কালীর মন্দিরটি কার তৈরি– এই নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কেউ বলেন মানসিংহ একবার ছোট্ট এক মন্দির বানিয়ে দিয়েছিলেন, কেউ বলেন তার আগেই যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের কাকা বসন্ত রায় প্রথম মন্দিরটি বানিয়ে দেন, আবার কেউ বলেন বড়িষার জমিদার সন্তোষ রায় প্রথম মন্দিরটির নির্মাতা। তবে সাম্প্রতিক মন্দিরটি নির্মাণ তথা সংস্কার সম্বন্ধে এক চমকপ্রদ ঘটনা জড়িয়ে আছে। ঘটনাটি ‘কালীপ্রসাদী হাঙ্গামা’ নামে সর্বজন বিদিত।
৬.
নিগমকল্পের পীঠমালার একটা শ্লোকে বলা আছে, দক্ষিণেশ্বর থেকে বহুলা (কালীঘাটের দক্ষিণে রাজপুর বা তার কাছাকাছি) পর্যন্ত দুই যোজনব্যাপী ধনুরাকার স্থান কালীক্ষেত্র। এর মধ্যে আবার একক্রোশ ব্যাপ্ত ত্রিকোণে ত্রিগুণাত্মক– ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের অবস্থান। এরই মাঝে মহাকালী নামে দেবী কালিকা বাস করেন। এই কালীক্ষেত্রে সুদর্শন চক্রে ছিন্ন সতীর দেহ থেকে পদাঙ্গুলি পড়ে, এবং এমন দেহাংশ মোট একান্নটি স্থানে পড়েছিল, যার প্রতিটিই ‘সতীপীঠ’ রূপে পরিচিত। যেহেতু মুনি, ঋষি এমনকী, দেবতারাও আদ্যাশক্তি মহামায়ার চরণ লাভের উদ্দেশ্যে সাধন মগ্ন হয়ে থাকেন, তাই কালীঘাট অভীষ্টপ্রদ এক মহাতীর্থ, অন্তত এমনটা দাবি করে থাকেন কালীভক্তের দল। সেই কবে থেকে বাংলার বণিকেরা ভাগীরথী বেয়ে সমুদ্রযাত্রার কালে দেবী কালীর এই থানে পুজো দিয়ে যাত্রা সাফল্য কামনা করে যেতেন। ১৪৯৯ শক (১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দ)-এ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চন্ডী মঙ্গলে লিখেছেন, ‘বালুঘাটা এড়াইল বেনের নন্দন/ কালীঘাট গিয়া ডিঙ্গা দিল দরশন’। শুধু বাংলা কেন সারা ভারতেই কালীঘাট এক অতি পরিচিত মহাতীর্থ বলে মান্য।
কালীঘাটের দেবী মূর্তির আবিষ্কার, তার বর্তমান স্থানে অবস্থিত এমনকী তার প্রথম পূজারী সম্প্রদায় বিষয়ে নানা মত প্রচলিত। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, একটি কাহিনির সঙ্গে অপর কাহিনির আদৌ কোনও মিল নেই। এক কাহিনি মতে, বর্তমান কালী মন্দিরের চারপাশে ছিল ঘন অরণ্য, সেখানে এক পর্ণকুটিরে বাস করতেন এক বানপ্রস্থী ব্রহ্মচারী। বনের মধ্যে এক জায়গা থেকে এক নিশুতি রাতে অতি উজ্জ্বল এক জ্যোতি প্রত্যক্ষ করেন। পরদিন অনুসন্ধান করে একটি পাথরে খোদিত এক মুখ ও মানুষের পদাঙ্গুলির মতো আরেকটি পাথর দেখতে পান। সেই রাত্রে দেবীর প্রত্যাদেশে তিনিই জানতে পারেন ওই অঙ্গুলি সতীর দেহাংশ। অন্য এক গল্প মতে, বড়িষার ভূম্যধিকারী সাবর্ণি চৌধুরী, সন্তোষ রায় কালীঘাটের পাশ দিয়ে ভাগীরথী বেয়ে নৌকাযোগে যেতে যেতে গভীর বনের মধ্যে থেকে ঘণ্টা ও শাঁখের শব্দে সচকিত হয়ে পড়েন। বাঘ প্রভৃতি শ্বাপদের দাপটে যেখানে দিনের বেলাতেও লোকজনের যাতায়াত থাকে না, সেখানে আসন্ন সন্ধ্যায় এমন করে কোন দেবতার আরাধনায় মগ্ন কোন জন– এই কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য তিনি পরদিনই খোঁজ তলাশ নিয়ে দেখলেন এক তান্ত্রিক সাধু ধ্যানযোগে জানতে পারেন ওইখানে দেবীর অঙ্গ পতিত হয়েছে, তাই সেই দেবী অঙ্গের আরাধনায় ভয়সঙ্কুল অরণ্যে একাকী দেবীর অর্চনা করে চলেছেন। সন্তোষ রায় ছোট একখানি মন্দির দেবীর উদ্দেশ্যে নির্মাণ করিয়ে দিলে কালীঘাটের মন্দির নির্মাণের সূচনা হয়। পরে অবশ্য সেই বংশের অধস্তন পুরুষ রাজীবলোচন রায় ভগ্ন মন্দিরের বদলে বড় করে মন্দির তৈরি করিয়ে দেন। তবে এও শোনা যায়, সন্তোষ রায়ের পিতৃদেব মনোহর ঘোষালকে কালীর সেবায় পরিচারক নিযুক্ত করেন। তাঁরই উত্তর পুরুষেরা ‘হালদার’ উপাধিধারী এবং আজও কালীর সেবক।
তবে কিনা কালীর মন্দিরটি কার তৈরি– এই নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। কেউ বলেন মানসিংহ একবার ছোট্ট এক মন্দির বানিয়ে দিয়েছিলেন, কেউ বলেন তার আগেই যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের কাকা বসন্ত রায় প্রথম মন্দিরটি বানিয়ে দেন, আবার কেউ বলেন বড়িষার জমিদার সন্তোষ রায় প্রথম মন্দিরটির নির্মাতা। তবে সাম্প্রতিক মন্দিরটি নির্মাণ তথা সংস্কার সম্বন্ধে এক চমকপ্রদ ঘটনা জড়িয়ে আছে। ঘটনাটি ‘কালীপ্রসাদী হাঙ্গামা’ নামে সর্বজন বিদিত। সেই ঘটনার আগে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে রাখা জরুরি। শোভাবাজারে দুই প্রতিবেশী সদ্য গজিয়ে ওঠা ‘রাজা’ নবকৃষ্ণ আর বনেদি বড়লোক চূড়ামণি দত্তের রেষারেষি বেশ মুখোরোচক হয়েছিল সেকালে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
১৫১০ খ্রিস্টাব্দে যখন নিমাই পণ্ডিত সন্ন্যাস নিয়ে পুরীধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, তখন পথের ধারে যাবতীয় দেবালয়ে প্রণাম জানিয়ে ‘কৃষ্ণভক্তি’ লাভের প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। তবে সেই তালিকায় কালীঘাট অনুপস্থিত, অথচ তার আগে ১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই তাঁর ‘মনসামঙ্গল কাব্য’-এ, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর ‘চন্ডীমঙ্গল কাব্য’-এ কালীঘাটের কথা উল্লেখ করেছেন। (তবে কিনা যাত্রাপথের বিবরণখানি একটু গোলমেলে, বলা যায় ভূগোল গুলিয়ে একেক্কার)।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
চূড়ামণি দত্তের মেয়ে একবার নেমন্তন্ন পেলেন নবকৃষ্ণের বাড়িতে। একখানি মসলিন পরে। গয়না বলতে শুধু একখানি নীলকান্ত মণির আংটি, তার ছটা ঠিকরে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। নবকৃষ্ণ হাঁ হয়ে চেয়ে রইলেন। জম্মেও অমন চোখে দেখা দূরস্ত। পরদিন সকালে চূড়ামণি সেই আংটিখানি এক বাক্সে ভরে পাঠিয়ে দিলেন, সঙ্গে এক চিরকূট। উপহারের সঙ্গে এমন দংশন সহ্য করতে হল বইকি। এক গরিব ব্রাহ্মণ একবার কানের অসুখে কাতর হয়ে খানিক আতর চেয়ে বসলেন নবকৃষ্ণের কাছে, নবকৃষ্ণ ভাবলেন চূড়ামণিকে জব্দ করা যাক খানিক। একখানি রুপোর বড়সড় ঘড়া দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন চূড়ার বাড়ি। সে বাড়িতে আতর দিয়ে ঘর মোছা হয় নিত্য। চূড়ামণি দু’হাজার টাকার আতর কিনে ঘড়া ভর্তি করে ব্রাহ্মণকে বললেন নবকৃষ্ণকে সেটা দেখিয়ে ফিরে আসতে, পরে তার প্রয়োজন মতো আতর আর দুই হাজার টাকা সেই ব্রাহ্মণকে দিয়ে বিদায় করলেন চূড়ামণি দত্ত।
তবে কালীঘাটের সঙ্গে এই রেষারেষির ঘটনা যেভাবে জড়িয়ে, সেই কথা বলা যাক। সেকালে গঙ্গাতীরে অন্তর্জলি যাত্রা করে মৃত্যুবরণ করাই ছিল বিধেয়, গৃহাভ্যন্তরে মৃত্যু হলে, তাকে অপমৃত্য বলে মনে করা হত। হঠাৎ করেই একরাতে নিজশয্যায় নবকৃষ্ণের মৃত্যু হল। টাকার জোরে তেমন সামাজিক গোলযোগ হল না। এর কিছুদিন পরে কাল আসন্ন জেনে চূড়ামণি গঙ্গা যাত্রা করলেন। ঢুলীর দলকে দিয়ে গান বানালেন, ‘যম জিনিতে যায় রে চূড়া, যম জিনিতে যায়, জপ তপ করলে হয় না মরতে জানতে হয়’। নবকৃষ্ণের বাড়ির সামনে এসে নাচ গানের বহর দ্বিগুণ ছেড়ে চৌতালা হল। অপমানের শোধ নিতে নবকৃষ্ণের পরিবার এলাকার সব ব্রাহ্মণদের নিষেধ করলেন, তাঁরা যেন চূড়ামণি দত্তের শ্রাদ্ধকর্মে ভাগ না নেন। মাথায় হাত পড়ল চূড়ামণির ছেলে কালীপ্রসাদ দত্তের। শেষে রামদুলাল সরকারের মধ্যস্থতায় এগিয়ে এলেন কালীঘাটের একদল পুরোহিত। শ্রাদ্ধশান্তি সব মিটে গেলে ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা বাবদ কালীপ্রসাদ দত্ত যে টাকা দিয়েছিলেন, সেই টাকা দিয়ে কালীঘাটের মন্দির নতুন করে তৈরি হয়।
১৫১০ খ্রিস্টাব্দে যখন নিমাই পণ্ডিত সন্ন্যাস নিয়ে পুরীধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, তখন পথের ধারে যাবতীয় দেবালয়ে প্রণাম জানিয়ে ‘কৃষ্ণভক্তি’ লাভের প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। তবে সেই তালিকায় কালীঘাট অনুপস্থিত, অথচ তার আগে ১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই তাঁর ‘মনসামঙ্গল কাব্য’-এ, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর ‘চন্ডীমঙ্গল কাব্য’-এ কালীঘাটের কথা উল্লেখ করেছেন। (তবে কিনা যাত্রাপথের বিবরণখানি একটু গোলমেলে, বলা যায় ভূগোল গুলিয়ে একেক্কার)। তবে একথা ঠিক, তখন গঙ্গাসাগরের যাত্রীদের কলকাতার মধ্য দিয়ে যাতায়াতের পথেই পড়ত কালীঘাট। তান্ত্রিক, কাপালিক এবং ডাকাতদের উৎপাত অধ্যুষিত বলে যাত্রীরা ওইসব অঞ্চল দল বেঁধে পার হত, এবং যাত্রাপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কালীঘাটে পুজো দিতেন বলেই জানা যায়। কালীঘাটে পুজো দিতেন সেকালের হিন্দুদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মানুসারীরাও, এমনকী খোদ ইংরেজের দলও। কালীঘাটের কালীর কাছে মানত করা, এবং সফলকাম হলে পাঁঠাবলি ভারতীয়দের কাছে অতি প্রাচীনকাল থেকেই পরম পূজনীয় মহাবিদ্যা রূপে প্রকাশিত। তবে তিনিই আবার তান্ত্রিক সাধকের পূজ্যা বলে পঞ্চমকারে পূজিত হয়ে থাকেন। তাই সেই কবে থেকেই কালী মন্দিরে বলিদানের রেওয়াজ চলে আসলেও আজও চালু আছে। দেওয়ার চল অতি প্রাচীন। অথচ আশ্চর্য এখান কালী নারায়ণী বা লক্ষ্মীরূপে পূজিত হয়ে থাকেন। তাঁর নাকে আজও আঁকা হয় তিলক। বিষ্ণুভক্তি প্রদান কারিণী কালী, দুর্গা, দশমহাবিদ্যার নানা রূপ সারা ভারতের কাছেই কালীঘাট এক মহাতীর্থ রূপে পরিচিত। বর্তমানে কালীঘাট এলাকার আমূল সংস্কার সাধন করা হচ্ছে, মন্দিরের তিনটি চূড়া সোনা দিয়ে মুড়িয়ে, পোড়ামাটির অলংকরণগুলি নতুন করে তৈরি করিয়ে সাবেকি ধাঁচ ফিরিয়ে যাত্রীদের সুবিধার্থে নানা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, রাজ্য সরকারের উদ্যোগে।
…পড়ুন তীর্থের ঝাঁক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪। কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
পর্ব ৩। পুত্র রাম-লক্ষ্মণ বিদ্যমান থাকতেও পুত্রবধূ সীতা দশরথের পিণ্ডদান করেছিলেন গয়ায়
পর্ব ২। এককালে শবররা ছিল ওড়িশার রাজা, তাদের নিয়ন্ত্রণেই পুজো পেতেন জগন্নাথদেব
পর্ব ১। ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব