ইতালির বিখ্যাত স্ট্রাইকার ফিলিপ্পো ইনজাঘি একবার একটা কথা বলেছিলেন। ইনজাঘি বলেছিলেন যে, ‘ডার্বি তুমি খেলতে নামো না। জিততে নামো।’ হক কথা। লাখ টাকার এক কথা। কিন্তু মহাশয় আসল ডার্বি খেললেন কোথায়? মিলান ডার্বি অবশ্যই বড়। কিন্তু কলকাতা ডার্বির পাশে? রামোঃ!
‘পরের জন্মে আমি এর প্রতিশোধ নেব। নেবই। মোহনবাগানের ফুটবলার হয়ে জন্ম নিয়ে…।’
বিব্রত বিবৃতি নয়, এ এক চিঠি। এক মৃতের শেষ চিঠি, পোশাকি নাম যার ‘সুইসাইড নোট’। এ চিঠি হয়তো লেখা হয়েছিল কোনও এক মুষড়ে পড়া সন্ধেয় কিংবা এক অনির্বাণ দহনের রাতে। এ লেখা লিখেছিল যে, লিখে আর ভাবেনি। চলে গিয়েছিল সব ছেড়েছুড়ে। প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। পুনর্জন্ম তার হয়েছিল কি না, পুনর্জন্মে সে মোহনবাগানের হয়ে কখনও খেলেছিল কি না, জানা নেই। জানার উপায়ও নেই। শুধু এ চিঠির লয়-ক্ষয় অ্যাদ্দিনেও হল না! অক্ষয় অনুযোগ হয়ে সে আজও পড়ে আছে এই বাংলায়, হাহাকারের দলিল হয়ে, মরুভূমিতে পথ হারানো তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো। যার বিনাশ নেই। যার মুক্তি নেই।
এ চিঠি প্রায় ৫০ বছর আগের চিঠি। পঁচাত্তরের পাঁচ গোলের অনলে দগ্ধ এক সমর্থকের চিঠি, এক ডার্বি শেষের চিঠি।
এ উমাকান্ত পালধির চিঠি। এ তাঁরই শেষের কবিতা!
উমাকান্ত পালধিকে আমি দেখিনি। তবে উমাকান্ত পালধিদের দেখেছি। ডার্বি এলেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ঠিক, হচ্ছেও যুগ-যুগ ধরে। আর সব উমাকান্তই সবুজ-মেরুন নন, কেউ কেউ লাল-হলুদও। গত রবিবার ডুরান্ড ফাইনাল দেখেননি? দশ জনের মোহনবাগানকে বাগে পেয়েও ইস্টবেঙ্গল যখন হারছিল, যুবভারতীতে একজোড়া কিশোর-চোখ কেমন কাঁদছিল? ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। পিতৃশোকে মানুষ করে যেমন, যতটা এলোমেলো হয়ে যায়। পাশে দেখলাম, এক অগ্রজ। ছেলেমানুষ লাল-হলুদকে যে অবিরাম সান্ত্বনা দিচ্ছে। মুছিয়ে দিচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা জলের কুচি। আচ্ছা, ওই কিশোরও কি কাঁচা-হাতে কোনও চিঠি লিখতে চেয়েছিল কি? হিম্মত-সহ ফিরে আসার শপথ নিয়ে? পরজন্মে?
ফুটবল প্রেম বড় বিষম বস্তু। যার হয়, তার হয়। প্রেমিকার হাত ছাড়লেও, ফুটবলের হাত ছাড়া যায় না। আর ফুটবল ক্লাবেরাও অবিকল মায়ের মতো। জীবনের শুরু থেকে শেষ, আঁচলে জড়িয়ে রাখে ঠিক। কলকাতা ফুটবল আরও ভয়ানক, ক্রূর, বেশরম, বেপরোয়া। অবহেলার বন-বাদার, জল-কাদার বুনো ঘ্রাণ মেখে তার বড় হওয়া। আর শেষে দুদ্দাড়িয়ে এক আবেগ-নদীর দু’পাড়ে ছুটে যাওয়া। এক পাড়ের নাম মোহনবাগান। আর এক পাড় ইস্টবেঙ্গল। মাঝে মাঝে যাদের দেখা হয় এই বাংলায়, এক পলাশির মাঠে, নাম যার ডার্বি!
ইতালির বিখ্যাত স্ট্রাইকার ফিলিপ্পো ইনজাঘি একবার একটা কথা বলেছিলেন। ইনজাঘি বলেছিলেন যে, ‘ডার্বি তুমি খেলতে নামো না। জিততে নামো।’ হক কথা। লাখ টাকার এক কথা। কিন্তু মহাশয় আসল ডার্বি খেললেন কোথায়? মিলান ডার্বি অবশ্যই বড়। কিন্তু কলকাতা ডার্বির পাশে? রামোঃ! আছে নাকি তার কোষাগারে কোনও এক উমাকান্ত পালধির আত্মত্যাগ? নাকি আছে এক অভিশপ্ত ১৬ আগস্ট, যা রক্তস্নানে কেড়ে নিয়েছিল ১৬টা তাজা প্রাণ? নাকি পাওয়া যায় সেখানে উসকোখুসকো চুল আর অবিন্যস্ত চেহারার উদাহরণ, যে মাঠে ঢুকতে দেরি হওয়ার সাফাইয়ে বলেছিল, ‘কিছু মনে কইরেন না কত্তা। পোলাডারে পোড়াইয়া আইতে গিয়া একটু দেরি হইয়া গেল!’
হলফ করে বলতে পারি, মিলান ডার্বি শেষে পিৎজা আর পাস্তায় ভাগ বাঁটোয়ারা হয় না। এ বাংলায় হয়। মোহনবাগান জিতলে বাজারে ওঠে চিংড়ি, ইস্টবেঙ্গল জিতলে ইলিশ। বিন্দুমাত্র খোঁজ না নিয়েও লিখতে পারি, সমর্থকদের প্রয়াণে বাংলার মান্না দে’র মতো কেউ সন্তপ্ত গানও ও দেশে কেউ লিখতে বসে না। ইতালি ছাড়ুন, কোনও দেশেই কি হয়? ম্যাঞ্চেস্টার ডার্বিই হোক কিংবা বার্সা-রিয়াল, কোথাও কি হয়? কোথাও কি প্রিয় টিমের হারে শুরু হয় ‘অ-রন্ধন’, জয়ের সঙ্গে অবলীলায় জুড়ে যান অস্কারজয়ী পরিচালক? কেন, ‘জন-অরণ্য’ মনে নেই? ভুলে গিয়েছেন তার বহুল চর্চিত ফিল্ম সংলাপ?
‘দাদা, পাস না অনার্স?’
‘মোহনবাগান!’
কী করা যাবে, ঘটি-বাঙালের সম্পর্কই এমন। একদলের সম্পদ পশ্চিমবঙ্গের ভিটেমাটি, আর একদলের পূর্ববঙ্গের দুঃখের হাওয়া-বাতাস। ঘৃণা আর ভালবাসা এখানে হাতে-হাত ধরে চলে। খেলার মাঠে এরা একে-অন্যকে দুয়ো দেয়, চটুল টিফো বানায়, বাছা-বাছা বিশেষণে সম্ভাষণ করে। আবার এক পক্ষের বিপন্নতা দেখলে, আর এক পক্ষ অবধারিত গর্জে ওঠে। ‘শ্ব-দন্ত’ বের করে তীব্র আক্রোশে ধেয়ে যায় তৃতীয় পক্ষের দিকে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর পরের পর হারে বক্রোক্তি ছেড়ে একদিন সস্নেহে লেখে, ‘চল, চল, ওঠ। কিচ্ছু হয়নি। তোকে আরও ১০০ বছর খেলতে হবে!’ পাওয়া যাবে বিলেতে এ জিনিস? পাওয়া যাবে ইউরোপে? বিত্ত ও অগ্রগতি বিচারে ভারত এখনও তৃতীয় বিশ্বের দেশ। ফুটবলে তো পঞ্চম বিশ্বের। কিন্তু তার পরেও আমাদের আছে এক রাজ-মণি, যা আর কারও নেই।
আমাদের একটা ডার্বি আছে!
আমাদের একটা ডার্বির মতো ডার্বি আছে!