ব্যাকস্টেজের এই কাজকর্ম আমাকে আকৃষ্ট করেছে বরাবর। সত্যি বলতে, এই প্রস্তুতি জোরদার না হলে পাঁচটা দিন এতখানি নিয়মে বাঁধা, সুশৃঙ্খল এবং সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে না। কী নিখুঁত সেই প্রস্তুতি-প্রক্রিয়া! যে কোনও কর্পোরেট ইভেন্টে যাঁরা নেপথ্যের প্রস্তুতি শিখতে চান, তাঁরা অনায়াসে এই কাজে চোখ রাখতে পারেন।
বাঙালি পুজো ভালবাসে। তবে বলুন দেখি, একটা পুজোয় ঠিক কী কী সামগ্রী লাগে? তা-ও যদি আবার দুর্গাপুজো হয়, তবে তো কথাই নেই! আমি জানি, অনেকেই এর উত্তর দিতে গিয়ে হোঁচট খাবেন। তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা বাইরে থেকে আমরা পুজো যেভাবে দেখি, তাতে নেপথ্যের কাণ্ডকারখানা অনেকটাই আড়ালে চলে যায়। আর ঠিক সেখানেই অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায় বাড়ির পুজো।
পুরোহিতদর্পণ-এর সঙ্গে হয়তো অনেকেরই পরিচয় আছে। পুরোহিতের ‘টেক্সট বুক’ বলা যায় একে। দশকর্মা দোকানে যাঁদের কিঞ্চিৎ যাতায়াত আছে, তাঁদের চোখে পড়েছে দুর্গাপুজো-পদ্ধতি। সেখানে পুজোর আচার-উপাচার লেখা থাকে। সেগুলো তো জোগাড় করতেই হয়। তবে, তার বাইরেও থাকে এক বড় কর্মযজ্ঞ। সব জিনিসপত্র জোগাড় না হলে পুজো হবেই বা কী করে, আর পুরোহিত মন্ত্রই বা পড়বেন কী করে! ব্যাকস্টেজের এই কাজকর্ম আমাকে আকৃষ্ট করেছে বরাবর। সত্যি বলতে, এই প্রস্তুতি জোরদার না হলে পাঁচটা দিন এতখানি নিয়মে বাঁধা, সুশৃঙ্খল এবং সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে না। কী নিখুঁত সেই প্রস্তুতি-প্রক্রিয়া! যে কোনও কর্পোরেট ইভেন্টে যাঁরা নেপথ্যের প্রস্তুতি শিখতে চান, তাঁরা অনায়াসে এই কাজে চোখ রাখতে পারেন।
অন্যান্য পুজোর ক্ষেত্রে জোগাড় সবসময় অত নিখুঁতভাবে করা যায় না। বাড়ির পুজোয় সবটাই হয় নিয়ম মেনে। একটুকু এদিক-ওদিক হওয়ার জো নেই। আর এর যে কোনও সংবিধান আছে, তা নয়। অনেকটা বেদ যেমন শ্রুতি, তেমনটাই এই নিয়মকানুনও অনেকটা ধরা আছে স্মৃতি এবং শ্রুতিতে। তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে চলেছে। আমি যেমন এসব বই পড়ে শিখিনি। শিখেছি ঠাকুরমা-দিদিমার প্রশ্রয়ে। প্রথমেই যা করতে হয়, তা হল পুরো কর্মকাণ্ডের একটা স্বচ্ছ নকশা সাজিয়ে ফেলতে হয় মাথার মধ্যে। কোনটা কখন করতে হবে– সেই ফর্দখানা মাথার মধ্যেই ঘুরতে থাকে। এবার শুধু এক-একটা জিনিস জোগাড় আর ব্যালেন্স-শিট মিলিয়ে নেওয়ার পালা।
বাসনপত্র দিয়েই শুরু করা যাক। নৈবেদ্য, ভোগ, বরণডালা এমনকী, ফুলও যে সাজিয়ে রাখা হবে, তার তো পাত্র চাই। অতএব নানা সাইজের পেতলের থালা বের করতে হয় সিন্দুক থেকে। বছরভর তা তোলাই থাকে। সবার আগে সেগুলো বের করে মার্জনা-সংস্কারে ঝকঝকে করে তোলা হয়। কতরকমের যে বাসন বের করতে হয়, তার ঠিক নেই। পুজোর মুহূর্তে যদি কম পড়ে যায়, তবে তো হইহই রইরই কাণ্ড! কিন্তু কী আশ্চর্য, কোনওবার তা হয় না। ঠাকুরমাকেও দেখেছি, একেবারে নিখুঁত হিসাব মিলিয়ে বাসনকোসন বের করতে। দেখে দেখে আমিও শিখে নিয়েছি। দশকর্মা, নৈবেদ্য, মালা, ফল– এই সবই তো পুজোর অঙ্গ। এরপর একে একে জোগাড় করতে হয় সেগুলো। মাথায় রাখতে হবে, পুজো কিন্তু বিধিনিয়ম মেনেই চলে। অতএব স্টেজে মেকআপ দেওয়ার জায়গা নেই। তাই ভুল করলে যে হবে না, সেই বোধটি একেবারে গোড়ায় মনের মধ্যে গেঁথে নিতে হয়। মহাস্নানের জন্য যা যা জিনিস লাগে, তা একেবারে ভিতরে ঢুকে প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িয়ে না থাকলে সম্ভব নয়। শুধু বরণডালা সাজানোর কথাই ধরা যাক না কেন! প্রথমেই তো জানতে হবে, বরণডালায় কী কী রাখা থাকে। তবে না জোগাড়ের পালা! ঠাকুরমশাই কিন্তু এক এক করে সব চেয়ে যাবেন, আর তাঁর হাতের সামনে সবকিছু জুগিয়ে দিতে হবে। অতএব জোগাড়টা পাকা হওয়া চাই।
পঞ্চমীর দিন নাড়ু পাকানো আর এক মস্ত কাজ। ব্যাপারটা ঠিক যতই সহজ, ততটাই কঠিন। মনের ভক্তি আর হাতের আদর না পেলে নাড়ুতে পাকই ধরে না! তারপর আছে প্রদীপের সলতে পাকানো। আজকাল অনেকেই কেনা সলতে ব্যবহার করেন। আমাদের বাড়িতে অবশ্য তা হাতেই তৈরি হয়। এই খুঁটিনাটি জিনিসের দিকে অন্যদের নজর প্রায় পড়েই না। তবে এই সলতে পাকানো পর্বটি যদি কেউ দেখেন তো জানবেন, এ-ও যেন শিল্পের থেকে কম কিছু নয়। পুষ্পপত্র সাজানোকেও আমি আর্ট-ই বলি। আসলে পুজোর জোগাড় মানেই হরদরে হাজার জিনিস এনে মজুত করা নয়। এই সাজানোর মধ্যে নান্দনিকতার ছোঁয়া আছে। মা-ঠাকুরমাদের হাতের ছোঁয়ায় তা লোকজ শিল্পের পর্যায়েই উন্নীত। আপনারা যাঁরা অবন ঠাকুরের আলপনা সংক্রান্ত আলোচনার সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন, এর ভিতর লুকিয়ে আছে কতখানি শিল্পমন। পুজোর জোগাড়ের ক্ষেত্রেও আমি সেই মননের ছোঁয়াই দেখি।
সবথেকে বড় শিক্ষা টাইম ম্যানেজমেন্টের। ঠিক সময়ে ঠিক জিনিসটি জোগাড়ের ঘর থেকে তুলে আনতে হয় ঠাকুরদালানে। একদিকে প্রস্তুতি, অন্যদিকে এই টাইম ম্যানেজমেন্ট– পুজোর জোগাড়ে এ দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। আর আজন্ম আমি দেখছি পুজোর আগে এটাই আমাদের বাড়ির রোজনামচা। কী যে ভাল লাগে! ঘন হয়ে আসে মুহূর্তগুলো। পরিবারটা যেন মস্ত হয়ে ওঠে। ভিয়েনের লোক আসেন। ওদিকে রান্নার ঠাকুর সদলবলে চলে এসেছেন। ঢাকিরা আসেন ঠিক সময়ে, টুকটাক ঢাকে কাঠির শব্দ ভেসে আসে। প্যান্ডেল, লাইটের লোকজন ব্যস্ত। ঠাকুরমশাইরা সবাই এসে নিজেদের কাজকর্ম, জোগাড় দেখে নিচ্ছেন। ওদিকে এই পাঁচদিনের খাওয়া-দাওয়ার জন্য বাজার-হাট চলছে। সবজি বাজার। বাগানবাড়ি থেকে আসবে ডাব, সবজি। এই সবই বহুকাল ধরে চলে আসছে। আর আমিও একটু একটু করে ঢুকে পড়েছি পুরো প্রক্রিয়ায়।
শুনেছি, আমার বয়সি ছেলেপুলেরা নাকি এসবের খোঁজই রাখে না। তবে এইগুলো করতে বিশ্বাস করুন, আমার খুব ভালই লাগে। মনে হয় নিজের পূর্বসূরিদের স্পর্শ করে আছি বাঙালির হারানো সংস্কৃতির সূত্র ধরে। এই আলোটুকু নিজের হাতে জ্বালাতে পেরে সত্যি বলতে একটু গর্বই হয়।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved