কের ওঠাপড়ার রেখাচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল চালিকাশক্তিকে চিহ্নিত করেছেন লেখক। অন্য প্রবন্ধে, আফগান শরণার্থীরা কেন ভারতকে নিজেদের আশ্রয়স্থল বলে মনে করে, সেদিকে আলো ফেলা হয়েছে। যে প্রসঙ্গে ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের কথাও এসেছে।
সব মিলিয়ে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত ও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ, অন্যদিকে শরণার্থী ও অভিবাসন সমস্যা, আফগান নারী, তালিবানের স্বরূপ নানা দিককে দুই মলাটের মধ্যে নিয়ে আসার এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বইয়ের ছাপা ঝকঝকে। তবে প্রচ্ছদটি তেমন জমেনি। সূচির বৈচিত্রের মেজাজ মলাটে আরও একটু প্রতিফলিত হলে হয়তো তা আরও চিত্তাকর্ষক হত।
বিষয় আফগানিস্তান
সম্পাদনা: অনিন্দ্যজোতি মজুমদার, সৌরীশ ঘোষ, আনিসুল হক
সেতু প্রকাশনী। ৩৭৫ টাকা।