প্রতিমা গড়ার সময়, আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা-বোঝা নারীর রূপ এসে পড়েছে। কুমোরটুলির প্রতিমা যেমন আমাকে শেখাচ্ছে, তেমনই শেখাচ্ছে আমার মা, দিদি, কাকিমা, ঠাকুরমা। আমার ছবির মধ্যেও তারা এসেছে। না, সরাসরি আসেনি। কিন্তু ‘নেই’– একথাও বলতে পারি না। এমনকী, আমার নিজের মধ্যেও তো রয়েছে রাধাভাব। রয়েছে প্রেমের বোধ। আমি তো আসলে বৈষ্ণব। ত্যাগ করতে শিখেছি। কী দেখে আমার মধ্যে যৌনতার বোধ জাগবে, এবং কী দেখে নয়– তা আমার নিজের আয়ত্তে। তবেই তো ত্যাগের সরূপ মিলবে।
৭.
আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা শিল্পী এবং স্বশিক্ষিত শিল্পীরা দুর্গাপুজো করছে, লিখেছিলাম গত পর্বেই। জানি না কারা আহত হলেন একথায়। তবে, আমি বলব, বেশ তাঁরা বেশ করছে। ব্যক্তিগতভাবে চাই আরও দুর্গাপুজো করুন শিল্পীরা। শিল্প শুধু আর্ট গ্যালারির আলো আর গুটিকয়েক দর্শকে সীমাবদ্ধ নয়। শিল্পের দেওয়াল মানে শুধুই আর্ট গ্যালারির দেওয়াল নয়। শিল্পের মূল কাজ যদি হয়ে থাকে কমিউনিকেশন, ভেবে দেখুন, এত বড় একটা ক্ষেত্র আমাদের এই বাংলাতেই কবে থেকে প্রস্তুত ছিল। আর্ট ফর পিপলস সেক। এর বাইরেও রইল অর্থমূল্য। শ্রমের বিনিময়ে টাকা মিলছে। কেন জানি না, শিল্পীদের আর্থিক অনটনের মধ্যে না কাটালে সমাজ খুব একটা পাত্তা দেয় না। দারিদ্রই কি একমাত্র স্ট্রাগল একজন শিল্পীর? তাঁর অন্য কোনও স্ট্রাগল থাকতে পারে না? দুর্গাপুজো করে কি তাঁরা এমনই বিরাট মাপের বড়লোক হয়ে যাবেন, যে শিল্পের থেকে দূরে চলে যাবেন? এর একটাই উত্তর, না। শিল্পের উপাসকরা এমন হবেন না। শিল্পের জন্য অর্থমূল্য দেওয়া যায়, কিন্তু শিল্পের সে অর্থে ‘দাম’ হয় না।
তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে, কী হবে দুর্গাপুজো করে? শুধুই শিল্পের প্রদর্শন? কোনও কোনও ক্ষেত্রে অল্টারনেটিভ আর্ট স্পেস খুঁজে পাওয়া? না, শুধু তা-ই নয়, শিল্পীরা নিজেদেরও খুঁজে পাবেন। পাবেন তাঁদের ভঙ্গিমা। এবং হয়তো প্রতি বছরই, বদলে বদলে যাবে তাঁদের সেই জীবন আনন্দে বেঁচে থাকার খোঁজ। একজন শিল্পী সারাজীবন ধরে নানা শিল্পের নির্মাণ করেন বটে, কিন্তু অবধারিতভাবেই থেকে যায় তাঁর খোঁজ-সফর। আমার মতে, দুর্গাপুজো এই সফরের অংশ হতে পারে। তার জন্য যে সেই শিল্পীকে প্রবল আস্তিক হতে হবে, এমনও নয়। আমি নিজেও তো আস্তিক নই। বিশ্বাস করুন, ঈশ্বরে আমার কোনওরকম বিশ্বাস নেই। দুর্গা? দুর্গা কোনও কোনও সময় আমার মেয়ে, কখনও আমার মা, কখনও আমার দীর্ঘকাল ধরে দেখা কাছের কোনও রমণী, এমনকী, প্রেমিকাও। প্রতিমা গড়ার সময়, আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা-বোঝা নারীর রূপ এসে পড়েছে। তা না হলে, আমার প্রতিমা হয়ে দাঁড়াত ক্যালেন্ডারের চিরায়ত রূপের হুবহু প্রতিরূপ। এগুলোই আমার উপলব্ধির বিষয়। কুমোরটুলির প্রতিমা যেমন আমাকে শেখাচ্ছে, তেমনই শেখাচ্ছে আমার মা, দিদি, কাকিমা, ঠাকুরমা। আমার ছবির মধ্যেও তারা এসেছে। না, সরাসরি আসেনি। কিন্তু ‘নেই’– একথাও বলতে পারি না। এমনকী, আমার নিজের মধ্যেও তো রয়েছে রাধাভাব। রয়েছে প্রেমের বোধ। আমি তো আসলে বৈষ্ণব। ত্যাগ করতে শিখেছি। কী দেখে আমার মধ্যে যৌনতার বোধ জাগবে, এবং কী দেখে নয়– তা আমার নিজের আয়ত্তে। তবেই তো ত্যাগের সরূপ মিলবে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: কালী সিগারেট: প্রোডাক্ট ক্ষণকালের, ব্র্যান্ড চিরকালীন
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
যখন ধীরে ধীরে গড়ে তুলছি মাটির প্রতিমা, একজন নারীর রূপে, তাকে অঙ্গরাগ করছি, আকার দিচ্ছি– হাত-পা-চোখ-মুখ-স্তন– সমস্ত কিছুই, তা যদি আমি না দেখতাম, কী করে গড়ে তুলতাম? আমার ক্যানভাস থেকে প্রতিমা– আমি না জেনে কোনও রূপের প্রতিই দৌড়ে যাইনি। আমি জানলে তবেই গড়তে পারব। আমি জানলে তবে আমার গড়া বারবার করে ভেঙে ফেলতেও পারব। মনে করে দেখুন, আমাদের এই বাংলায় অপরূপ এক কবি, শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ভাঙা শিখতে হয়–/ অপরূপভাবে ভাঙা, গড়ার চেয়েও মূল্যবান/ কখনো-সখনো!’
(চলবে)
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত