সাধারণকে বাদ দিয়ে তাই শিল্প হতে পারে না। আজকে দুর্গোপুজোকে ঘিরে যে উৎসব চলছে, আমার কাছে এটা সাধারণের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলার সেরা এবং সহজ উপায়। কারণ এখানে টাকা আছে, স্থান আছে, আর আছে পুজো কমিটি নামক প্রতিষ্ঠান, যারা কোনও রিসার্চ পেপার ছাড়াই শিল্পের জন্য বিপুল টাকা লগ্নি করছে। বলছে, ‘এই নাও দশ লাখ দিচ্ছি, প্যান্ডেলটা তোমায় করতে হবে।’ এই যে দশ লক্ষ টাকা, সেটা কিন্তু শিল্পী ঘরে নিয়ে যাচ্ছে না। তাঁর তত্ত্বাবধানে দু’শো-তিনশোজন কাজ করছে। সেই অর্থের বিলিবণ্টন হচ্ছে।
৬.
‘পাবলিক আর্ট’ বলতে আমি বুঝি দুর্গাপুজোকেই। আগের পর্বেই একথা বলেছিলাম। আমি মনে করি, এই সমাজে আমরা যারা নিজেদের ‘শিল্পী’ হিসেবে দাবি করি, তাদের কিছু দায় রয়েছে। তা হল শিল্পীকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়। শিল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগস্থাপনটাই আসল কথা। সেই যোগসূত্র তৈরির চেষ্টা বরাবর করতে চেয়েছি। এখনও তাই করি। মানুষের কাছাকাছি এসে মানুষের কথা বলা দরকার। ভেঙে যাওয়া সেই দূরত্ব আমাদের ঘোচাতে হবে, সেই বোধটা প্রতিনিয়ত আমার মনের মধ্যে দানা বেঁধে ওঠে। দুর্গাপুজো সেই দূরত্ব ঘোচানোর মঞ্চ।
প্রথমবার, ১৯৯৮-এ দুর্গাপুজো করতে এসেই আমি নিজেই ভেঙে দিয়েছিলাম দুর্গার চেনা রূপকে। অসুরবিনাশিনীর বদলে নিয়ে এসেছিলাম গণেশ জননীর আদল। শুধু যে সেবার গণেশ জননী করলাম তা নয়, মণ্ডপের দেওয়ালে, খুব কম বাজেটে, থার্মোকলে রং পেস্টিং করে পাড়ার সবাই মিলে কাজ করল। দেওয়ালে মধুমণির আর্টের কিছু ছবি করলাম। আমার পাড়ার কিছু ভাই– বন্ধু অপু, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত মানে পিকু, আরও বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতাম। সবার মধ্যে কাজ ভাগ করে দিয়েছিলাম। আসলে কাজটা তো শুধু ডেকরেটরের নয়, দুর্গোপুজোটা সবার। আমরা সার্বজনীন বলছি।
সেটা করতে গেলে পুজোর সমস্তটার সঙ্গে মানুষকে জুড়তে হবে। মণ্ডপে বেশ কিছু মাটির জালা, তার গায়ে রং-তুলি দিয়ে পাড়ার ছেলে-বউরা আঁকছে। আমি তাদের একাত্ম করার চেষ্টা করছি। কেন? না সবাই বলবে, এটা অমুক পুজো নয়, এটা আমার পুজো। এখনও করি, আরও বেশি করে করার চেষ্টা করি, যাতে শিল্পকে মানুষ নাক উঁচু করে গ্যালারিতে না ফেলে দেয়। গ্যালারি বা হোয়াইট কিউবের যে কালচার, আর ফ্লোক কিংবা পাবলিক আর্টের যে কালচার, তা সম্পূর্ণ আলাদা। শিল্প আসলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। তার সঙ্গে জনগণের আত্মিক যোগ তৈরি হওয়া দরকার। তবেই না শিল্পের মাহাত্ম্য বজায় থাকবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
দুর্গোপুজো সেই মঞ্চ। সেই ভূমিতে তারা শিল্পের সোনালি ফসল ফলাক। তাতে শিল্পী বাঁচবে, শিল্প বাঁচবে, তাদের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবে সাধারণ মানুষ। আমি একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে এমন একটা আনঅর্গানাইজড ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে পারছি। এটা আমার কাছে বিপ্লবের কাঙ্ক্ষিত রূপ!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমাদের ইতিহাস সেই কথাই বলে। ভারতীয় শিল্পের মধ্যে ত্যাগ, বৈরাগ্যের সবটুকু রয়েছে। আর রয়েছে সাধারণ মানুষের কথা, তাদের শ্রম, মেধা, জীবনযাপনের কথা। সেখানে হিন্দু-মুসলমান বলে কিছু নেই। প্রাচীন ভারতের চোল সাম্রাজ্য বলুন কিংবা বাংলার পাল সাম্রাজ্যে মন্দিরের গায়ে স্থাপত্য-ভাস্কর্য, পাহাড়ের গায়ে যে ছবি খোদাই করা হয়েছে, কিংবা পুঁথিচিত্র থেকে শুরু করে যে মুঘল চিত্রকলা নির্মিত হয়েছে– সর্বত্র আমআদমির জীবনের গল্প ঠাঁই পেয়েছে। কোণারক, খাজুরাহোর গায়ে স্তরে স্তরে মানুষের যাপন-চিত্রের নানা স্তরের বিনির্মাণ ঘটেছে, শেষে তা উত্তীর্ণ হয়েছে এক ঐশ্বরিক বোধে। সেই ফিলজফিতে আমার বিশ্বাস থাকুক আর না থাকুক, সেই আর্টকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।
সাধারণকে বাদ দিয়ে তাই শিল্প হতে পারে না। আজকে দুর্গোপুজোকে ঘিরে যে উৎসব চলছে, আমার কাছে এটা সাধারণের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলার সেরা এবং সহজ উপায়। কারণ এখানে টাকা আছে, স্থান আছে, আর আছে পুজো কমিটি নামক প্রতিষ্ঠান, যারা কোনও রিসার্চ পেপার ছাড়াই শিল্পের জন্য বিপুল টাকা লগ্নি করছে। বলছে, ‘এই নাও দশ লাখ দিচ্ছি, প্যান্ডেলটা তোমায় করতে হবে।’ এই যে দশ লক্ষ টাকা, সেটা কিন্তু শিল্পী ঘরে নিয়ে যাচ্ছে না। তাঁর তত্ত্বাবধানে দু’শো-তিনশোজন কাজ করছে। সেই অর্থের বিলিবণ্টন হচ্ছে। তিনমাস খেটেখুঁটে শিল্পী অন্তত এক লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক পাচ্ছে। আজকের আর্ট কলেজগুলোর কথাই যদি ধরি, প্রতিবছর গভর্মেন্ট আর্ট কলেজ, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ– তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে দু’শো-তিনশোজন শিক্ষার্থী বের হচ্ছে। যদি তারা নামী শিল্পী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতেও পারে, কিন্তু তাদের ছবি তারা প্রদর্শন করবে কোথায়! সেই পরিমাণ আর্ট গ্যালারি তো আমাদের এখানে নেই। মিউজিয়াম তো নেই-ই! তাহলে তারা কী করবে? যে আর্টকে তারা এতদিন ধরে আত্মস্থ করল, তাকে কোথায় তুলে ধরবে?
দুর্গোপুজো সেই মঞ্চ। সেই ভূমিতে তারা শিল্পের সোনালি ফসল ফলাক। তাতে শিল্পী বাঁচবে, শিল্প বাঁচবে, তাদের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবে সাধারণ মানুষ। আমি একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে এমন একটা আনঅর্গানাইজড ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে পারছি। এটা আমার কাছে বিপ্লবের কাঙ্ক্ষিত রূপ! আজ বলে নয়, এই প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন জারি আছে।
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত