একমাত্র বোধিসত্ত্ব সব প্রলোভন জয় করে সাত দিনের মাথায় তক্ষশিলা পৌঁছলেন। প্রধানা যক্ষিণী মরিয়া হয়ে তাঁর পিছু পিছু নগরে এসে হাজির হল। বোধিসত্ত্ব যে পান্থশালায় উঠলেন, তার সামনে সে চুল এলিয়ে বসে রইল। লোকেরা বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞেস করল, তোমার স্ত্রীর ওপর কি অভিমান করে আছ?
১৬.
এই কাহিনির প্রচলিত নাম ‘তৈলপাত্র জাতক’। অথচ তৈলপাত্র তো দূরস্থান, এই গল্পের কোথাও একফোঁটা তেলেরও উল্লেখ নেই।
তাহলে কেন এমন নাম, সে কথা বুঝতে জাতক-এ ‘প্রত্যুৎপন্নবস্তু’ (বর্তমান কথা) নামে যে পর্ব, সে বিষয়ে জানতে হবে। গৌতম বুদ্ধ কী প্রসঙ্গে আখ্যায়িকাটি বলেছেন, সেই সূত্রটি ধরিয়ে দেওয়াই এই অংশের উদ্দেশ্য।
এই কাহিনিতে তিনি তাঁর শিষ্যদের অন্যমনা না হয়ে উদ্দেশ্য বা গন্তব্য সম্পর্কে স্থিরলক্ষ্য হতে বলছেন। উদাহরণ হিসেবে এক পরিস্থিতির কথা বলছেন: একজনকে বলা হয়েছে কানায় কানায় ভর্তি একবাটি তেল নিয়ে তোমাকে নানা মানুষের কোলাহলপূর্ণ এক বসতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তোমার পিছন পিছন যাবে উদ্যত তলোয়ার হাতে একজন। বাটি থেকে একটু তেলও যদি মাটিতে পড়ে, পিছনের লোকটি তোমায় দ্বিখণ্ডিত করবে। এই কাল্পনিক পরিস্থিতির কথা বলে গৌতম বুদ্ধ বলছেন, প্রকৃত চরিত্রবানের কিন্তু পিছনে এমন তলোয়ারের আতঙ্ক রাখার দরকার হয় না, সব সময়েই তাঁরা তাঁদের কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ, এবং চারপাশে মন বিক্ষিপ্ত করার যাবতীয় আয়োজনকে তাঁরা অনায়াস উপেক্ষায় পেরিয়ে যেতে পারেন।
পড়ুন নব জাতক-এর আগের পর্ব: নেপথ্য থেকে যে নেতৃত্ব দেয়, তাকে অস্বীকার করা যায় না
এই প্রসঙ্গে এরপর পরিবেশন করা হচ্ছে মূল গল্পটি, যাকে বলে ‘অতীতবস্তু’। নামের কারণটি স্পষ্ট, এখানে গৌতম বুদ্ধের অতীত জন্মের কথা বলা হচ্ছে। আর সে গল্পের শেষে থাকে ‘সমবধান’। এখানে বর্তমানে উপস্থিত কয়েকজন ব্যক্তি অতীতের আখ্যানটির কালে কে কী হিসেবে জন্মেছিলেন, তা বলা হয়।
যেমন এই ‘তৈলপাত্র জাতক’-এর শেষে বলা হয়েছে, তক্ষশিলারাজের অমাত্যরা একালে গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন শিষ্য হিসেবে জন্মেছেন, আর বোধিসত্ত্ব স্বয়ং সেবার জন্মেছিলেন বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তের শতপুত্রের কনিষ্ঠতম হিসেবে।
সেই কালে তিনি একবার একদল প্রত্যেকবুদ্ধকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ কী। ‘প্রত্যেকবুদ্ধ’ তপস্যার জোরে নির্বাণলাভের যোগ্য, কিন্তু জনসাধারণের সঙ্গে তাঁরা খুব একটা যোগাযোগ রাখেন না। তাঁরা সস্নেহে বোধিসত্ত্বকে বললেন, হে কুমার, রাজা হওয়ার সব গুণই তোমার রয়েছে। কিন্তু তোমার ওপরে ৯৯ জন অগ্রজ, উত্তরাধিকার সূত্রে বারাণসীর রাজা হওয়ার সুযোগ তুমি কখনও পাবে না।
তাহলে?
এখান থেকে দুই সহস্র যোজন দূরে তক্ষশিলা। সেখানে এক সপ্তাহের মধ্যে যদি তুমি পৌঁছতে পারো, তাহলে তুমিই সেখানের রাজা হবে।
এক সপ্তাহের মধ্যে?
হ্যাঁ, তেমনই যোগ দেখছি। কিন্তু এত কম সময়ের মধ্যে সেখানে যেতে গেলে মূল সড়ক ছেড়ে তোমায় যেতে হবে বিপজ্জনক অরণ্যের পথ ধরে।
হিংস্র জন্তু-জানোয়ারে ভয় নেই আমার।
না, তার চেয়েও বড় বিপদ সেখানে। যক্ষ্মিণীরা সেখানে মোহের জাল পেতে রাখে। পুরুষ পথিক ইন্দ্রিয়পরবশ হলেই যক্ষ্মিণীরা তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। তারপর তার রক্ত চুষে খুন করে।
সচেতন থাকব নিশ্চয়ই, জোড়হাতে বোধিসত্ত্ব বললেন।
বারবার বারণ করা সত্ত্বেও পাঁচ অনুচর তাঁর সঙ্গী হলেন। তাঁরা এক একজন এক এক ইন্দ্রিয়ে আসক্ত। একজন যক্ষিণীর মায়ারূপ দর্শন করে মুগ্ধ হল। বোধিসত্ত্ব তাকে বললেন, তুমি পেছিয়ে পড়ছ কেন?
সে বললে, পায়ে বড় ব্যথা। একটু বিশ্রাম নিয়ে যাই।
বোধিসত্ত্ব মৃদু হেসে এগিয়ে চললেন।
পরের সঙ্গীরা কেউ মধুর সংগীত শ্রবণ করে, কেউ সুমধুর গন্ধ শুঁকে, বা সুখাদ্যের স্বাদ পেয়ে, অথবা কোমল ত্বকের স্পর্শসুখে যক্ষিণীদের ফাঁদে পড়ল এবং প্রাণ হারাল। বোঝা গেল, চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক সকল ইন্দ্রিয়ের ফাঁদ পাততেই যক্ষ্মিণীরা সিদ্ধহস্ত।
একমাত্র বোধিসত্ত্ব সব প্রলোভন জয় করে সাত দিনের মাথায় তক্ষশিলা পৌঁছলেন। প্রধানা যক্ষিণী মরিয়া হয়ে তাঁর পিছু পিছু নগরে এসে হাজির হল। বোধিসত্ত্ব যে পান্থশালায় উঠলেন, তার সামনে সে চুল এলিয়ে বসে রইল। লোকেরা বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞেস করল, তোমার স্ত্রীর ওপর কি অভিমান করে আছ?
আমার স্ত্রী কেন হতে যাবে? ও যক্ষ্মিণী। আমার পাঁচ বন্ধুকে খেয়েছে।
কপট অভিমানে কপাল চাপড়ে যক্ষ্মিণী বলে, হায় রে, ক্রোধের বশে পুরুষমানুষ কী না বলে!
যাতায়াতের পথে সবারই নজর পড়ছিল অপরূপ সুন্দরী যক্ষ্মিণীর ওপর। তার মধ্যে সবার চেয়ে বেশি নজর পড়ল স্বয়ং মহারাজের। তক্ষশিলারাজ তাকে ডেকে নিলেন অন্দরে। রাজমহিষী করবেন স্থির করলেন।
পরদিন ভোরে তাঁর শয়নকক্ষের দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে দেখে উদ্বিগ্ন রক্ষীরা দরজা ভেঙে দেখে মহারাজের প্রাণহীন, রক্তশূণ্য দেহ পালঙ্কে শোয়ানো। সেই সুন্দরীর চিহ্নমাত্র নেই।
তক্ষশীলার মন্ত্রী-অমাত্যরা বুঝলেন, নগরের সেই সৌম্যকান্তি আগন্তুকের কথাই তাহলে ঠিক। ইন্দ্রিয়াসক্তিতে আমাদের রাজা নিজেও মরলেন, গোটা রাজ্যকেও বিপদের মধ্যে ফেললেন। অথচ সেই ব্যক্তিকে শত ইন্দ্রিয়জ প্রলোভনেও যক্ষিণী বশ করতে পারেনি। এমন ব্যক্তিই আমাদের সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবেন।
পান্থশালায় গিয়ে তাঁরা বোধিসত্ত্বকে সসম্মানে আহ্বাণ করলেন, হে দেব, আপনি আমাদের রাজা হন।
সূত্র: তৈলপাত্র জাতক
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved