জঙ্গলমহল থেকে আবার খবর আসছে বারুদের গন্ধমাখা। আবার সেই মধ্যসত্ত্বভোগীদের অত্যাচার, জমিদখল, কৃষক খেতমজুরদের ওপর দমনপীড়ন। কী অদ্ভুতভাবে জেলের বাইরের সঙ্গে ভেতরের যোগাযোগ রাখে সংগঠন। বিচারভবনের পুলিশ লকআপেই যেন বসল কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক।
৭.
বিচার ভবন। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের লাগোয়া। একটু বেশি নিরাপত্তা। পুলিশের সঙ্গে বিশেষ বাহিনী। গুরুত্বপূর্ণ বন্দিদের মামলা থাকলে এমন হয়। তাঁদের রাখাও হয় আলাদা লকআপে। এখন মাওবাদীদের মামলা, তাই এত আয়োজন। সিআরপিএফ ক্যাম্পের ওপর হামলার মামলা। পুলিশ আসল হামলাকারীদের ধরতে পারুক বা না-ই পারুক, যেখানে যতজন ছিলেন, এই মামলায় সবাইকে জুড়েছে পুলিশ। দীর্ঘকাল ধরে এঁরা জেলবন্দি। কেউ আসেন প্রেসিডেন্সি জেল থেকে, কেউ দমদম, কেউ হুগলি, কেউ মেদিনীপুর, কেউ বর্ধমান থেকে। মাঝেমধ্যে জেল ট্রান্সফার হয়। মামলার দিন কোর্টে ‘গেট টুগেদার’।
এর আগে, পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পড়তেও জোর বেঁচে গিয়েছিল সুনেত্রা। সে এক নাটকীয় ঘটনা। শেষ মুহূর্তে তাঁকে বাঁচিয়ে নিয়ে পালায় কমরেড বিষ্ণু। সুনেত্রা-কাণ্ড নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। সে যেন ‘পথ হারাবো বলেই’ পথে নেমে পড়া। সুনেত্রা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। জঙ্গলজীবন থেকে দরকার ছিল নিরাপত্তা। লক্ষ্য ছিল অন্ধ্র সীমান্তে মাওবাদীদের মহিলা ও শিশুদের ক্যাম্পে পৌঁছনো। তার আগে শহরতলির নিবারণ কুড়ি লেনে ছদ্মপরিচয়ে আত্মগোপন করেছিলেন সুনেত্রা, বিষ্ণু। ওই এলাকায় আরও দু’-চার ঘর মাওবাদী ওইভাবে এলাকায় মিশেছিলেন। তাতে অন্যদের প্রোটেকশন দিতে সুবিধে হয়। পুলিশ কিন্তু খবর পেয়ে গিয়েছিল সুনেত্রা ছদ্মপরিচয়ে ওখানে আছে। অফিসার রাহুল মিত্রও পরিচয় বদলে সেখানে ভাড়া নিয়ে চলে আসে। খুঁজতে হবে মাওবাদীদের। ওদিকে জেলে বন্দিদশায় বসে দুই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাওবাদী নেতা রুদ্র আর বিশাল তাঁদের পুলিশ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে খবর পেয়ে যান সুনেত্রাকে খুঁজতে ছদ্মবেশী গোয়েন্দা ঘুরছে। জেল থেকে চলতে থাকে অপারেশন, সুনেত্রাকে বাঁচাতে হবে। তখন নিবারণ কুড়ি লেনে এক নীরব নাটক চলছে, পুলিশ আগে সুনেত্রার খোঁজ পায়, নাকি, মাওবাদীরা ধরে ফেলে কে গোয়েন্দা। এত মুখের ভিড়ে এক টানটান নজরদারির জীবন বাজি রাখা অভিযান। শেষ পর্যন্ত রাহুল জানতে পারে বটে সুনেত্রা কে, কিন্তু ততক্ষণে সাপের মতো মারাত্মক বিষ্ণু জেনে গিয়েছেন রাহুল কে। পাড়ার সেলুনের কর্মীর পরিচয়ে ছিলেন বিষ্ণু। রাহুল সুনেত্রাকে ধরতে পুলিশ ফোর্স ডেকে সময় কাটাতে সেলুনে ঢুকে দাড়ি কাটছিল। তুমুল বৃষ্টি। দোকান ফাঁকা, অনেক রাত। বিষ্ণু রাহুলের গলায় গভীর ক্ষুরের ক্ষত তৈরি করে সুনেত্রা আর আরও দু’একজনকে নিয়ে পালান। পুলিশ ফোর্স ঢুকে রাহুলকে বাঁচাতে পেরেছিল বটে, কিন্তু কাউকে ধরা যায়নি। আফসোসে মানসিক অবসাদে চলে গিয়েছিল রাহুল। শরীর, মন সারিয়ে কাজে ফিরতে সময় লেগেছে। তবে, একটা উপকার হয়েছে, বিষ্ণু আর পুলিশের কাছে অচেনা নেই। রাহুলের এটা একটা সাফল্য, বলছেন কর্তারা। তার কাছ থেকে বর্ণনা নিয়ে পুলিশের আর্টিস্ট ছবি এঁকেছে, সেই ছবি পাঠানো হয়েছে সব থানায়। মিডিয়াতেও হইচই। আর হইচই মাওবাদী মহলে, এমনকী, জেলেও। পুলিশ তো জানেই জেল থেকে অপারেশন চলেছে। ফলে এলোপাথাড়ি জেল ট্রান্সফার। প্রথম ক’দিন কেউ বুঝতেই পারেননি কে কোন জেলে গিয়েছেন। তারপর ছিটকে আসা খবর। কোর্টে মামলার দিন পড়লে সবার সঙ্গে দেখা, কথা। তখন বোঝা যায়।
‘অপারেশন সুনেত্রা’ সফল হওয়ার পর জেল ট্রান্সফারের ধাক্কা সামলে প্রথম কোর্টে সবাই ধন্যবাদ জানিয়েছেন কমরেড রুদ্র আর বিশালকে। যাঁরা এই মামলায় কোর্টে এসেছেন, যাঁরা অন্য মামলায় জেলে আছেন, খবর রটেছে হাওয়ার গতিতে।
এখন এই যে এবারের কোর্ট, ইদানীং আলাপের আলোচ্য বদলেছে। বিশাল বলছিলেন, ‘কমরেড, আমাদের কাজের শেষ নেই। রাষ্ট্র যতদিন দমনপীড়ন চালাবে, আমাদের দায়িত্ব পালন করেও যেতে হবে।’
রুদ্র ভাবছিলেন, মামলা শেষ হয়েও হচ্ছে না। মুক্তি এসেও আসছে না। আর মুক্তির পর? সেই মোক্ষম প্রশ্ন, মেয়ে বলছে, এসো, বাড়িতে অপেক্ষায় আছি। আর মেয়ের মতো কমরেড সুনেত্রারা বলছে, ‘আসুন, নেতৃত্ব দিন, অপেক্ষায় আছি।’
জঙ্গলমহল থেকে আবার খবর আসছে বারুদের গন্ধমাখা। আবার সেই মধ্যসত্ত্বভোগীদের অত্যাচার, জমিদখল, কৃষক খেতমজুরদের ওপর দমনপীড়ন। কী অদ্ভুতভাবে জেলের বাইরের সঙ্গে ভেতরের যোগাযোগ রাখে সংগঠন।
বিচারভবনের পুলিশ লকআপেই যেন বসল কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। কমরেড বিশাল বললেন, ‘কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি। আর একটা ভালো খবর, কমরেড ব্রহ্মা নিজে ওখানে আছেন, সব নজর রাখছেন।’
(চলবে)