কল্পবিজ্ঞানের এই মূলগত বৈশিষ্ট্য মেনে, গিলম্যান এখানে প্রকল্পটা এইভাবে সাজাচ্ছেন যে, পুরুষের ওপর নারীরা বংশবিস্তারের জন্য নির্ভরশীল নয়। পুরুষ ছাড়াই সন্তান ধারণ করে এ মেয়েরা– পার্থেনোজেনেসিস, অযৌন প্রজননের একটি রূপের সহায়তায়। ফলে একটি আদর্শ সামাজিক ব্যবস্থা: যুদ্ধ, সংঘাত এবং আধিপত্য মুক্ত।
৬.
পল কিনকেইড বলেছিলেন, কল্পবিজ্ঞানের সংজ্ঞানির্ধারণের অসুবিধে নিয়ে, যা বাংলায় তরজমা করলে খানিকটা এইরকম দাঁড়ায়:
কল্পবিজ্ঞান কোনও একটাই মাত্র জিনিস নয়। বরং, এ হল অনেকগুলো সম্ভাব্য বস্তুর সমাহার– ভবিষ্যতের একটা সেটিং, একটি উদ্ভট অনাবিষ্কৃত যন্ত্র বা উপকরণ, একটি আদর্শ সমাজ, একটি এলিয়েন প্রাণী, সময়ের একটি মোড়, একটি গল্পের মোচড়, একটি আন্তঃনাক্ষত্রিক যাত্রা, একটি ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, গল্পের বিষয়ে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে আমরা এসবই খুঁজি, যদিও সব একসঙ্গে না পেতেও পারি। আমরা যখন কল্পবিজ্ঞানকাহিনির সন্ধান করি, তখন এসবই খুঁজি। কোথাও একটা লক্ষণ স্পষ্ট, তো কোথাও অন্যটা। যা একত্রিত হয়ে একটা বিনুনির মতো হয়ে যায়। শেষ হয় এক অন্তহীন পারমুটেশন কম্বিনেশনে। (On the Origin of Genre, Paul Kincaid, 2003 essay)
ভাবলেই বোঝা যাবে, উদ্ভট অনাবিষ্কৃত যন্ত্রের ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। প্রথম যুগের গল্পে মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে যেমন গোটা একটা ল্যাবরেটরি, তেমনই এইচ. জি. ওয়েলসের টাইম মেশিন, বা জুল ভের্নের লেখা সমুদ্রগহবরে চলার যানবাহন– সবই যন্ত্র-সাপেক্ষ কাহিনি। আর এ জন্যই অনেকে মনে করেন, কল্পবিজ্ঞান বিজ্ঞানপ্রতিভায় ক্ষমতাবানদেরই লেখার কথা। তাঁরা দেখতে পান, যে জাতি যত বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে পিছিয়ে, সে জাতি কল্পবিজ্ঞান চর্চা করে না। কাজেই, উঠন্তি পত্তনের মুলোর মতো, শিল্প বিপ্লবের সময়ে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের মধ্যে কল্পবিজ্ঞানের চল হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফনফনিয়ে ওঠে মার্কিন ও সোভিয়েত কল্পবিজ্ঞান, ঠান্ডা লড়াইকালে। আর সম্প্রতি জাপান চিনের আধিপত্য চিনিয়ে দেয় কারা জোরের সঙ্গে উঠে আসছে। নারীরা যতদিন না বিজ্ঞান প্রযুক্তির পাঠ সম্পন্ন করে দলে দলে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছেন, ততদিন তাই মার্কিন কল্পবিজ্ঞানেও নারী লেখক খুবই হাতে গোনা হবে, জানাই কথা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এখন আমরা পিছিয়ে যাই আবার ১৯০০ সালের আশপাশে। বেগম রোকেয়া ১৯০৫ সালে লিখেছিলেন ‘‘সুলতানা’জ ড্রিম’’। কিন্তু, ১৯১৫ সালের ‘হারল্যান্ড’ কোনও বিজ্ঞাননির্ভর লেখা ছিল না। কিন্তু স্পেকুলেটিভ ফিকশন অবশ্যই ছিল। কী হলে কী হতে পারত বা যদি এমন হত-র নিয়ম মেনেই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
অথচ ইদানীং আমরা হাতে পেয়েছি অসামান্য সব আফ্রিকান কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, যেখানে একটি প্রযুক্তিকে ঠেকনো হিসেবে খাড়া করলেও অনেকটা মানবিকতা, জটিল রাজনীতি সমাজনীতির কথা অনায়াসে আসে। আমাদের এ লেখাটি যেহেতু কিছুটা ঐতিহাসিক সময়রেখা মেনে চলছে, সামান্য আগুপিছু থাকলেও কিছুটা কালানুক্রমিক ভাবে আমরা উপস্থাপিত করতে চাইছি মেয়েদের কল্পবিজ্ঞান লেখালেখিকে, সুতরাং, আফ্রো কল্পবিজ্ঞানের কথায় পরে আসছি।
যেমন এখন আমরা পিছিয়ে যাই আবার ১৯০০ সালের আশপাশে। বেগম রোকেয়া ১৯০৫ সালে লিখেছিলেন ‘‘সুলতানা’জ ড্রিম’’। কিন্তু, ১৯১৫ সালের ‘হারল্যান্ড’ কোনও বিজ্ঞাননির্ভর লেখা ছিল না। কিন্তু স্পেকুলেটিভ ফিকশন অবশ্যই ছিল। কী হলে কী হতে পারত বা যদি এমন হত-র নিয়ম মেনেই।
গল্পটির প্লটখানি এইরকম। একটা অভিযানে শামিল হয় তিন পুরুষ। গল্প বলা হচ্ছে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র ভ্যানডিক ‘ভ্যান’ জেনিংসের দৃষ্টিকোণ থেকে। দুই বন্ধু, টেরি ও নিকলসন এবং জেফ মার্গ্রেভের সঙ্গে একটি অজানা এলাকা অন্বেষণ করার জন্য রওনা দেয়। গুজব শোনা গেছে, নারীরাই সেখানে একটা গোটা সমাজ। পুরুষহীন সমাজ। তিন বন্ধু এই গুজবকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না, কারণ তারা পুরুষদের ছাড়া কীভাবে মানুষের প্রজনন ঘটতে পারে, তা ভাবতেই পারে না। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– তা নিয়ে পুরুষেরা অনুমানমাত্র করতে পারে। প্রত্যেকেই তার নিজস্ব ভাবনায় নারীদের স্টিরিওটাইপের ওপর ভিত্তি করে ভিন্নভাবে অনুমান করে। একজন ভাবে প্রেমের বিষয় হিসেবে, দ্বিতীয়জন ভোগ্যা হিসেবে, জয় করে নিয়ে আসা ট্রফি হিসেবে, আর তৃতীয়জন পরিত্রাতা হিসাবে– তাই তারা মেয়েদের ‘সাহায্য ও উদ্ধার’ করতে চায়।
অভিযাত্রীরা তাদের গন্তব্যে পৌঁছায়। জঙ্গলে নিজেদের লুকিয়ে রেখে নজরদারি করার চেষ্টা করে। শেষমেশ তারা তিনজন তরুণীকে খুঁজে পায়। ছলচাতুরি করে মেয়েদের ধরার চেষ্টা করার পর, পুরুষরা শেষ পর্যন্ত যুবতীদের তাড়া করে শহর বা গ্রামের দিকে। মহিলারা সহজেই তাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়, নিজেদের অসম্ভব সুদৃশ্য-সুগঠিত বাসভবনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। এতক্ষণে ভ্যান এ জায়গাটার নাম দিয়ে দিয়েছে ‘হারল্যান্ড’।
তারপর আর কী? শক্তিশালী নির্ভীক নারীদের দ্বারা তিন পুরুষের বন্দিদশা, তাদের অজ্ঞান করে নিজেদের জেলখানায় রেখে দেওয়া, ভিন ভাষার যুবকদের ভাষা জানতে চাওয়া হারল্যান্ড নিবাসিনীদের। অত্যাচার করা হয় না এ জেলখানায়, বন্দিদের পরিচ্ছন্ন পোশাক, খাদ্যবস্তু দেওয়া হয়।
ভ্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণিত হয় মহিলা পরিচালিত এক ইউটোপিয়ার।
এই কাহিনির লেখক, মার্কিন নারীবাদী শার্লট পারকিন্স গিলম্যান। এই বইয়ের চোখ হল, মেয়েরা একটি আদর্শ সমাজ গঠন করার জন্য কী কৌশল গ্রহণ করছে? বিজ্ঞানের বীজ, কল্পনার বিস্তার।
কল্পবিজ্ঞানের এই মূলগত বৈশিষ্ট্য মেনে, গিলম্যান এখানে প্রকল্পটা এইভাবে সাজাচ্ছেন যে, পুরুষের ওপর নারীরা বংশবিস্তারের জন্য নির্ভরশীল নয়। পুরুষ ছাড়াই সন্তান ধারণ করে এ মেয়েরা– পার্থেনোজেনেসিস, অযৌন প্রজননের একটি রূপের সহায়তায়। ফলে একটি আদর্শ সামাজিক ব্যবস্থা: যুদ্ধ, সংঘাত এবং আধিপত্য মুক্ত। ১৯১৫ সালে ‘হারল্যান্ড’ প্রতিমাসে কিস্তিতে কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল, গিলম্যান দ্বারা সম্পাদিত এবং লিখিত একটি ম্যাগাজিন– ‘দ্য ফোররানার’-এ।
এই বইটির পরের পর্ব ‘উইথ হার ইন আওয়ারল্যান্ড’ ১৯১৬ থেকে প্রকাশ পায়। বইটিকে প্রায়শই তাঁর ইউটোপিয়ান ট্রিলজির মধ্যম ভলিউম হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এর আগে ‘মুভিং দ্য মাউন্টেন’ (১৯১১)। যদিও ‘হারল্যান্ড’ ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বই আকারে প্রকাশিত হয়নি।
কীভাবে পুরুষহীন হল এই নারীবিশ্ব? গিলম্যান তার পশ্চাৎপট রচনা করেছেন যত্নের সঙ্গে। বলা হয়েছে এক কল্পিত ইতিহাস, দু’হাজার বছর আগে এক অগ্ন্যুৎপাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ওই দেশের পুরুষেরা। যারা বেঁচেছিল, তারা ছিল নিষ্ঠুর ও অসৎ, তাই মেয়েরা একজোট হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়ে, পুরুষমুক্ত করে সে দেশকে। কাহিনির শেষদিকে তিন অভিযাত্রিকের বন্দিশালা ভেঙে পালানোর চেষ্টা, এবং আবার ধরা পড়া ‘হারল্যান্ড’-এর কর্ত্রীদের হাতে। অতঃপর দেখানো হয়, তাদের তিন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক। যে সম্পর্কের পদে পদে বাধা, কারণ মেয়েরা তাদের মতে সঠিক মেয়ে নয়। মানে, যাকে বলে ম্যারেজ মেটিরিয়াল নয়। ‘বিয়ে’ নামক প্রতিষ্ঠান ও পুরুষ সংসর্গ ২০০০ বছর ধরে তারা করেনি, তাই রোমান্টিক প্রেম বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ কোনওটাই তাদের ডিএনএ-তে তারা বহন করছে না। দেখানো হয়েছে পুরুষ মনের প্রতিক্রিয়া, প্রত্যাশা এবং প্রত্যাশা পূর্ণ না হওয়াও। শেষমেশ, ভ্যান শেষ পর্যন্ত এলাডোরের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’-এর জন্য কৃতজ্ঞ হয়। টেরি উল্টোদিকে তার স্ত্রী-কে ধর্ষণ করে। ফলে তাকে দাঁড়াতে হয় বিচারসভায়, যেখানে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে মেয়েরা।
পরে টেরি ও ভ্যান ফিরে যায় মূলধারার সমাজে, নিজের দেশে। জেফ তার গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে হারল্যান্ডেই থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। যদিও নারীবাদী রচনা হিসেবে গিলম্যানের এই লেখাটিকে পরবর্তী নারীবাদীরা অনেকে সমালোচনা করেছেন অন্য কারণে। সন্তানধারণের ভাবনাটার সঙ্গে নারীশরীরকে বেঁধে রাখার বিষয়টা নিজের অজান্তেই গিলম্যান অতিরিক্ত জোর দিয়েছেন। সন্তান উৎপাদনই যেন নারীর একমাত্র উদ্দেশ্য, অন্যদিকে ‘সেপারেটিস্ট ফেমিনিজম’ নামক এক তত্ত্বকেও অজান্তে সমর্থন জানান গিলম্যান এ বইতে। কারণ এই মেয়েরা শ্বেতাঙ্গিনী এবং নিজেদের জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে। আজকের নারীবাদ গ্রহিষ্ণু, লড়াইতে নানা বর্ণের মেয়েরা অন্তর্ভুক্ত। কালো বা বাদামি মেয়ের লড়াই নিজের সময়ে নিজের শ্রেণিসত্তায় দাঁড়িয়ে গিলম্যান হয়তো কল্পনা করতে পারেননি।
ডেভিড প্রিংগল তাঁর ‘আলটিমেট গাইড টু সায়েন্স ফিকশন’ বইতে এ কাহিনিকে স্থান দিয়েছেন সসম্মানে, ১৯৭৯-এ বইটির পুনর্মুদ্রণের পর। হয়েছে গিলম্যানকে নিয়ে গবেষণাও। এবং বলা হয়, গিলম্যানের নিবন্ধগ্রন্থ, নারী ও অর্থনীতির পাশাপাশি এই বইটি, যেন তাঁর অর্থনীতি ও সমাজবীক্ষারই একটা প্রসারিত রূপ। পুরুষকে সংসারের ভাত-কাপড়ের জোগানদার ভাবার যুগসঞ্চিত স্টিরিওটাইপ ভেঙে এই বীক্ষণ ছিল তাঁর সময়ের চেয়ে ঢের এগিয়ে। গৃহকর্ম ও সন্তানপালনের কাজকে শুধুই ‘ডোমেস্টিক ওয়ার্ক’ বলে ছোট করে দেখার বিরুদ্ধে তাঁর কলম সোচ্চার হয়েছিল সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, যখন নারী কেবলই গৃহবধূ ও রান্নাঘরের বাঁদিমাত্র।
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই