দেশভাগ নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা অনেকেই বলেন যে, ভাগাভাগির ফলে বাঙালি হিন্দু ভদ্রমহিলাদের স্বাধীনতা সামান্য হলেও বেড়েছিল, তাঁদের ক্ষমতায়ন হয়েছিল। সকলে অবশ্য সে কথা মানেন না। তাঁদের মতে মেয়েদের চাকরি করতে যাওয়া মানে ছিল তাঁদের কাজ বাড়া– যে রাঁধে সে যে চুলও বাঁধে। আর চাকরি ছিল তাঁদের প্রয়োজনে, ইচ্ছে-অনিচ্ছের উপর তা নির্ভর করত না। যেসব পরিবারের মেয়েরা চাকরিতে যোগ দিলেন, সেই পরিবারের দিন যাপনের ছন্দ কী সামান্য হলেও পাল্টায়নি? একে শুধুই ‘ইতিহাসের প্রশ্ন’ বলে ভাবতে অসুবিধা হয়।
১.
সেই স্ত্রীভূমিকাবর্জিত অফিসে নায়িকাও একজন এল। অফিসসুদ্ধ লোক একদিন হঠাৎ বিস্মিত হয়ে দেখল উত্তর-পূর্ব কোণের যে চেয়ারটায় নকুলবাবু সারাদিন বসে খটখট শব্দে টাইপ করতেন, সেখানে এসে বসেছে কুড়ি একুশ বছরের ছিপছিপে চেহারার একটা মেয়ে।… বুঝতেই পারেন সমস্ত অফিসটা মুহূর্তের মধ্যে চঞ্চল, চক্ষুময় হয়ে উঠল।
চেক। নরেন্দ্রনাথ মিত্র
দেশভাগের পরপর কলকাতার এক সওদাগরি অফিসের এমনই ছবি পাই আমরা নরেন মিত্রের ছোটগল্প ‘চেক’-এ। টাইপিস্ট পদে আসা একটি উদ্বাস্তু মেয়েকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে গল্পটি। নরেন মিত্রর নানা গল্পেই ঘুরে-ফিরে আসেন চাকুরিরতারা; প্রায় প্রত্যেকেই তাঁরা পূর্ব বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তু; দেশভাগ তাঁদের ঠাঁইনাড়া করেছে।
’৫০-’৬০-এর সময়টায় গল্প-উপন্যাস বা চলচ্চিত্রে বাঙালি হিন্দু চাকুরিরতারা সংখ্যায় অনেক। অবতরণিকা (মহানগর)-এর আরতি, ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতারা পরিচিত চরিত্র আমাদের। গল্প বা সিনেমা তো সমাজের আয়না। দেশভাগের পর শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি মেয়েরা, বিশেষ করে যাঁরা ওপার বাংলা থেকে এসেছিলেন, তাঁরা অনেকেই দশটা-পাঁচটার চাকরিতে যোগ দেন। আর তাঁদের জীবনের গল্পই আমরা উঠে আসতে দেখি সিনেমা, গল্প, উপন্যাসে।
ওপার বাংলায় বরাবরই হিন্দু মেয়েদের লেখাপড়ার চল ছিল এপারের তুলনায় বেশি। তাঁদের চাকরিতে যোগ দেওয়া অবশ্য ভাগাভাগির পরবর্তী ঘটনা। দেশভাগের ঠেলায় এপারে আসা হিন্দু ভদ্রলোক পরিবারের মেয়েদের চাকরি নিতে হয়েছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভাবের তাড়নায়। একেক পরিবারে অসংখ্য মানুষ, কিন্তু উপার্জনক্ষম পুরুষ হয়তো হাতে গোনা। স্কুল বা কলেজের গণ্ডি পেরনো বাড়ির বউ বা মেয়েকে সেক্ষেত্রে চাকরি করে খানিকটা সংসারের হাল ধরতেই হত। বোধ হয় সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই হাজার অসুবিধা সত্ত্বেও বাস্তুহারা পরিবারে মেয়েদের এপার বাংলায় স্কুল-কলেজে পাঠানো বন্ধ হয়নি।
ইতিহাসবিদ জয়া চ্যাটার্জির লেখা থেকে পাই, ১৯৫০ সালে উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়েদের মধ্যে ১৭.৯ শতাংশ ছিলেন সাক্ষর। সেই তুলনায় এপার বাংলার মেয়েরা পিছিয়ে ছিলেন অনেকটাই। তাঁদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৭.৯ শতাংশ। ১৯৫৫ সালের আর একটি সমীক্ষা অনুসারে, উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়েদের মধ্যে সাক্ষরতার হার বেড়ে হয়েছিল ২৯.২%। এই মেয়েদের অনেকেই স্কুল-কলেজে পড়িয়ে, টেলিফোন অফিসে যোগ দিয়ে বা টাইপ শিখে সংসারের হাল ধরেছিলেন। মানস রায়ের স্মৃতিচারণে আমরা পড়ি, তাঁর দিদির চাকরির শুরুর দিনটির বর্ণনা।
‘তত দিনে দিদি বিএ পাশ করেছেন। সরকারি অফিসের কনিষ্ঠ স্টেনোগ্রাফার হিসাবে তাঁর চাকরি সংসারের হাল ধরতে কাজে এল, বিয়ের প্রস্তাব আপাতত মুলতুবি। উদ্বাস্তু উপাখ্যানের আরেক কিস্তি।… মাড় দেওয়া, ইস্তিরি করা ছাপা শাড়ি পরে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে একদিন দিদি চাকরিতে রওনা দিলেন। মা এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে– প্রস্তুত হয়েও তিনি প্রস্তুত নন– নিজের পায়ের ধুলো দিদির মাথায় ঠেকালেন তিনবার। তারপর ছোট্ট করে থু। বিশেষ আচার, বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য।
আপিসে প্রথম দিন বাবা দিদির সঙ্গে গেলেন, তিন নম্বর গভর্নমেন্ট প্লেস, লাল বাড়ি, অনেক লম্বা। ঘণ্টা দু-তিন বাদে আবার ফিরে গেলেন। এবার হাতে ডাব। ‘বারে, আমি পরীক্ষা দিতে আইসি নাকি?’…
মেয়েকে চাকরি করতে হবে– এ কথা মেনে নিলেও, যেন কোথাও একটা অস্বস্তি; মাথায় গেঁথে যাওয়া নারী-পুরুষের পরিসর যত তাড়াতাড়ি পালটে যাচ্ছিল তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি ছিল না বাবা-মা, স্বামী বা সমাজের।
………………………………………..
পথে-ঘাটে, অফিসে মেয়েরা নিত্য যৌন হিংসার শিকার; নিজেদের বাঁচানোর নিত্যনতুন উপায় খুঁজে বের করতে হয় তাঁদের। আর মা বা স্ত্রী হিসাবে বাড়ির কাজের দায়দায়িত্ব মেয়েদের অনেক বেশি। পরিসংখ্যান বলে, আজকের ভারতে ১৫-৫৯ বছরের মহিলারা গড়ে দিনে ৩০৫ মিনিট বাড়ির কাজ করেন। আর পুরুষেরা সেই জায়গায় ৮৮ মিনিট এই কাজ করেন।
………………………………………..
সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনও দুর্যোগের ফলে সমাজ স্বীকৃত পুরুষ-মহিলার সম্পর্ক, কাজের পরিধি আচমকা পালটে যাওয়ার নজির ইতিহাস ঘাঁটলে আরও পাওয়া যায়। দেশভাগ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ব্রিটেনে ৩৩ লক্ষ মহিলা চাকরি করতেন (১৯১৪)। ১৯১৭ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ লক্ষে। ব্রিটেন ব্যতিক্রম ছিল না। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও আমরা দেখি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বহু মহিলাকে চাকরির জগতে নিয়ে এসেছিল। ঠিক তেমনই হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। যুদ্ধ শুরুর সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০৮ লক্ষ মহিলা চাকরি করতেন। সে জায়গায় ১৯৪৪ সালের অগাস্ট মাসে চাকুরিরতার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৮০ লক্ষ। ছেলেরা যুদ্ধে চলে যাওয়ায়, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রয়োজনেই বিভিন্ন দেশে মেয়েদের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। পারিবারিক প্রয়োজনও ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ভারতেও চাকরি ক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি বাড়ে। তবে তাঁদের মধ্যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বা মেমসাহেবরাই বেশি ছিলেন; হিন্দু মুসলমান মধ্যবিত্ত মেয়েরা ছিলেন সংখ্যায় নগণ্য। দেশভাগ সেই ছবিটা পাল্টায়। ‘যুগান্তর’ সংবাদপত্রের পাতায় যেমন আমরা পড়ি, ‘কলকাতার টেলিফোন মেয়েরা এখন অধিকাংশই বাঙ্গালী, মধ্যবিত্ত ঘরের। অনেক পরিবারের জীবিকা অর্জনের সহায়তা করছেন এঁরা। …টেলিফোন হাউসে চাকরি করে আজ অনেক মধ্যবিত্ত মেয়ে অন্ন সংস্থান করছেন…’ (৭ অগাস্ট, ১৯৫০)। ওই একই কাগজে কিছু দিন পরের আরেকটি প্রতিবেদনে আমরা পড়ি, ‘কয়েক বৎসর পূর্ব পর্যন্তও অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান তরুণীরাই বেশীর ভাগ টেলিফোন অপারেটরের কাজ করিত। …বর্তমানে [কলকাতার] বিভিন্ন এক্সচেঞ্জে ২৩৯ জন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ও ৪৮০ জন ভারতীয় তরুণী অপারেটর কাজ করে।’ (১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০)। যত দিন যাবে টেলিফোন-সহ সব অফিসেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা সংখ্যায় কমবেন ও ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়বে।
দেশভাগ নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা অনেকেই বলেন যে, ভাগাভাগির ফলে বাঙালি হিন্দু ভদ্রমহিলাদের স্বাধীনতা সামান্য হলেও বেড়েছিল, তাঁদের ক্ষমতায়ন হয়েছিল। সকলে অবশ্য সে কথা মানেন না। তাঁদের মতে মেয়েদের চাকরি করতে যাওয়া মানে ছিল তাঁদের কাজ বাড়া– যে রাঁধে সে যে চুলও বাঁধে। আর চাকরি ছিল তাঁদের প্রয়োজনে, ইচ্ছে-অনিচ্ছের উপর তা নির্ভর করত না। ঠিক একই ধারায় আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক রয়েছে বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতেও। দুই বিশ্বযুদ্ধ কি ইউরোপ-আমেরিকায় নারীদের ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করেছিল– এই প্রশ্ন তুলেছেন ইতিহাসবিদেরা। পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন; ক্ষমতায়নের মানে কী, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন। জরুরি আলোচনা সেসব। তবে পাশাপাশি কিছু আপাত সহজ প্রশ্নও হয়তো তোলা দরকার। ‘চঞ্চল, চক্ষুময় অফিসে’ মেয়েরা কীভাবে, কতটা মানিয়ে নিলেন? রোজকার বোঝাপড়া, সংগ্রামের ধরন তাঁদের কেমন ছিল? আর তাঁরা যখন বাসে, ট্রামে ভিড় ঠেলে অফিস বা কলেজে যেতেন, সেই অভিজ্ঞতাই বা কেমন ছিল তাঁদের? যেসব পরিবারের মেয়েরা চাকরিতে যোগ দিলেন, সেই পরিবারের দিন যাপনের ছন্দ কী সামান্য হলেও পাল্টায়নি? এই প্রশ্নগুলোকে ‘ইতিহাসের প্রশ্ন’ বলে ভাবতে অসুবিধা হয়। বহু চাকুরিরতার কাছে এই সব ক’টি প্রশ্নই এখনও একইরকম প্রাসঙ্গিক। পথে-ঘাটে, অফিসে মেয়েরা নিত্য যৌন হিংসার শিকার; নিজেদের বাঁচানোর নিত্যনতুন উপায় খুঁজে বের করতে হয় তাঁদের। আর মা বা স্ত্রী হিসাবে বাড়ির কাজের দায়দায়িত্ব মেয়েদের অনেক বেশি। পরিসংখ্যান বলে, আজকের ভারতে ১৫-৫৯ বছরের মহিলারা গড়ে দিনে ৩০৫ মিনিট বাড়ির কাজ করেন। আর পুরুষেরা সেই জায়গায় ৮৮ মিনিট এই কাজ করেন।
তাও ইতিহাসটা জানা জরুরি। পূর্বমাতৃকাদের অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারলে উত্তরকন্যারা হয়তো আশা-ভরসা পাবেন খানিকটা; বোঝাপড়া আর লড়াইয়ের কিছু উপায়, অস্ত্রও পাবেন তাঁরা। ক্ষমতায়ন কাকে বলে আর স্বাধীন ভারতে কতটা ক্ষমতায়ন হয়েছে– মেয়েদের সেই প্রশ্নের উত্তর জানতেও ইতিহাসের দিকে ফেরা দরকার। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর এই হিসাবনিকাশের সময় এসেছে বলে মনে হয়।
তথ্যসূত্র
১) জয়া চ্যাটার্জি, The Spoils of Partition: Bengal and India, 1947-1967, কেম্ব্রিজ, ২০০৭।
২) মার্ক মিলার, ‘Working Women and World War II’ The New England Quarterly, ৫৩ঃ১, মার্চ ১৯৮০, পৃ ৪২-৬১।
৩) Women in WWI | National WWI Museum and Memorial
৪) https://thewire.in/gender/in-2024-women-are-still-spending-significantly-higher-time-in-unpaid-domestic-work-than-men-survey
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved