কে ঠিক, কে ভুল, ইজরায়েল না প্যালেস্তাইন–ভাবারই দরকার নেই। আলোচ্য তো সেটা নয়। আসল হল, ইউরোপ-আমেরিকার চির-অচ্ছুৎ এক খেলার মহারথীকে জড়িয়ে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। এক ঐতিহ্যশালী মাঠকে সহায়-সম্বল করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা। বিরাট কোহলি বহুল প্রচারিত বলেই না তাঁকে আমেদাবাদের মাঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন চিনে বাবা ও ফিলিপিনো মায়ের সন্তান। ক্রিকেটের সঙ্গে দূর-দূরান্তে যে দুই দেশের কোনও সম্পর্ক নেই।
স্মৃতি মিরজাফরসুলভ আচরণ না করলে একটা গ্রুপ ছবি সবার মনে থাকা উচিত। বিশেষত, ফুটবল ছাত্রদের। এ ছবি, এক বছর আগের, এক ফুটবল বিশ্বকাপের ছবি। এ ছবি হাত দিয়ে মুখ ঢাকা সার-সার প্লেয়ারের ছবি।
ম্যানুয়েল ন্যয়ারের জার্মানির ছবি!
কাতার বিশ্বকাপকে বাঙালির সহজে ভোলার কথা নয়। চাইলেও পারবে না। ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার শাপমুক্তি হয়েছিল যে বিশ্বকাপে, যা শেষে বিশ্বসেরার ‘শিরস্ত্রাণ’ সেঁটে বসেছিল লিওনেল মেসির মাথায়, পৃথিবীর এক পাক সূর্য প্রদক্ষিণের মধ্যে তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না কি? কিন্তু মেসির নীল-সাদা দেশের কবিতা নয়। কিংবা আরাধ্য ট্রফিতে কালো জোব্বা পরে স্বয়ং ফুটবলের বরপুত্রের স্নেহ-চুম্বনের দৃশ্যও নয়। মানবসমাজের প্রয়োজন ও গুরুত্ব বিচারে কাতার বিশ্বকাপের সবচেয়ে অলৌকিক ছবিটা উপহার দিয়ে যান ন্যয়ার ও তাঁর জার্মানি। মানবাধিকারের সমর্থনে, ফিফার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, খেলার বেদিতে মানবপ্রজাতিকে জিতিয়ে, হাত দিয়ে মুখ ঢেকে! মানবাধিকারের সমর্থনে ‘ওয়ান লাভ’ ব্যান্ড পরে নামতে যাওয়া সাত-সাতটা দেশকে শাস্তির নিদান শুনিয়েছিল ফিফা। হুমকি দিয়েছিল, সামান্য বেচাল দেখলে পাল্টা দেখে নেবে! শেষে টলে গিয়েছিল বাকিরা, টলানো যায়নি শুধু ‘মানশাফট’-দের। নাহ্, কাতার বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডও টপকাতে পারেনি জার্মানি। বোধনেই তাদের বিশ্বকাপ বিসর্জন সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রভাবে? ‘ওয়ান লাভ’ ব্যান্ড পরতে না পারার প্রতিবাদে যে প্রতিবাদী ছবি তারা বিশ্বমঞ্চে পেশ করেছিল, তার ব্যাপ্তি যে লিও মেসির বিশ্বজয়ের চেয়ে কয়েক যোজন বেশি! ফুটবলের সর্বশক্তিমান ফিফা পর্যন্ত টুঁ শব্দ করার আর সাহস পায়নি!
আরও খেলাইডোস্কোপ: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
তবু খেলাটা ফুটবল, প্রেক্ষাপট ফুটবল বিশ্বকাপ। যার শিরা-উপশিরায় বরাবর মিশে থাকে বিশ্ব রাজনীতি। ধমনি বেয়ে যা অবিরাম চলাচল করে, বিশ্বকাপের এক মাস ধরে, বিবিধ বহিঃপ্রকাশে। কখনও তার আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হয় ফুটবলার, কখনও বা ফুটবল সমর্থক। কেন, ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে সুইৎজারল্যান্ড বনাম সার্বিয়া ম্যাচ মনে নেই? মনে নেই, সে ম্যাচে গোলে করে কসোভো-জাত দুই সুইস ফুটবলার জারদান শাকিরি ও জাকা-র ‘ডাবল ঈগল’ উৎসব? যাঁদের দু’জোড়া হাতের মুদ্রা রাশিয়া বিশ্বকাপে তীব্র রাজনৈতিক চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছিল। ‘ডাবল ঈগল’ আদতে আলবিনীয় জাত্যভিমানের প্রতীক। কসোভোর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-ইতিহাসের সঙ্গে যার যোগসূত্র রয়েছে। কসোভো যুদ্ধ লড়া হয়েছিল যে যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে, সে দেশের বর্তমান নামই তো সার্বিয়া! সে ঠিক আছে, বেশ বোঝা গেল। কিন্তু ফুটবল যা পারে, তা আবার ক্রিকেট পারে নাকি? পারে নাকি সে তার বিশ্বকাপের রাজসূয়-যজ্ঞে বিশ্ব রাজনীতির বার্তা দিতে?
পারত না এত দিন। এখন দিব্য পারে!
পারে যে, তার সবচেয়ে জ্যান্ত প্রমাণ সদ্যসমাপ্ত ক্রিকেট বিশ্বকাপ। আমেদাবাদে গত মাসে যার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া জিতল, ভারত হারল। ভারতে ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপে রাজনীতির বোঁটকা গন্ধ কম খোঁজেননি কূট অনুসন্ধিৎসুরা। ভারত কোন ‘দেবমন্ত্রে’ দশে দশ করে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলল, কী করে রোহিত শর্মাদের সামনে গ্রুপ পর্বে নতজানু হল অস্ট্রেলিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়াংখেড়ের সেমিফাইনাল পিচ সত্যি বদলে দেওয়া হয়েছিল কি না, ফাইনাল হারের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় ড্রেসিংরুমে মহম্মদ সামিকে বুকে কেন চেপে ধরলেন– খুঁতখুঁতে রাজনীতির অনুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় মাপজোক করা দেখা হয়েছে সব কিছুকে। কিন্তু আসলটা দেখেও দেখেনি লোকে। যখন ঘটেছে, দেখেছে। পরে ভুলে গিয়েছে।
বিশ্বকাপ ফাইনালের আমেদাবাদ যেমন। পাকিস্তান-বাংলাদেশের ইডেন যেমন।
আরও খেলাইডোস্কোপ: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
ভাবা যায়, নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাপ ফাইনালের মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন এক অস্ট্রেলিয়া নিবাসী যুবক, ব্যাট করার সময় বিরাট কোহলিকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, গায়ে ‘স্টপ বম্বিং প্যালেস্তাইন’ লেখা টি শার্ট পরে! পরে পুলিশি ধরপাকড়, থানায় নিয়ে গিয়ে উত্তম-মধ্যম– সবই হয়েছে। কিন্তু প্যালেস্তাইন পতাকার মাস্ক পরা যুবক ও তাঁর বার্তা ভোলা যায়নি। ইডেনেও তো। পাকিস্তান-বাংলাদেশ ম্যাচে ‘জি ওয়ান’ ব্লকের টঙে চড়ে চার যুবক প্রায় একই কাজ করেন, সোজা উড়িয়ে দেন প্যালেস্তাইন পতাকা! পুলিশ জানতে পেরে ধাওয়া করে। পরে হেফাজতে নেয়। আজ পর্যন্ত তেরোটা ওয়ান ডে বিশ্বকাপ দেখেছে ক্রিকেট পৃথিবী। কিন্তু ইন্ডিয়া ‘টোয়েন্টি টোয়েন্টিথ্রি’-র আগে এমন রাজনৈতিক বিশ্বকাপ ক্রিকেট কখনও দেখেছি কি?
আমেদাবাদ বিপর্যয়ের এক মাস পর রোহিত-বিরাট কোহলির কথা ভেবে দুঃখ লাগে যেমন, ক্রিকেটের কথা সার্বিক ভাবলে আবার ভালও লাগে। পৃথিবীর খেলাধুলোর ময়দানে ফুটবল আর ক্রিকেটের জায়গা ছিল চিরাচরিত সুয়োরানি ও দুয়োরানির। এশিয়া এবং ইউরোপ-আফ্রিকার কতিপয় দল বাদ দিলে, ক্রিকেট খায় না মাথায় দেয়, আজও অনেকে জানে না। নাক সিঁটকে এখনও বলা হয়, দশটা দেশ সাকুল্যে খেলে, তার আবার বিশ্বকাপ, ছোঃ! তা সেই উপেক্ষার বিশ্বকাপে যদি এক ভিনদেশি যুবক এসে কোহলিকে জড়িয়ে ধরেন রাজনীতির বার্তা সহ, মন্দ লাগে কি? কে ঠিক, কে ভুল, ইজরায়েল না প্যালেস্তাইন–ভাবারই দরকার নেই। আলোচ্য তো সেটা নয়। আসল হল, ইউরোপ-আমেরিকার চির-অচ্ছুৎ এক খেলার মহারথীকে জড়িয়ে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। এক ঐতিহ্যশালী মাঠকে সহায়-সম্বল করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা। বিরাট কোহলি বহুল প্রচারিত বলেই না তাঁকে আমেদাবাদের মাঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন চিনে বাবা ও ফিলিপিনো মায়ের সন্তান। ক্রিকেটের সঙ্গে দূর-দূরান্তে যে দুই দেশের কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু ক্রিকেটের বাইরের দুনিয়ায়ও এখন জানে, বিশ্বব্যাপী বার্তা প্রচারের কাজে কোহলিকে জড়িয়ে ফেলতে পারলে সে খবর সুমেরু পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে! ভীমবেগে যাবে! যাবে, কোনও এক ইডেন গার্ডেন্সকে প্রতিবাদের মঞ্চ করলেও।
আর তাই ভাল লাগছে, আজ বড় ভাল লাগছে রে তোপসে। খেলাটা অ্যাদ্দিন পর জাতে উঠল!