আফ্রিকার উজ্জ্বল সায়েন্স ফিকশনের বৃত্তে অন্যতম ঝলমলে জ্যোতিষ্ক ল্যরেন ব্যুক্স-এর অন্যতম বিখ্যাত বই– ‘দ্য শাইনিং গার্লস’, সময়যানে চেপে ঘুরে বেড়ানো এক সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে এবং তার এক শিকার যে সারভাইভার হয়ে উল্টে নিজেই হয়ে ওঠে শিকারি। ২০১৩ সালে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় এই উপন্যাসটি প্রকাশিত। পরবর্তীতে ব্রিটেনে ও আমেরিকায় বইটি দ্রুত প্রকাশ পায় ও ব্যুক্সকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক খ্যাতি।
১৪.
‘চড়চড়ে গরমটা ট্যাক্সিটার গায়ে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বন্ধ জানলা আর খড়মড়িয়ে চলা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটাকে পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টায় যেন মরিয়া। চিপা চিপা ফ্ল্যাটবাড়িগুলো দু’দিকে সরে সরে যাচ্ছে। রাস্তাটা টু লেন। মাঝে মাঝে গুদাম ঘরের মতো বিশাল বিশাল মেগা স্টোর চোখে পড়ে পথের একঘেয়েমি কাটিয়ে দিচ্ছে। দেখে পার্ল ভাবল, এ জায়গাটা তো কেপটাউনও হতে পারত! আসলে, এটা পৃথিবীর যে কোনও আরেকটা শহর হতে পারে।’
তৃতীয় বিশ্বকে এইভাবে ধরেন সাংবাদিক, টিভি সিরিজ লেখক এবং ঔপন্যাসিক লরেন ব্যুক্স। একটি মেয়ে, যার দুর্ঘটনায় পা কাটা গিয়েছে, সে প্রযুক্তি সহায়তায় নতুন শরীর পায়। এবং তাকে বিশ্ববাজারে প্রমোট করা হয় সেরা দৌড়বীর হিসেবে। পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত হয় একটি ‘বিশেষ পারদর্শী’দের দৌড়। বস্তুত জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারে, শরীরের খোলনলচে পালটে ফেলা মেয়েদের দৌড়। দেশের ধর্মীয় মৌলবাদীরা শুরু করে প্রতিবাদ-আন্দোলন– ঈশ্বরের নির্দেশের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার বিরুদ্ধে। দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়ে পার্ল নিটসেকো এইভাবে অংশ নেয় দৌড়ে। তার পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়ি নেই। সবটাই যান্ত্রিক বা প্লাস্টিক। তার শরীরে ক্রমাগত ডাক্তার পুশ করে চলে ওষুধ ও হরমোন।
যিনি এই আশ্চর্য ডিসটোপিয়া লিখেছেন, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়ে। জন্ম ১৯৭১ সালে। লিখছেন দীর্ঘ সময় এবং সাফল্যের চূড়ায় অধিষ্ঠান করছেন। ‘মক্সিল্যান্ড ব্যুক্স’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। একটি থ্রিলার। সাইবারপাঙ্ক উপন্যাসটি ভবিষ্যতের কেপ টাউনের প্রেক্ষিতে রচিত। ‘জু সিটি’ও একটি থ্রিলার। ম্যাজিক ও সঙ্গীত শিল্পের ক্ষেত্র, শরণার্থী ইত্যাদির সঙ্গে অপরাধের মিশেলে রচিত এই থ্রিলারটি এক বিকল্প জোহানেসবার্গের সেটিংয়ে লিখিত। সেখানে অপরাধীর শাস্তি হল তাকে জাদু করে একটি চেনা পশুর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। সে পশুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীর মৃত্যু হবে। যার এই শাস্তি হয়, সে ‘অ্যানিমালড’ বা পশ্বায়িত হিসেবে বিবৃত হয়। একটি মেয়ে জিঞ্জি, এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র, এক ড্রাগ অ্যাডিক্ট। অনিচ্ছাকৃত খুনের জন্য স্লথ হিসেবে অ্যানিমালড হয়েছে। সে থাকে একটা বস্তি অঞ্চলে, সে অঞ্চলের নাম ‘জু সিটি’, কারণ গরিব, শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধী এবং গৃহহীনদের বাস।
আফ্রিকার উজ্জ্বল সায়েন্স ফিকশনের বৃত্তে অন্যতম ঝলমলে জ্যোতিষ্ক ল্যরেন ব্যুক্স-এর অন্যতম বিখ্যাত বই– ‘দ্য শাইনিং গার্লস’, সময়যানে চেপে ঘুরে বেড়ানো এক সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে এবং তার এক শিকার যে সারভাইভার হয়ে উল্টে নিজেই হয়ে ওঠে শিকারি। ২০১৩ সালে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় এই উপন্যাসটি প্রকাশিত। পরবর্তীতে ব্রিটেনে ও আমেরিকায় বইটি দ্রুত প্রকাশ পায় ও ব্যুক্সকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক খ্যাতি। ‘দ্য স্ট্র্যান্ড’ ম্যাগাজিন এই উপন্যাসটিকে ক্রিটিক্স বেস্ট নভেল অ্যাওয়ার্ড দেয়। আরও বেশ কিছু পুরস্কার আসে। যেমন ‘এক্সক্লুসিভ বুক্স রিডার্স চয়েস অ্যাওয়ার্ড’ ও দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সাহিত্য পুরস্কার– জোহানেসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার।
এ বই ২০১১-তে ‘আর্থার সি ক্লার্ক’ পুরস্কার পায়। এছাড়াও ফ্রান্সের ‘গ্রঁ প্রি দ্য লিমাজিন’-এর নামের পুরস্কারের জন্য শর্ট লিস্টেড হয় বিদেশি উপন্যাসের ক্যাটেগরিতে।
নন ফিকশনের মধ্যে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার অতীতের নানা অসামান্য মহিলাদের নিয়ে একটি বই লিখেও ২০০৬-এর ‘সান্ডে টাইমস অ্যালান প্যাটন’ পুরস্কারের জন্য লংলিস্টেড হয়েছিলেন।
২০১৪-তে ব্যুক্স ‘ব্রোকেন মনস্টার্স’ নামে একটি নতুন উপন্যাস লেখেন। ছোট নিবন্ধ ও গল্প সংগ্রহ ‘স্লিপিং’ বের হয় ২০১৬-তে।
টিভিতেও ব্যুক্স নানা নতুন কাজ করেছেন। অ্যানিমেশন টিভি সিরিজ লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ডকুমেন্টারি ছবি। এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের ওপরে এই ছবিও এনেছে পুরস্কার।
‘স্লিপিং’ নামের প্রথমেই উল্লিখিত গল্পের এই জায়গাটা পড়া যাক–
‘‘ ‘তুমি প্রস্তুত?’ ভেনেজুয়েলা থেকে আসা ডক্টর আর্তুরো জিজ্ঞাসা করেন, বিশেষ করে ওর জন্য আনা হয়েছে ওকে। ওর হাতদু’টি খুব নরম, যত্নে ভরা। চোখ দুটো দয়ালু। পার্ল ভাবে। যদিও ওরই ওপর দায়িত্ব পড়েছে পার্লের ভেতর থেকে সবকিছু কেটেকুটে বের করে এনে ফাঁকা করে দেওয়ার। এক্সেস ব্যাগেজ। অতিরিক্ত জিনিসের ভার। ডাক্তার বলে। যে জায়গা থেকে সবকিছু খুলে বের করে আনা হল, সেখানে ব্যথা করে ওর। ওর নারীসুলভ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ওর পাকস্থলী অন্ত্র সব বেরিয়ে গেছে। নাড়িভুঁড়ি সব পরিষ্কার।
ডাক্তার ওকে বলে, ওরা ওর মতো একজনকেই অনেক দিন ধরে খুঁজছিল। সে আর তমিস্লাভ মিলে। ওরা ভাবেইনি শেষ অবধি ওর মতো কাউকে পাওয়া যাবে। আর এখন! দেখো এখন কে এসে আবির্ভূত! পার্ল খুব ভাগ্যবতী। পার্ল তো জানে সে খুব ভাগ্যবতী! কারণ সবাই ওকে এটা সেই থেকে বলেই চলেছে নাগাড়ে।
ডাক্তার আর্তুরো ওকে লিফটের কাছে নিয়ে যায়। তমিস্লাভ অপেক্ষা করছে। সার্জন খুব বিনয়ী। ক্যামেরার সামনে উনি অস্বচ্ছন্দ। ‘ভয় পেয়ো না, আমি তোমার সঙ্গেই থাকব।’
বলে ওর কানের কাছে গালে দু’বার টোকা দেয় সে।
‘সবটাই তোকে ঘিরে, খুকি!’ তমিস্লাভ বলে।”
একেবারে শেষে, দৌড়ের মাঠে কী ঘটে?
“ ‘ওঠো!’ ডাক্তার আর্তুরো বলল। ‘উঠতেই হবে। আমি অ্যাড্রিনালিন অ্যাক্টিভেট করছি। বেদনা কমানোর ওষুধও দিচ্ছি।’ পার্ল উঠে বসে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, কষ্ট হচ্ছে। ওর গায়ের জামাটা ভিজে গেছে। একটা ধূসর হাড় ওর বুকের তলার চামড়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে উঁচু হয়ে। শার্লট এক্সো স্যুটের তালটা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগুচ্ছে। পা তার ল্যাংচাচ্ছে। স্যুটের গিয়ারের গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে।
আর্তুরো বলে, ‘এগুলোই ওরা দেখতে চায়। ভেঙেচুরে দ হয়ে যাওয়া। তোমাকে দেখিয়ে দিতে হবে তুমি শুধুই হাইড্রলিক্স-এ চলো না।’
‘না চলি না।’ ও জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে বিষম খায়। গলা থেকে ঘড়ঘড় শব্দ আসে। ও যেন একটা বাথটবের জলের ভেতরে নেমে স্নরকেল দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। জল আটকে গেছে ইউ বেন্ড পাইপে।
কীট ড্রোনেরা ওর চারিদিকে ঘুরতে থাকে। ভোঁ ভোঁ। ও দেখতে পায় ওর মুখটা স্ক্রিনে দেখাচ্ছে বিশাল করে। ওর মা বাড়িতে বসে দেখছে ওকে। গোটা গ্রাম, গোটা কমিউনিটি হল দেখছে।
‘তাহলে প্রমাণ করো। এখানে কেন তুমি এসেছ? পার্ল? তোমার জেতার পিছনে অন্য রহস্য আছে। তোমার আগুন আছে।’
ও প্রথমে হাঁটতে শুরু করে, তারপর হালকা দৌড়য়। বুক থেকে বেরিয়ে আসা পাঁজরের হাড়টাকে ধরে থাকে ও যাতে ঝাঁকুনি না লাগে। প্রতিটি পদক্ষেপে ওর শরীরের ভেতর ব্যথার স্রোত বয়। ও বুঝতে পারে ওর ভেতরের যন্তরমন্তরটা পিছলে নামছে। সরে যাচ্ছে যেখানে যা থাকার কথা সেখান থেকে। ওর স্ট্রাকচারাল ইনটিগ্রিটি নষ্ট হয়ে গেছে। ওর পেটের জালিকা, মেশ ছিঁড়ে গেছে, যেখানে ওর পাকস্থলী থাকার কথা সেখানে থেকে নেমে অন্যত্র ছিটকে গেছে। একটা অন্ধকার গহ্বর এখন ওর ভেতরে। সবকিছুকে টেনে সেই গহ্বরে ফেলতে চাইছে। ওর হৃৎযন্ত্র সেইদিকে পিছলে নামছে।”
এই লড়াইতে পার্ল জিতবে কি না জানতে গল্পটি পড়তে হবে। অনুবাদে এ গল্প সংকলিত হয়েছে সাম্প্রতিক আফ্রিকার সাই-ফাইয়ের একটি সংকলনে।
(চলবে)
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই