সম্বরণকে বললে আজ যদিও গা করেন না। ফুৎকারে উড়িয়ে বলেন, ‘ধুর, ধুর। হিউমারের আর কী দেখলি তোরা? জানিস, গাভাসকর-বিশ্বনাথের সেন্স অব হিউমার কতটা ছিল?’ না, জানি না। জানার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু এটুকু জানি যে, তাঁর মতো কৌতুকপ্রিয় ক্রিকেটার পশ্চিম বাংলায় খুব কমই আছে।
তুমুল পাখোয়াজই হোক কিংবা নিতান্ত ন্যাদাবোদা, ছোকরা সাংবাদিকের কাছে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বড় বিষম বস্তু! নিরীহ-নির্বিষ প্রশ্নে তাঁর উত্তরের অতর্কিত বাউন্সার যে কখন সাংবাদিক বাবাজীবনের খুলি উড়িয়ে চলে যাবে, বোঝা কঠিন! এই যেমন, এ অধমের উড়েছিল। ক্রিকেট সাংবাদিকতায় গোঁফের রেখা ঠিক করে ফোটেনি তখনও। অপরাধের মধ্যে ফাঁকা সিএবিতে বাংলার দিকপাল অধিনায়ককে ভালমানুষি করে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, ‘সম্বরণবাবু, আছেন কেমন?’ তা, দু’চোখের মণি এক ইঞ্চিও না নড়িয়ে সটান জবাব এসেছিল, ‘ছাপ্পান্ন রকম! তুমি কী রকম চাও?’
বেকুবের মতো হেঁ-হেঁ করে সরে আসা ছাড়া গতি ছিল না। দেঁতো হাসি ছাড়া উত্তর হয় নাকি এর? জন্মাবধি জেনে এসেছি, ‘কেমন আছেন’-এর জবাব চিরকাল গতানুগতিক হয়, হয়ে এসেছে। ‘ভাল আছি,’ ‘এই চলছে,’ ‘কেটে যাচ্ছে’-র পাকদণ্ডীতে বরাবর হারিয়ে যায় বাঙালি লৌকিকতার প্রথম ধাপ। সেখানে কি না ‘ছাপ্পান্ন রকম! তুমি কীরকম চাও?’ এ কী লোক রে বাবা!
যাক গে। সেদিনের মতো অফিস ফিরে কুণ্ঠিত হৃদয়ে বিভাগীয় সিনিয়রকে সবিস্তারে বলায়, প্রথমে একচোট হাসি ‘উপহার’ জুটল। তাপর সোজা সম্বরণের কাছেই ফোনটা গেল। শুনলাম সিনিয়র দাদা ফোনে বলছেন, ‘কী গো মাধুদা? নতুন ছেলে পেয়ে চমকে দিয়েছ? এ তো পুরো ঘেমেনেয়ে একশা!’ দিন কয়েক পর আবার সিএবি, আবার দেখা সম্বরণের সঙ্গে। এবার চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী রে, ঘাবড়ে গিয়েছিলি শুনলাম খুব? শোন, তোর প্রশ্নের আরও একটা উত্তর হয়। লোকে কেমন আছ জিজ্ঞাসা করলেই বলে দিবি।’
সংকুচিত হয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘কী?’
‘মাঝারি!’
আসলে খেলার সাংবাদিকতায় আসার আগে ক্রিকেটার-ফুটবলারদের গন্ডা-গন্ডা ইন্টারভিউ পড়ে একটা ধারণা গজিয়েছিল যে, এঁরা খেলা নিয়ে গড়গড়িয়ে বলতে পারেন বটে। দুর্ধর্ষ বলেন। অনেক কিছু জানা যায়। শেখা যায়। সে শিক্ষা জীবনের অনেক ক্ষেত্রে কাজেও লাগে। কিন্তু খেলোয়াড় মাত্রেই বড় রসকষহীন। কাঠখোট্টা। রসবোধ এঁদের থেকে আশা করা যায় না, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘হিউমার’। যে ধারণা সম্পূর্ণ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন স্বাধীনতাত্তোর বাংলার একমাত্র রনজি-জয়ী অধিনায়ক। সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটকে শিখিয়েছেন, যে খেলার সঙ্গে হাস্যরসের সহবাস সম্ভব, খুব সম্ভব। শিখিয়েছিলেন, যে ক্রিকেট খেলে, যে বল পেটায়, সে পেটে খিলও ধরায়!
সম্বরণকে বললে আজ যদিও গা করেন না। ফুৎকারে উড়িয়ে বলেন, ‘ধুর, ধুর। হিউমারের আর কী দেখলি তোরা? জানিস, গাভাসকর-বিশ্বনাথের সেন্স অব হিউমার কতটা ছিল?’ না, জানি না। জানার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু এটুকু জানি যে, তাঁর মতো কৌতুকপ্রিয় ক্রিকেটার পশ্চিম বাংলায় খুব কমই আছে। সম্বরণই বাংলা ক্রিকেটের জর্জ বার্নার্ড শ। সম্বরণই বাংলা ক্রিকেটের ‘পরশুরাম’! তা সে কেউ মানুক বা না মানুক।
কেউ পারবে নাকি তাঁর মতো মজা করে বাংলার এককালের রনজি দলকে ‘রয় ব্রাদার্স অ্যান্ড ফিউ আদার্স’ বলতে? কেউ পারবে নাকি তাঁর মতো উদীয়মান পেসারের পায়ের গোছকে নিজের কব্জির সঙ্গে তুলনা করতে? কেউ পারবে নাকি তাঁর মতো বিপক্ষ ব্যাটারকে শ্লাঘার মগডালে তুলে তার সাড়ে বারোটা বাজাতে?
পারেনি। পারবেও না।
যার উদাহরণ আছে অঢেল। অকাতর। বাংলা বনাম বাংলাদেশ এক প্রীতি ম্যাচের কথা শোনা যায়। যেখানে পদ্মাপারের ইউসুফ মহম্মদকে কৌতুকের ফাঁদে ফেলে সম্বরণের ‘বিপথগামী’ করা, আজও ময়দানি লোকগাথার গুলমোহর গাছ। খেলা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাট করছে। জনৈক ইউসুফ-ভাই সবে ব্যাট করতে নেমেছেন। বল করছেন এপার বাংলার সুজন মুখোপাধ্যায়। যিনি উইকেট পাননি তখনও। কী মনে হল, স্টাম্পের পিছনে কিপিং গ্লাভস হাতে দাঁড়ানো সম্বরণ দুম করে ইউসুফকে বলে বসলেন, ‘সুজনকেও যদি আপনি না মারতে পারেন, তা হলে আর কিছু বলার নেই ইউসুফ ভাই।’ সাদা মনের ইউসুফ মিঁয়া বিপক্ষ কিপারকে বিশ্বাস করে নির্দ্বিধায় বলেন, ‘দ্যাখেন, মারতে তো আমি পারিই। কিন্তু মিড অনে মদনবাবু (মদন ঘোষ) দাঁড়াইয়া আছেন। আপনি তাইলে অরে আগাইয়া (এগিয়ে) নেন।’ কালবিলম্ব না করে সম্বরণ এরপর মদনকে এগিয়ে আসার নির্দেশ দেন, ডান হাত তুলে! ইউসুফ যা দেখে নিশ্চিন্তে হাতের ব্যাটে মন দিয়েছিলেন। তিনি দেখেননি, ডান হাতের মতো সম্বরণের বাঁ হাতটাও উঠছে সমান্তরাল ভাবে, যা মদনকে নির্দেশ দিচ্ছে একই জায়গায় দাঁড়াতে!
পরিণাম এরপর যা হওয়া উচিত, তাই হয়েছিল। আউট হয়ে হতভম্ব ইউসুফ শেষে সম্বরণকে বলে যান, ‘এইডা কী করলেন আপনে! আমি তো আর চান্সই পামু না!’
বর্তমান জাতীয় নির্বাচক সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভুলতে পেরেছেন তো আজও সম্বরণকে? প্রায় একই ভোগান্তি যে তাঁকেও ভুগিয়েছিলেন দুঁদে বাংলা অধিনায়ক, প্রায় একই প্রলোভন দেখিয়ে। তফাতের মধ্যে খেলাটা ছিল বাংলা বনাম বিহার। প্রীতি ম্যাচের বদলে রনজি ট্রফি। সুজন মুখোপাধ্যায়ের বদলে বোলার ছিলেন অরূপ ভট্টাচার্য। তা, সে ম্যাচে সুব্রত স্টান্স নেওয়া মাত্র নাকি সম্বরণ তাঁর কানের কাছে বলতে শুরু করেন, ‘শোন, তোকে না গদা (অরূপ ভট্টাচার্য-র ডাকনাম) ড্রেসিংরুমে খুব গালাগাল করে। আজ শায়েস্তা করে দে।’ চোখ পাকিয়ে সুব্রত ‘তাই?’ বলে অরূপের প্রথম বলটাই উড়িয়ে দেন গ্যালারিতে। সম্বরণ যা দেখে খুবই বিচলিতভাবে এরপর বলেন, ‘শোন একটায় থেমে থাকিস না। একটায় কিছু হবে না। তিন-চারটে দে। তবে না বুঝবে ব্যাটা।’ এ জিনিস শোনার পর ফের স্টেপআউট করা ছাড়া উপায় ছিল না সুব্রত-র। সম্বরণেরও উপায় ছিল না স্টাম্পড করে বিনম্রভাবে সুব্রতকে ‘এবার তুই বাড়ি যা’ বলা ছাড়া!
কিন্তু কখনও কি নিজে ভোগেননি? আপনার দিকে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসেনি আপনারই কৌতুক?
‘এসেছে তো,’ সহাস্যে বলে দেন বঙ্গ ক্রিকেটের বর্ণময় চরিত্র। ‘গাভাসকর একবার ৩৪০ করেছিল আমাদের বিরুদ্ধে। ও একশো করে রান করছিল, আর আমি বোলারকে বলছিলাম, নে এবার যাবে! শেষে তিনশো চল্লিশ করার পর সানি আমায় বলল, আভি তক হুয়া নেহি রে সম্বরণ!’
শুনলে হাসি পায়। ভারি মজাও লাগে। আসলে খেলাধুলোয় সব রকম চরিত্রই বড় প্রয়োজন। খেলার একটা বিরাট কোহলির মতো আগুন লাগে। মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো বরফ লাগে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর জেদ লাগে। লাগে লিওনেল মেসির মায়া। আর অবশ্যই লাগে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষদের। অধুনা কর্পোরেটের কৃত্রিমতার ফাঁদে হাঁসফাঁস করা খেলাকে তার পুরনো উচ্ছ্বল স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে পারেন যাঁরা। যাঁরা পারেন খেলা নিয়ে অবলীলায় খেলা করতে। যাঁরা ইন্ডিয়া ক্যাম্পে বসে বছর ছাব্বিশের সতীর্থকে ফর্ম ফিল-আপের সময় বয়স পনেরো লিখতে দেখে সকৌতুকে নিজের ফর্মে লিখে আসতে পারেন, ‘আমার এখনও জন্মই হয়নি!’
বিশ্ব ক্রীড়াক্ষেত্র যে বাঁকে দাঁড়িয়ে, তাতে ভবিষ্যতের সাক্ষী মালিক, মনিকা বাত্রা, লক্ষ্য সেনদের বিকল্প পথের কথা ভাবতে শুরু করতে হবে। কমনওয়েলথ গেমসকে ভুলে অলিম্পিক, এশিয়াডের প্রস্তুতি হিসেবে পাখির চোখ করতে হবে নিজ খেলার আঞ্চলিক, মহাদেশীয় ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপগুলোকে।