একথা বলেছিলেন লর্ড কার্জন। বঙ্গভঙ্গের কথা বললেও কার্জন মোটেই চাননি যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরে যাক। তাঁর মতে বন্দর-শহর আর বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে কলকাতা সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। দিল্লি সেই তুলনায় ভৌগোলিকভাবে আবদ্ধ এক শহর, যেখান থেকে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের বিশেষ কোনও সুবিধে নেই। তাছাড়া, কার্জনের মনে হয়েছিল যে দিল্লিতে রাজধানী তৈরি হলে ব্রিটিশ সরকার জনগণের থেকে আরও দূরে সরে যাবে। কলকাতায় সেই সম্ভাবনা নেই। ১৯০১ সালে মহারানির মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে যে বিশাল সৌধ বানানো হবে ঠিক হয়, তার জন্য কলকাতা ছাড়া অন্য কোনও শহরের কথা তিনি ভাবতেই পারেননি।
২২.
জর্জ ন্যাথানিয়েল কার্জনকে বাঙালি মনে রেখেছে বঙ্গভঙ্গের কুখ্যাত রূপকার হিসেবে। বড়লাট হিসেবে তাঁর নির্দেশেই বাংলা প্রদেশকে ভাগ করে বাড়তে থাকা ব্রিটিশ-বিরোধী কার্যকলাপে রাশ টানার কথা ভাবে ঔপনিবেশিক সরকার। ফলে কলকাতায় কার্জনের নামে পার্ক বা বর্ধমানে গেট থাকলেও বাঙালির বিশেষ অপ্রিয় পাত্র এই বড়লাট। অনেক সময়েই তাই আমাদের খেয়াল থাকে না যে তিনি ছিলেন এক বিশুদ্ধ কলকাতা-প্রেমী। কলকাতা নিয়ে কার্জনের বক্তব্যে নিঃসন্দেহে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের রেশ ছিল, কিন্তু তবুও এই শহরকে তিনি নানাভাবে সাজানোর কথা ভেবেছেন, শহরের গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছেন, সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে কলকাতার অনন্যতাকে স্বীকার করেছেন।
লর্ড কার্জন ভারতের প্রাচীন সৌধ সংরক্ষণ করা নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর আমলে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগে নানা পরিবর্তন আসে। ১৯০৪ সালে ‘এনশিয়েন্ট মনুমেন্ট প্রিজার্ভেশন অ্যাক্ট’ নামে নতুন আইন প্রণয়ন করেন তিনি। তাজ মহলের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ভারতের অতীত আর ঐতিহ্য নিয়ে এই চিন্তাভাবনা সাম্রাজ্যবাদী ধ্যানধারণার অংশই ছিল বলা চলে। কার্জন মনে করতেন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মূল স্তম্ভ হচ্ছে ভারতবর্ষ, তাই এই দেশকে ঠিকঠাক ভাবে পরিচালনা করতে হবে, দরকার মতো তার রক্ষণাবেক্ষণ করে।
অন্যদিকে, কলকাতা ছিল কার্জনের এক প্রিয় শহর। এই শহরকে তিনি বলেছেন ‘স্মৃতিদের এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র’। এর পরতে পরতে রয়েছে অতীতের চিহ্ন। তবে সেই অতীত সাম্রাজ্যের অতীত, ব্রিটিশ গৌরবের এক বিশেষ নিদর্শন। এশিয়ার মাটিতে যেন এক ইউরোপীয় শহর। এবং ইংরেজ জাতির উদ্যম ও কৃতিত্বের এক অভিনব নিদর্শন। তাঁর কথায়:
Calcutta is the capital, not merely of a province, great as that province is, but of the Indian Empire. As such, it appears to me fitly to symbolise the work that the English have done, and are doing, in this country. For though, of the enormous population of over 1,100,000 souls that make up the city on both banks of the river, not much more than 30,000 are returned as Europeans and Eurasians, yet a glance at the buildings of the town, at the river and the roar and smoke, is sufficient to show that Calcutta is in reality a European city set down on Asiatic soil, and that it is a monument, in my opinion one of the most striking extant monuments, for it is the second city to London in the entire British Empire—to the energy and the achievements of our race.
বঙ্গভঙ্গের কথা বললেও কার্জন মোটেই চাননি যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরে যাক। তাঁর মতে বন্দর-শহর আর বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে কলকাতা সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। দিল্লি সেই তুলনায় ভৌগোলিকভাবে আবদ্ধ এক শহর, যেখান থেকে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের বিশেষ কোনও সুবিধে নেই। তাছাড়া, কার্জনের মনে হয়েছিল যে দিল্লিতে রাজধানী তৈরি হলে ব্রিটিশ সরকার জনগণের থেকে আরও দূরে সরে যাবে। কলকাতায় সেই সম্ভাবনা নেই। এখানে সরকার প্রতিনিয়ত জনগণের মতামত জানতে পারে, দেশের হাল হকিকত সব টের পাওয়া যায় এই শহরে বসে। কলকাতার সমাজে নানাবিধ লোকের সমাহার– ইউরোপীয় আর দেশীয় জজ, উকিল; ডাক্তার বদ্যি, ব্যবসাদার, ব্যাঙ্কের লোক, প্রাদেশিক সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের পর্যটক আর মানীগুণিজন। কার্জনের ভাষায়, “It was life, and when, after my long residence at Simla, I went on my tours in the country in Calcutta I felt once again life and movement throbbing around me. I say distinctly that our time at Calcutta was of enormous value to the Government. It brightened our minds, it widened our outlook, it brought us into the main stream of national life.” তাই দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত হলে দেশের মানুষের সঙ্গে এই সংযোগ হারাবে ব্রিটিশ সরকার। কলকাতার প্রতি কার্জনের একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। ১৯০১ সালে মহারানির মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে যে বিশাল সৌধ বানানো হবে ঠিক হয়, তার জন্য কলকাতা ছাড়া অন্য কোনও শহরের কথা তিনি ভাবতেই পারেননি।
কলকাতার অতীত নিয়ে চর্চা করার জন্য শহরের ইউরোপীয় জনগণ ১৯০৭ সালের এপ্রিল মাসে গঠন করেন ‘দ্য ক্যালকাটা হিস্টরিক্যাল সোসাইটি’। আর সেই বছরের জুলাইতে এঁদের হাত ধরেই প্রকাশনা শুরু হয়েছিল বিখ্যাত পত্রিকা, বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট-এর। সোসাইটির তরফে ওয়াল্টার ফার্মিঙ্গার তাঁর প্রারম্ভিক ভাষণে বলেন যে এই সভার মূল লক্ষ্য হল ‘সময়ের’ নিষ্ঠুর হাত থেকে কলকাতার অতীতকে রক্ষা করা। পুরনো কলকাতা চিরতরে হারিয়ে যাতে না যায় সেদিকে নজর রাখা:
The programme of work which the Society has adopted is enormous. For it will be our business not only to investigate the records of the past, but to stay the hand of Father Time as that reckless old person wipes his ruthless sponge over the slate on which we, the Calcutta men of to-day, are calculating the problems of our daily life. “Lest they forget” is to be as much our motto as “lest we forget”. Old houses are not to be suffered to disappear before they have been immortalized by our photographers, and a vigilant eye is to be kept over every crumbling ruin.
উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকেই বেশ কিছু ইংরেজ লেখক কলকাতার অতীত নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বলা বাহুল্য, তাঁদের লেখা কলকাতার ইতিহাসে ছিল মূলত ইংরেজ কলকাতার কথা, ফিরে দেখা কীভাবে কোম্পানির আমল থেকে কলকাতা সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর হয়ে উঠল। হিস্টরিক্যাল সোসাইটির উদ্দেশ্যও খানিক একইরকম ছিল। আর অতীতচর্চার এই সুরটাই বিশেষ পছন্দের ছিল কার্জনের। সোসাইটির গোড়াপত্তনের আগেই কার্জন বিলেতে চলে গিয়েছেন। কিন্তু এই খবর পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে চিঠি পাঠান সোসাইটির ঠিকানায়। অভিনন্দন জানিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দেন সোসাইটির সদস্যদের। কলকাতার ‘ইতিহাস’ বোঝার জন্য কী কী করতে পারেন তাঁরা, তার এক তালিকা তৈরি করেন তিনি। সদস্যদের বলেন যে খুঁজে দেখতে ঠিক কোথায় ওয়ারেন হেস্টিংস আর ফিলিপ ফ্রান্সিস ডুয়েল লড়েছিলেন, আলিপুর অঞ্চলে কোন কোন বাড়িতে হেস্টিংস বসবাস করেছিলেন, বা কোন বাড়িতে ঔপন্যাসিক উইলিয়াম থ্যাকারে জন্মেছিলেন। এ ছাড়াও বলেন যে খুব মন দিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে যে সব পুরনো কাগজপত্র বস্তা-বন্দি হয়ে নষ্ট হওয়ার উপক্রম, সেগুলি জোগাড় করা প্রয়োজন।
এই ইতিহাসচেতনা নিঃসন্দেহে কলকাতার এক তরফা অতীতের দিকেই আমাদের ঠেলে দেয়, যেখানে ভারতীয়দের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। শহরের অতীত ও ঐতিহ্য নির্মাণের এক বিশেষ মুহূর্ত ছিল বিশ শতকের গোড়ার বছরগুলি। এই সময়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটছে, কলকাতা পুরসভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের গলার জোর বাড়ছে, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে প্রথমবার শহরের রাস্তায় মানুষ মিছিল বের করছেন– ফলে বোঝাই যাচ্ছিল কলকাতার দাবিদার অনেক, শুধু ব্রিটিশ রাজপুরুষদের নয় এ শহর। শাসক আর শাসিতের এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই ঔপনিবেশিক শহরের অতীত নির্মিত হতে শুরু করে বিশ শতকের কলকাতায়।