শূন্য দশক, অর্থাৎ, চলতি শতকের প্রারম্ভ। সেই সময়পর্ব কি নিছকই নিস্তরঙ্গময়? নীরব, স্রোতহীন? ইতিহাস অন্য কথা বলে। রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি, সেই পরিস্থিতির জেরে বামপন্থী ভাবধারার ওপর জনমানসের বিশ্বাস টলে যাওয়া, সেইসঙ্গে দক্ষিণপন্থী, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির পুনর্জাগরণ বাংলাজুড়ে পালাবদলের ইঙ্গিতকে স্পষ্ট করে তোলে। ২০০৮-এ অর্থনৈতিক মন্দা ভঙ্গুর অবস্থাকে আরও গতি দেয়। ‘আস্তিকের ভোট’ নিবন্ধ মনে করিয়ে দেয় সেই পুরনো দিনের কথাকে। সঙ্গে তুলে আনে একরাশ নস্ট্যালজিয়া। সেই নস্টালজিয়া হাতে-গরম তেলেভাজা নয়, ইতিহাসের রূপক-সংকেত।
আষাঢ়ের মেঘের মতো জমা হয় স্মৃতি। জীবন সরে সরে যায়। ঘড়ির কাঁটার দাপট এড়াতে পারে না কেউ। তার বিপরীতে শুধু, প্রত্যুত্তরে জমতে থাকে স্মৃতির ঝাপটানি। সেই স্মৃতি জমতে জমতে ঝরে পড়ে কখনও কখনও লেখকের কলম থেকে। বৈজয়ন্ত চক্রবর্তীর ‘নির্বাসিত কলম: শূন্য দশকের ভূয়োদর্শন’ তেমনই, বিনি সুতোর মালায় গাঁথা সময়যাপন।
শূন্য দশক, অর্থাৎ, চলতি শতকের প্রারম্ভ। সেই সময়পর্ব কি নিছকই নিস্তরঙ্গময়? নীরব, স্রোতহীন? ইতিহাস অন্য কথা বলে। মার্কিন মুলুকে টুইন টাওয়ারে নাশকতা-হামলা, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ভেঙে পড়া, সে কেবল প্রতীকীদৃশ্য নয়, তা যেন অশনিসংকেত, অস্থির এক ভবিষ্যকালের। সেই আগামী কতটা যুদ্ধস্নাত, রক্তাক্ত এবং ভয়ংকর– তা আজ প্রত্যক্ষ করছে গোটা বিশ্ব। তার আঁচ কি ভারতের গায়ে লাগেনি? অবশ্যই লেগেছে। নতুন শতকের নতুন দশক। সেই পর্দাপণে কাঁটাতারের শৃঙ্খলে জড়ানো এই শস্যশ্যামলা ভারতের গায়ে লেগে কারগিলের বারুদ। সেই ক্ষত তখনও অমলিন। তাকে আরও বিষিয়ে দিতে শূন্য দশক উপহার দেবে গুজরাত গণহত্যার ক্লেদ। প্রশ্ন তুলে দেবে ভারতাত্মার সার্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েই। সময় সাক্ষী, ধ্বংসের যে বীজ সেদিন রোপণ করা হয়েছিল, তা আজ বিষবৃক্ষ হয়ে বিরাজমান। সহস্রাব্দের প্রথম দশকের রোজনামচায় সেসবের ইঙ্গিত লুকিয়ে ছিল। সেই সময়টাকেই দুই মলাটে ধরতে চেয়েছেন লেখক বৈজয়ন্ত, তাঁর সাবলীল গদ্যচলনে, কলমজীবী সত্তায়। কখনও তা নকশাধর্মী, কখনও তা স্মৃতিআলেখ্য হয়ে ধরা দিয়েছে পাঠকের সামনে।
একদিকে বিশ্বায়নের হাওয়া, অন্যদিকে বেদম পিছুটান– এই দুয়ের মাঝে চলতি শতকের প্রথম দশকের সেতু যারা পেরচ্ছেন, সেই যুব-প্রজন্মের কাছে এ বড়ই বিভ্রান্তি কাল। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা থেকে কিছু না-হয়ে উঠতে পারার হাহাকার তাদের কুরে কুরে খায়। সেই মর্মবেদনার প্রতিফলন ঘটেছে ‘নির্বাসিত কলাম’-এ। পাঁচমেশালি এই লেখায় পাঠককে আকৃষ্ট করবে শব্দের-ঝংকার। সেই শব্দ নিয়ে খেলার ছলে লেখক ছুঁয়ে গিয়েছেন বিলেত থেকে বাংলা, শেক্সপিয়র থেকে সিপিআইএম– এমন অনেক চেনা বিষয়। ‘এই লেখাগুলো যখন হচ্ছে, ডিজিটাল মিডিয়া সদ্য টুকি দিয়েছে বঙ্গভাষার মহলে। ইন্টারনেটে বাংলা লেখালেখি শুরু হয়েছে, তবে তার হড়পা বান আসতে বহু বছর দেরি।’ গ্রন্থের ‘নান্দীমুখ’-এ লেখকের এই বক্তব্যে সহজেই অনুমিত, এই ভিন্নধর্মী লেখার সলতে পাকানো কখন থেকে। ‘বিলেত ফেরত’, ‘এটা সেটা এখানে সেখানে’– দুই পর্বে বিন্যস্ত এই বই-তে যেমন বাঙালির বিলেত নামক প্রহেলিকায় হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন লেখক, তেমনই ছুয়ে গিয়েছেন রাজ্য রাজনীতির অবক্ষয়ের দিকগুলো। ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭– সোয়া তিন বছরের এই পরিক্রমা। স্বল্প হলেও তা সমৃদ্ধ।
লেখক এই পরিসরেই নিজ অভিজ্ঞতার বয়ান নির্মাণ করেছেন ভিন্ন রসবোধে। কখনও তা ধরা দিয়েছে ভূতুম নামক চরিত্রের আবডালে। কখনও আবার স্বতন্ত্ররূপে, লেখক-সত্তায়। রাসেল স্কোয়ার থেকে ট্রাফালগার স্কোয়ার– আন্দোলন আর বিপ্লবের আঁতুড় লন্ডন কীভাবে হয়ে ওঠে পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে বড় নারীপাচারের গর্ভগৃহ, সেই বাস্তবের ছবি ‘হুতোম’-এর কায়দায় তুলে ধরার প্রয়াস বেশ স্পষ্ট চোখে পড়ে এ-বইয়ের ইতিউতি। সেই একই অবক্ষয়ের দৌড়ে লন্ডনের চেয়ে যে কলকাতা কোনও অংশে পিছিয়ে নেই, তা মূর্ত হয় ‘দেসের কতা’ নিবন্ধে, বিদ্রুপের মোড়কে।
শতাব্দীর প্রথম দশক পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি, সেই পরিস্থিতির জেরে বামপন্থী ভাবধারার ওপর জনমানসের বিশ্বাস টলে যাওয়া, সেইসঙ্গে দক্ষিণপন্থী, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির পুনর্জাগরণ বাংলাজুড়ে পালাবদলের ইঙ্গিতকে স্পষ্ট করে তোলে। ২০০৮-এ অর্থনৈতিক মন্দা ভঙ্গুর অবস্থাকে আরও গতি দেয়। ‘আস্তিকের ভোট’ নিবন্ধ মনে করিয়ে দেয় সেই পুরনো দিনের কথাকে। সঙ্গে তুলে আনে একরাশ নস্ট্যালজিয়া। সেই নস্টালজিয়া হাতে-গরম তেলেভাজা নয়, ইতিহাসের রূপক-সংকেত। যেমন একইভাবে মননশীল পাঠককে ভাবনার অন্যস্তরে নিয়ে যাবে ‘পুনশ্চ রক্তকরবী’, ‘ইস্তানবুলের ডায়েরি’ নিবন্ধ দু’টি।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….
নাতিদীর্ঘ লেখায় শব্দের মায়াজাল, তা দিয়েই স্বভুঁই ও বিভুঁইকে বাঁধতে চেয়েছেন লেখক বৈজয়ন্ত। সেটাও এমন এক কাল বা সময়ের প্রেক্ষিতে যা লেখক তথা সেই প্রজন্মের কাছে অন্ধত্বের অনুসারী। সব শেষে একটাই প্রশ্ন নিষ্কম্প প্রদীপের মতো বিরাজ করে– শূন্য দশক কি আদৌ শূন্য ছিল? উত্তর খোঁজার দায়ভার পাঠকের জন্যই তোলা থাক।
নির্বাসিত কলাম: শূন্য দশকের ভূয়োদর্শন
বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
রাবণ
৩৫০ টাকা