১৯৮৮ থেকে প্রতিটি ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এডস দিবসে আমরা এইচআইভি-এডসকে হারাতে হারাতে এগিয়েছি। কিন্তু বৈষম্য, সমকাম-বিদ্বেষকে মুছে ফেলতে পারিনি। আন্দোলনকে আরও জনমুখী করা আজও বাকি। যেমন, ১৯৮৮ থেকেই প্রতি বছরের থিমে আজ পর্যন্ত সরাসরি সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের কথা বলেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এডস ও মেয়েরা বা এডস ও শিশুরা কিংবা এডস ও যৌবন এমন নানা থিম হয়েছে কিন্তু এডস ও সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা বলে কোনও থিম গড়ে ওঠেনি।
জো মিলারকে ভিড়ে ঠাসা পানশালায় বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীরা হাসির পাত্র করে তোলে। জো মিলার (ডেন্জেল ওয়াশিংটন), কৃষ্ণাঙ্গ ও এখন এক এডস রোগীর প্রতি কর্মক্ষেত্রমূলক বৈষম্য নিয়ে লড়াই করতে থাকা উকিল জো মিলার প্রথমে ভেবে পায় না কী বলবে! এই হাসি, এই ঠাট্টা, এই ভাঁড়ামোর উদ্দেশ্য একটাই: জো মিলারের মক্কেল অ্যান্ড্রু বেকেট (টম হ্যাঙ্কস) আসলে সমকামী এবং তা আর চাপা নেই বরং সমগ্র ফিলাডেলফিয়া শহর জুড়ে এই সমকামিতা আর এডস রোগেরই চর্চা এখন। জো নিজেও ডাক্তার দেখিয়েছে প্রথম দিন অ্যান্ড্রুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর। তার সন্দেহ ছিল পাছে সেও সংক্রামিত হয়ে যায়! জো মিলার স্পষ্টত সমকাম-বিদ্বেষী। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও, বৈষম্য কাকে বলে জীবন দিয়ে তা উপলব্ধি করেও জো মিলার সমকামী মানুষদের প্রতি কোনও সহমর্মিতা অনুভব করে না। তাহলে অ্যান্ড্রুর এই মামলা সে গ্রহণ করল কেন? শান্তভাবে সে একটাই উত্তর দেয়, ‘দিস পিপল মেক মি সিক বাট এ ল হ্যাস বিন ব্রোকেন। ইউ নো দা ল, ডোন্ট ইউ?’ (এই লোকগুলোকে দেখলে আমার অসুস্থ লাগে, কিন্তু একটা আইন ভাঙা হয়েছে। তুমি নিশ্চয়ই আইনটা জানো, জানো না?)
আরও পড়ুন: বিষাদে থাকলে তুমি অন্যকে আঘাত করো, সেটাও কি পাপ নয়?
১৯৯৩ সাল শুধু নয় টম হ্যাঙ্কস-ডেন্জেল ওয়াশিংটন অভিনীত ‘ফিলাডেলফিয়া’ সিনেমাটি বিশ্বসিনেমার ইতিহাসে এখনও এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। অ্যান্ড্রু বেকেট ফিলাডেলফিয়া শহরের একটি বিরাট ল’ ফার্মের উঁচু পদের কর্মী। অফিসে তার দ্রুতগতির উত্থান হঠাৎ থেমে যায় যখন কপালে একটা লাল দাগ (কাপোসিস সারকোমা যা এডস রোগের স্পষ্ট লক্ষণের একটি) প্রতিভাত হয়। অফিসের সকলেই টের পায় অ্যান্ড্রু অসুস্থ। তাও আবার এডস রোগে। তারা ঘুরিয়ে অন্য একটা ব্যাপারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে অফিস ছাড়তে বাধ্য করে। সে কোর্টে মামলা করে। সারা শহর ঢুঁড়েও কোনও উকিল তার জোটে না। সব শেষে এক সময়কার প্রতিদ্বন্দ্বী জো মিলারের কাছে তাকে আসতে হয়। শেষে রায় অ্যান্ড্রুর পক্ষেই যায়, আর্থিক ক্ষতিপূরণও মেলে কিন্তু অ্যান্ড্রুর সময় ফুরিয়ে আসে। সে ইহলোক ত্যাগ করে। কিন্তু জনাথান ডেম পরিচালিত এবং ১৯৯৩-তে টম হ্যাঙ্কস দ্বারা শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার জিতে নেওয়া ‘ফিলাডেলফিয়া’ আমাদের অনেকগুলি প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যায়। আমাদের পাহাড়প্রমাণ সমকাম-বিদ্বেষের জন্য কতগুলো জীবন আমরা নষ্ট করি? কত মানুষ শুধুমাত্র সমকামী-রূপান্তরকামী বলে এইচআইভি-এডসের সঠিক চিকিৎসা এখনও পান না? সমাজে, কর্মক্ষেত্রে কতরকম ঘৃণার রাজনীতি ও বৈষম্যের সম্মুখীন নিরীহ মানুষগুলোকে হতে হয়?
আরও পড়ুন: দুর্ঘটনা না হলে কি সুড়ঙ্গ সুরক্ষা খতিয়ে দেখা বারণ?
আটের দশকে এইচআইভি-এডস উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে মহামারীর (এখন অবশ্য সমীক্ষা বলছে ওটা ‘অতিমারী’) আকার ধারণ করলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমকামী-রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠী। সেটা সচেতনভাবে কন্ডোম ব্যবহারের কাল নয়, তার আগে এটাও পরিষ্কারভাবে জানা ছিল না যে পায়ুকামেও একইরকমভাবে এইচআইভি সংক্রামিত হতে পারে। এই রোগের প্রাদুর্ভাবে সমাজ-সরকার সকলেই লড়ে কিন্তু ধর্মগত ও ঐতিহাসিক কারণে যে, সমাজ আগে থেকেই সমকাম-বিদ্বেষের রোগের আক্রান্ত সেখানে রোগী সমকামী-রূপান্তরকামী হলে তার প্রতি বৈষম্য অনেক বেড়ে যায়। ওখানেও তাই হল। এডসের নাম দেওয়া হল ‘গে ক্যানসার’। এইচআইভি-এডস আক্রান্তদের চিকিৎসার আগে জুটল ঘৃণার অত্যাচার। আপিস-কাছারি থেকে তাদের ছাঁটাই হল, হাসপাতালে বৈষম্যমূলক ওয়ার্ড তৈরি হল এবং একটা বর্ণবাদী ধারণা গড়ে উঠল যে, সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষরাই এইচআইভি-এডসের জনক। এই রাজনীতি আমাদের পক্ষে আন্দাজ করা মুশকিল নয়। করোনা অতিমারীর সময় ভারতেও প্রচারিত হয়েছিল একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী। কেন? কারণ, সরকার প্রথমদিকে কোনও পরিকাঠামো তৈরি করতে না পারলেও, বিমান বন্দর বন্ধ না করলেও ওই জনগোষ্ঠীর ওরা কেন ধর্মীয় সমাবেশ করল? অতএব, ওরাই দায়ী! এগুলো চেনা ছক। এইচআইভি-এডস অতিমারীর সময়েও এই ছকেই বৈষম্য হয়েছিল। ‘ফিলাডেলফিয়া’ ছবির এক জায়গায় আছে অ্যান্ড্রুর ল’ ফার্মই এক সময় এক মহিলা এডস রোগীর কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য নিয়ে একটি মামলা লড়েছিল অথচ তাদের নিজেদের আপিসে যখন একজন সহকর্মী একই পরিস্থিতির শিকার তখন তারাও একইরকম বৈষম্যমূলক আচরণ করল। ফার্মের যুক্তি ওই মহিলার এডস রোগ রক্ত দান-গ্রহনে অর্থাৎ অনিচ্ছাকৃত কিন্তু অ্যান্ড্রুর রোগ যৌনতার কারণে অর্থাৎ এ-রোগ সে নিজে ডেকে এনেছে! এমন হাস্যকর যুক্তির মধ্যে দিয়ে এক সময় সত্যিই সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের যেতে হয়েছে। আমেরিকা-ইউরোপে এইচআইভি-এডসের এমন একটা অপমানজনক ব্যথার ইতিহাস নিঃসন্দেহে বিদ্যমান।
আরও পড়ুন: যে কেউ আসলে ছদ্মবেশী, বুঝিয়েছিলেন ড্র্যাগ-রানি রুপল
ভারতে এই বৈষম্যের ইতিহাস আবার অন্যদিকে গতি নিয়েছিল। আমাদের দেশে সমকামী-রূপান্তরকামী অধিকার আন্দোলন শুরুই হয়েছিল এইচআইভি-এডস রোগকে কেন্দ্র করে। এখানে ‘এডস ভেদভাও আন্দোলন’ সমকামী-রূপান্তরকামী অধিকার আন্দোলনের প্রথম পর্যায়। এদের সমীক্ষাতেই উপরোধ ছিল সমাজের সব ক্ষেত্রে এমনকী, তিহার জেলে অবধি কন্ডোম বিলি অত্যন্ত প্রয়োজন। ভারত সরকার নিজ উদ্যোগে ‘নিরোধ’ নামক কন্ডোম উৎপাদন শুরু করে ১৯৬৪ থেকেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যা পরবর্তী কালে এইচআইভি-এডস প্রতিরোধেও মারাত্মক কাজে দেয়। এক সময়কার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী (২০০৪-’০৯) আন্বুমণি রামাডস আইপিসি ৩৭৭ ধারা অবলুপ্তির প্রস্তাব করেন যাতে এইচআইভি-এডস চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষরা, যারা তখনও এদেশে অপরাধীর তকমায় ছিল, কোনও বৈষম্যের শিকার না হয়। আজ সমস্ত বিশ্বের সঙ্গে ভারতেও টিকা এখনও অনাবিষ্কৃত থাকলেও এইচআইভি-এডস কোনও ভয়ের কারণ নয় আর; এখন কন্ডোম ব্যবহার, সচেতনতার পাশাপাশি ‘প্রেপ’ (প্রিএক্সপোসার প্রোফিল্যাক্সিস) এসে গেছে, এখন রক্তে শর্করার মতো এইচআইভি নিয়েও মানুষ বহু বছর বেঁচে থাকতে পারে- সংক্রমণের হার প্রায় শূন্য।
সেই ১৯৮৮ থেকে প্রতিটি ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এডস দিবসে আমরা এইচআইভি-এডসকে হারাতে হারাতে এগিয়েছি। কিন্তু বৈষম্য, সমকাম-বিদ্বেষকে মুছে ফেলতে পারিনি। আন্দোলনকে আরও জনমুখী করা আজও বাকি। যেমন, ১৯৮৮ থেকেই প্রতি বছরের থিমে আজ পর্যন্ত সরাসরি সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের কথা বলেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এডস ও মেয়েরা বা এডস ও শিশুরা কিংবা এডস ও যৌবন এমন নানা থিম হয়েছে কিন্তু এডস ও সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা বলে কোনও থিম গড়ে ওঠেনি। অথচ এই গোষ্ঠীই এক সময় সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ‘ফিলাডেলফিয়া’ সিনেমায় কৃষ্ণাঙ্গ উকিল জো মিলার বলেছিল আইন না ভাঙার কথা। লক্ষ্য রাখতে হবে, আমাদের সমকাম-বিদ্বেষের জন্য মানবিকতা, সহমর্মিতা, সাম্য ও অধিকারের আইন ভেঙে সমাজ যেন অসুস্থ না হয়ে পড়ে । সেই অসুখের টিকা কিন্তু কোনও দিনই আবিষ্কার করা যাবে না!