আমি ডোমকে লক্ষ করি। মনে হয় আগের শতাব্দী থেকে উঠে এসেছেন। খালি গা, কোমরে টাইট করে বাঁধা গামছা। হাতে ধরা লম্বা বাঁশ দিয়ে এই চিতা থেকে ওই চিতা খুঁচিয়ে চলেছেন। মাঝে মাঝে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন একটু দূরে মাটিতে রাখা বোতল থেকে অথবা বটগাছের নীচে বসা জটাধারী সাধুবাবার কাছ থেকে ধার করে লম্বা টান মারছেন কলকেতে। পোড়া শরীরের গন্ধর সঙ্গে অবলীলায় মিশে যাচ্ছে তূরীয় পারফিউম।
যে সময়ে শিশু থেকে কিশোর হয়েছি, সেই অস্থির দিনকালে মূল্যবোধ দুর্মূল্য ছিল। বাড়িতে যে পরিবেশ, গান্ধীজির প্রভাব বলা যেতে পারে। অথবা বিবেকানন্দ বা কার্ল মার্কসের– তাতে জাতপাতের ভেদাভেদ মাথায় ঢোকেনি কখনও। পাড়ার রকের কোণে যে মুচি বসত তার নাম বাবলু, আমার দাদার বয়সি। তার পাশে বসেই জুতো সেলাই দেখতাম। পালিশ আর আঠার গন্ধে নেশা লেগে যেত। একইভাবে বাড়িতে সরস্বতী পুজোর সময় পাশের বাড়ির চক্কোত্তিমশাই নৈবেদ্য সাজাচ্ছেন, কোলে চড়ে বসেছি। একবার, কর্পোরেশনের এক বয়স্ক কর্মী, যিনি রোজ সকালে নিষ্ঠাভরে ঝাঁট দিতেন আমাদের গলি আর অবলীলায় রাস্তার মাঝখান থেকে ছেঁড়া কাগজে তুলে নিতেন কুকুর বা মানুষের বিষ্ঠা এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ, ‘আঃ’ বলে চেঁচিয়ে পা ধরে বসে পড়লেন। একটি পেরেক ফুটেছে এবং রক্ত। ধরাধরি করে তাঁকে নিয়ে আসা হল বৈঠকখানায়। আমার মামা, যিনি চিরকাল খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ধুতি, বললেন ওঁর রক্তাক্ত পা আমার কোলের ওপর রাখতে। আমিও হাত লাগালাম। ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে তারপর অ্যান্টি-টিটেনাস ইঞ্জেকশন, যদিও উনি ডাক্তার ছিলেন না। এইসব অভিজ্ঞতার ফলে জাত সংক্রান্ত কোনও শুচিবাই আমার মাথায় জায়গা পায়নি কখনও। কয়েকটি বাড়িতে জমাদার বাথরুম পরিষ্কার করে যাওয়ার পর এক বালতি জল ঢেলে দালান শুদ্ধ করতে দেখেছি অবিশ্যি।
এই ট্রেনিং সত্ত্বেও ‘ডোম’ শব্দটি কিন্তু ভয়ের সঞ্চার করত মননে। কারণ ডোমের সঙ্গে মৃতরা জড়িত। কিছুটা ঘৃণাও থাকত কি? না কি হাইজিন চিন্তা? শুনেছিলাম বিডন স্ট্রিটে, গঙ্গার দিকে যাওয়ার পথে, রামবাগান অঞ্চলে কয়েকঘর ডোম থাকেন। তাঁরা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে চুবড়ি তৈরিতে পারদর্শী। ছোটখাটো একটি কুমোরটুলিও ছিল। কিন্তু আমার কাছে এই ডোম সেই ডোম নয়। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় ডোমরূপী শত্রুঘ্ন সিনহার পোস্টার দেখে পছন্দ হয় না। ততদিনে মৃতদেহ দেখেছি অনেক, কিন্তু শ্মশান দেখিনি সেভাবে। তাই এক সন্ধে বিনিয়োগ করি নিমতলায়, আমাদের মণিকর্ণিকায়। ইতিউতি কাঠের চিতা জ্বলছে। মৃতদের পরিবারের লোকজন একটু দূরে। কেউ হাউ হাউ করে কাঁদছেন, কেউ ফুঁপিয়ে, আবার অনেকে একেবারে চুপ। আমি ডোমকে লক্ষ করি। মনে হয় আগের শতাব্দী থেকে উঠে এসেছেন। খালি গা, কোমরে টাইট করে বাঁধা গামছা। হাতে ধরা লম্বা বাঁশ দিয়ে এই চিতা থেকে ওই চিতা খুঁচিয়ে চলেছেন। মাঝে মাঝে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন একটু দূরে মাটিতে রাখা বোতল থেকে অথবা বটগাছের নীচে বসা জটাধারী সাধুবাবার কাছ থেকে ধার করে লম্বা টান মারছেন কলকেতে। পোড়া শরীরের গন্ধর সঙ্গে অবলীলায় মিশে যাচ্ছে তূরীয় পারফিউম।
প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা মা-কে নার্সিংহোম থেকে বের করে রাস্তায় দাঁড়ানো শববাহী গাড়ির সামনে রাখলেন কর্পোরেশনের কর্মীরা। দাদা আর আমি, মুখে মাস্ক, নিয়ম মেনে দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছি। ভাগ্যিস কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ, তাই ব্যাগের মাথার দিকটা ট্রান্সপারেন্ট। মা-র মুখ দেখা যাচ্ছে। জানা গেল ধাপা যেতে হবে না, নিমতলায় একটি আলাদা চুল্লির ব্যবস্থা আছে। তবে বাইরে থেকেই দেখতে হবে ওই যজ্ঞ। সেদিন রবিবার ছিল, প্রায় ঝড়ের গতিতে পৌঁছে গেলাম। বলা হল একটি বডি আছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারপরেই মা-র পালা। ওঁকে চুল্লির সামনে শুইয়ে দিল ওরা। আমরা সিঁড়ির নীচে, লো অ্যাঙ্গেল শটে মা-কে দেখছি। কিন্তু ডোম কোথায়? আমি জিগ্যেস করলাম, কাজটা করবে কে? দালানের ওপর দেওয়ালের গা-ঘেঁষে চাদর পাতা। বাঁ-হাতের ওপর মাথা রেখে একটি কমবয়সি ছেলে শুয়ে আছে। ২৫-২৬ হবে হয়তো। কানে হেডফোন গোঁজা, অন্য হাতে মোবাইল, ল্যান্ডস্কেপ মোডে ধরা। সিনেমা দেখছে। শববাহী গাড়ির ড্রাইভার তার কাছে গিয়ে কিছু বলল। সে মোবাইল ধরা হাত তুলে ইঙ্গিত করল, আমি তো আছি। নিশ্চিন্ত হলাম। সময় এলে ছেলেটি যখন উঠে দাঁড়াল, ওই হাফপ্যান্ট, বোতাম খোলা জামার ফাঁক দিয়ে ফুটে বেরনো সুঠাম শরীর নিয়ে, তাকে আমার ‘মাসান’-এর ভিকি কৌশল মনে হল। সে, আমি আর মা একটি ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দু। মৃতদেহর সামনে গিয়ে সে ঘাড় ঘোরায়, সম্মতির প্রত্যাশায়। তারপর ফার্নেসের দরজা খোলে, কারণ আগুন তর সয় না। ঘণ্টাখানেক পর কাজ মিটে গেলে মনে হয়, যদি একবার ধরতে পারতাম তার হাত, ভালো লাগত। যে হাত মুখাগ্নি করল আমার মা-র। ততক্ষণে আরেকটি কোভিড বডি শুয়ে পড়েছে তার বিছানার পাশে।