নয়-নয় করে বছর সাতাশি বয়স হল ব্রডওয়ের। গল্প শুনলাম, এক কালে নাকি লালা লাজপত রায় পছন্দের মদিরা দিয়ে প্রাত্যহিক সান্ধ্য-আহ্নিক সারতেন এ ‘বার’-এর প্রিয় চেয়ারে বসে! স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে কলকাতার গ্র্যান্ড-গ্রেট ইস্টার্নের সঙ্গে একযোগে পাল্লা দিত ব্রডওয়ে। রনজি খেলতে এসে শচীন তেন্ডুলকর-অনিল কুম্বলে-মহেন্দ্র সিং ধোনিরা থেকে গিয়েছেন এর লাল মেঝের পিলে চমকানো অতিকায় ঘরে। ঘুমিয়েছেন বার্মা টিকের খাটে। জামাকাপড় ঝুলিয়েছেন প্রাগৈতিহাসিক আলনায়। ব্রডওয়ের ম্যানেজার বাবু কল্যাণ সেন বললেন যে, তিনি পড়শিদের থেকে শুনেছেন, ইডেনে কমেন্ট্রি করতে এসে লালা অমরনাথ নাকি নিত্য আগাম অর্ডার করে যেতেন প্রিয় ডাল-তরকা আর রুটি!
১.
নেশা জিনিসখানি বাপু, বিস্তর গোলমেলে বস্তু। মহা ঠ্যাঁটা। সৃষ্টিছাড়া। পৃথিবীর ফরমায়েশি আইনকানুন কিস্যু মানে না। ফাঁক পেলে সে বরং সঙ্গীর তল্লাশি করে। বন্ধু নেশাকে খোঁজে। আর শেষে দেখা-টেখা পেলে তার ভারি আনন্দ হয়। নেশায় তখন নেশা বাড়ে, নেশা বড় হয়। সিগারেট, বিড়ি, মদ, গাঁজা– সব ক’টা সেয়ানা, সব রতনে রতন চেনে! এবং অজ্ঞাত মন্ত্রগুপ্তিতে এরা ঠিক নতুন-নতুন নেশা জড়িয়ে নেয়। এই যেমন এখন, এক বসন্ত-দুপুরে, আমরা তিন শ্রীমান (পেশাগত নাম সহকর্মী), দিব্য রোদ্দুরে নেশা খুঁজে পাচ্ছি। পেল্লায় লালচে জানালার খড়খড়ির ফোঁকর দিয়ে যে ব্যাটাচ্ছেলে নানান ফিকিরে গলে, আমাদের কাঠের টেবিল ভিজিয়ে দিচ্ছে। লাল টেবিল ক্লথের উপর লুটোপুটি খাচ্ছে। বিয়ার মগের হরিদ্রাভ তরলে টলমল পায়ে হাঁটছে। আর কেমন অজান্তে দ্যাখো, ফিরিয়ে দিচ্ছে পুরনো কড়ি-বরগা, ফিরিয়ে দিচ্ছে সেকেলে লাল মেঝে, ফিরিয়ে দিচ্ছে আমার ফিটন গাড়ির কলকাতা!
কী স্যর, ভাবছেন শুঁড়িখানায় ছাঁইপাশ গিলে ছাইভস্ম লিখতে বসেছি? ধুস! গণেশচন্দ্র অ্যাভেনিউ-র হলদে রঙা ‘ব্রডওয়ে বার’-এ আমরা তিনজন বসেছি ঠিকই (দেখুন দেখি, তখন থেকে আমরা তিনজন বলে যাচ্ছি বিনা পরিচয়ে। সে দিন ব্রডওয়ে গিসলাম ক্রিকেট ও সাহিত্যে সমান পারদর্শী সম্বিত বসু, চিত্র সাংবাদিক ব্রতীন কুণ্ডু আর এ আহাম্মক)। লাল সুজনি ঢাকা খর্বকায় টেবিলে মস্ত একটা বিয়ার ‘জাগ’-ও রাখা আছে বটে। কিন্তু আমরা ‘বারবেলা’-র প্রথম ফিরিস্তি লিখতে এসে কেউ মোটেও নেশা করছি না। উঁহু, ঈষৎ ভুল হল। মদের নেশা এখনই করছি না। ওটা যখন হওয়ার, হবে ঠিক। কিন্তু একটা নেশা যে হচ্ছে বেশ। নস্টালজিয়ার নেশা। ফেলে আসা এক সময়ের নেশা। ভালো-মন্দ কতিপয় স্মৃতির নেশা।
বলুন না, শহরের কোন ‘বার’-এ, তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ছবি টাঙানো আছে? যে ছবিতে রাস্তায় শুয়ে ক্ষুধার তাড়নায় কাতরায় এক যুবতী? বলুন না, শহরের কোন ‘বার’-এর সিংহদরজা লন্ডন টেলিফোন বুথের আদলে দেখতে? একদিক বন্ধের বদলে যার দু’দিক খোলা! বলুন না, শহরের কোন ‘বার’-এ ন’দিনব্যাপী ট্রাম ধর্মঘটের ইতিহাস বলে? কোথায়ই বা পাওয়া যায়, কুমোরটুলির অমিতরঞ্জন কর্মকারের ঘিঞ্জি রেডিও দোকানের দেওয়াল জোড়া ছবি?
ব্রডওয়েতে ঢোকার সময় সম্বিত খাসা একখানা কথা বলল। বলল, ‘রাজুদা, এটা মদের কফি হাউস।’ ট্রু। ফ্যাক্ট। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো সেই কবে লিখে গিয়েছেন, রূপকে রূপান্তর না করে বাঁচা বড় শক্ত। নদী দেখলে মনে হয়, নৃত্যচঞ্চলা নারী। নারীকে মনে হয় নদী। ব্রডওয়ে দেখে তাই কফি হাউস মনে পড়লে দোষের কী? তা ছাড়া এটা তো সত্যি যে, গণেশচন্দ্র অ্যাভেনিউয়ের এই বার-মহাশয়ের খাসমহলে হেজেমজে যাওয়া ব্রিটিশ বেঙ্গলের বুনো গন্ধ আছে! দীর্ঘদেহী পাঞ্জাবি মালিক রাঘব সেহগলের ভাষায় যা আদতে, ‘ব্রডওয়ে ইজ ক্যালকাটা পার্সোনিফায়েড, অ্যাজ ইউ ওয়াক ইন ইটস লাইক টাইম ক্যাপসুল!’
লাখ কথার এক কথা। নয়-নয় করে বছর সাতাশি বয়স হল ব্রডওয়ের। গল্প শুনলাম, এক কালে নাকি লালা লাজপত রায় পছন্দের মদিরা দিয়ে প্রাত্যহিক সান্ধ্য-আহ্নিক সারতেন এ ‘বার’-এর প্রিয় চেয়ারে বসে! স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে কলকাতার গ্র্যান্ড-গ্রেট ইস্টার্নের সঙ্গে একযোগে পাল্লা দিত ব্রডওয়ে। রনজি খেলতে এসে শচীন তেন্ডুলকর-অনিল কুম্বলে-মহেন্দ্র সিং ধোনিরা থেকে গিয়েছেন এর লাল মেঝের পিলে চমকানো অতিকায় ঘরে। ঘুমিয়েছেন বার্মা টিকের খাটে। জামাকাপড় ঝুলিয়েছেন প্রাগৈতিহাসিক আলনায়। ব্রডওয়ের ম্যানেজার বাবু কল্যাণ সেন বললেন যে, তিনি পড়শিদের থেকে শুনেছেন, ইডেনে কমেন্ট্রি করতে এসে লালা অমরনাথ নাকি নিত্য আগাম অর্ডার করে যেতেন প্রিয় ডাল-তরকা আর রুটি! বলে যেতেন, ‘দেখো, ফিরে এসে যেন ওটা পাই!’ পরে বুঝলাম, ‘বার’-এ তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ছবি থাকাও যথেষ্ট আবশ্যিক। বাংলার চিরদুঃখী সেই সময়ে ব্রডওয়ে ‘বার’ থেকে রেশন সেন্টারে পরিণত হয়েছিল যে!
সুরার একটা দুর্লভ গুণ আছে। জাগতিক যে কোনও দুঃখ-বেদনার সে অবধারিত ‘বনলতা সেন’। মন্বন্তর ভুলতে আমরাও ঝটপট চুমুক দিলাম বিয়ার মগে। ‘সেভেন কোর্স মিল’-এর মতো মদেরও বাহারি পদ হয়। এদেরও নানাবিধ সমস্ত আছে। দু’টো নাম বেশ লাগল। নিউ মার্কেট পোমগ্রানেট পাঞ্চ। এবং ব্যোমকেশ মার্টিনি! দর-দামও যথেষ্ট সাধ্যের মধ্যে। সব মেরেকেটে ৫০০।
রাঘব সেহগাল দারুণ একখানা যুক্তি দিলেন। ভদ্রলোক বললেন যে, জীবনের সমস্ত শখ-আহ্লাদ-আকাঙ্ক্ষা ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের আনুপাতিক হতে হবে, তার কোনও অর্থ নেই। মানুষ বলতে তিনি মানুষ বোঝেন। নানা ধরনের মানুষ। নানা পেশার মানুষ। কেউ উকিল। কেউ অ্যাংলো। কেউ ব্যবসায়ী। কেউ কলেজ-পড়ুয়া। যাঁরা প্রত্যেকে তাঁর ‘বার’-এর সম্মানীয় অতিথি। কে খানদানি ক্যালকাটা বেবি ভেটকি মশালার সঙ্গে গ্লেনলিভেট টুয়েলভ ইয়ার্স অর্ডার করছে, আর কে মধ্যবিত্ত স্টক এক্সচেঞ্জ টোস্টের (সে পাঁউরুটি প্রত্যহ কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ চত্বর থেকে আনানো হয়) সঙ্গে ‘কটন’-এর লেমোনেড নিয়ে বসছে, দেখার তাঁর দরকার নেই। ভদ্রলোক বরং আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন প্রয়োজনীয় আধুনিকতার ‘প্রসাধনী’ রেখে যতটা পারা যায়, পুরাতনী কলকাতাকে অটুট রাখতে। না হলে আর বাইরে থেকে ঠাকুর্দার আমলের হুইস্কি গ্লাস অর্ডার করেন? দোতলায় (বারের উপর চারটে তলা রয়েছে, খান চল্লিশ ঘর-সহ) পুরনো রাজবাড়ির বিশালাকায় অন্দরমহলের মতো একখানা ব্যাঙ্কোয়েট হল তৈরি করেন? শুনলাম, ছুটিছাটার দিনে, নিচের ‘বার’-এর অ্যাল-কোলাহলের চাপে দোতলার ব্যাঙ্কোয়েট খুলে দেওয়া হয়। বিনামূল্যে।
বেশ বুঝলাম, রাঘববাবুর ‘ব্রডওয়ে’ আদতে সুরাপ্রেমীদের সর্বধর্ম সম্মেলন কিংবা শুঁড়িখানাদের চৌরঙ্গী! অফিস শেষে, কলেজ কেটে, প্রেমের প্রত্যুষে লোকে যেখানে দু’পাত্তর নিয়ে বসতে আসে। উচ্চবিত্ত যেখানে বসে অগাধ পয়সা-সহ একাকী আগামীর কথা ভাবে। মধ্যবিত্ত দু’আনার বাবুয়ানি দেখায়। আমরাও দেখাচ্ছিলাম যেমন।
বিয়ারের একটা ‘পিচার’ খতম করে উচ্চগ্রামে ‘ফির লাও’ বলে! সম্বিত কোত্থেকে শুনেছে, ব্রডওয়ের এই ড্রট বিয়ারের নাম ‘মায়ের হাতের বিয়ার’। অ্যাঁ, মায়ের হাতের বিয়ার! আমার অবশ্যি প্রথম প্রেমিকার ঠোঁটে প্রথম চুম্বনের স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছিল। উঁহু, না, সম্বিতের শোনাটাই থাকবে। অমন একখানা তোফা নাম! মালিককে বলে দেব। কিন্তু আজ আর না, বিলকুল না। এবার নেশা হচ্ছে। মাটি দুলছে। কান গরম হচ্ছে। আজ গ্রিন পিস মশালা দিয়ে মায়ের হাতের বিয়ার খেলাম। পরের দিন এসে কাতলা পেটি ভাজা দিয়ে সাঁটাব। ব্রডওয়ের হেরিটেজ ডিশ স্যর, কোনও চালাকি চলবে না। রক-জ্যাজ-ব্লুজের শো-টাও একবার শোনা দরকার। ফি রোববার যেটা হয়। হালফিলের কেতাবাজির ‘বার’গুলোর ইলেকট্রনিক জগঝম্প তো বধির করে দিল মাইরি!
ঢক ঢক করে ‘বিয়ার মগ’ খালি করে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম আমরা তিনজন। পুরনো থেকে নতুন কলকাতায়। আমি। সম্বিত। ব্রতীন। সম্বিত গোল্ডফ্লেক লাইট ধরাল। আমি চারমিনার। ব্রতীন কী যেন একটা! শিশুর মতো আমরা হাঁটছি। লোকে দেখছে। ফিকফিক হাসছে। মরুক গে। অফিস যেতে হবে। কাজ দেখাতে হবে। সম্বিত বোধহয় সিগারেটের আলো দেখছে। নেশা করলে নাকি সে লাল আলো ওকে পথ দেখায়!
আমার আবার গান পাচ্ছে! প্রতুল বাবু (প্রতুল মুখোপাধ্যায়) চলে গেলেন, দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু আমার মতো মুখ্যু-সুখ্যুদের জন্য যে সবেধন নীলমণি গানখানি রেখে গেলেন, তা এখন মনেও পড়ছে। আচ্ছা, মদের সঙ্গে সে গান মিশিয়ে দিলে কেমন হয় ভায়া? নিজস্ব হাঁড়িচাচা কণ্ঠে মিলিয়ে-মিশিয়ে গেয়ে দিই না শ্লা, চালাও পানসি বেলঘরিয়া, কে আটকাচ্ছে? শুধু প্রতুলবাবু নিজগুণে এ ক্ষমাহীন ধৃষ্টতা মাফ করে দিলেই হল!
আমি বাংলায় মদ খাই/আমি বাংলার মদ খাই/আমি আনাচে-কানাচে ঘুরেটুরে শেষে/ সেই ব্রডওয়ে ফিরে যাই…!
ছবি: কৌশিক দত্ত
………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………