ক্যাপ্টেন হ্যাডক। যার গালাগালের স্টক আমাদের সনাতন রূপকথার মধুসূদন দাদার ভাঁড়ের মতোই অফুরন্ত! কিন্তু সে, আমাদের যে গালাগালের সংস্কৃতি, তার সঙ্গে নিজেকে মোটেই মিলিয়ে-মিশিয়ে নেয়নি। এই গালাগাল তবে কীরকম? এই গালাগালের রসাস্বাদন করতে গেলে আপনাকে জীবনবিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, পক্ষীবিজ্ঞান কিংবা আবহাওয়া বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা করতে হবে, নিদেনপক্ষে গালাগালগুলো পড়ে সে ব্যাপারে ছানবিন করতে হবে। তথাকথিত ছোটদের জন্য বলেই টিনটিন স্রষ্টা হার্জ যৌনতা ও কদর্যতা– এইসব অন্ধকার দিকগুলো সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন।
আমরা, এই মনুষ্যসন্তানদল, যদি খুব তলিয়ে ভাবি তা’লে দেখব– আমরা আসলে তেমন ভালো লোক নই।
শুরুতেই দমে যাবেন না। খোলসা করছি। বলতে চাইছি যে, আমাদের মধ্যে নানা ধরনের বদ-প্রবৃত্তি নিরন্তর উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে। অবশ্য সমাজে, সবাই যদি ভালো লোকই হত, নীতিনিষ্ঠই হত– তাহলে গোটা ব্যাপারটা খুব ম্যাড়মেড়ে বৈচিত্রহীন একটা অসহ্য রুটিনমাফিক দৈনন্দিনে পরিণত হত। পৃথিবীতে যা কিছু মহৎ শিল্প সৃষ্টি হয়েছে, তার বহুলাংশ জুড়েই বিশ্বাসঘাতকতা আর মানুষের চরিত্রের বিচিত্র সব অন্ধকার।
যাক সে কথা। আপাতত একটা জিনিস খেয়াল করুন– অন্য লোকের ঝগড়া দেখতে যে অসামান্য অতুলনীয় আমোদ রয়েছে, তা আমরা নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাই না। আর তাতে যদি পাঁচফোঁড়নের মতো গালিগালাজ থাকে, তাহলে তো ব্যাপারখানা আরও উপভোগ্য। প্রতিটি জাতি, প্রতিটি ভাষা, গালমন্দ করার ব্যাপারে ভীষণ সৃষ্টিশীল এবং প্রজন্মভেদে গালাগালের নানাবিধ প্রকাশভঙ্গি ও প্রতিশব্দ তৈরি করে ফেলে। স্টকে কোনওকালেই তা কম পড়ে না। এবং অনবরত এই মৌলিকত্বর ফুলঝুরি কখনও কম পড়ে না। সাধারণত গালাগালের বিষয় হল যৌনতা এবং পূর্বপুরুষকে জড়িয়ে ব্যাভিচারের দোষারোপ এবং এই সংক্রান্ত আরও নানা কদর্য বিষয়ের অগুনতি বাক্যচাতুর্য।
হ্যাডক। যার গালাগালের স্টক আমাদের সনাতন রূপকথার মধুসূদন দাদার ভাঁড়ের মতোই অফুরন্ত! কিন্তু সে, আমাদের যে গালাগালের সংস্কৃতি, তার সঙ্গে নিজেকে মোটেই মিলিয়ে-মিশিয়ে নেয়নি। এই গালাগাল তবে কীরকম? এই গালাগালের রসাস্বাদন করতে গেলে আপনাকে জীবনবিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, পক্ষীবিজ্ঞান কিংবা আবহাওয়া বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা করতে হবে, নিদেনপক্ষে গালাগালগুলো পড়ে সে ব্যাপারে ছানবিন করতে হবে। তথাকথিত ছোটদের জন্য বলেই টিনটিন স্রষ্টা হার্জ যৌনতা ও কদর্যতা– এইসব অন্ধকার দিকগুলো সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন।
হ্যাডক-এর অন্যতম জনপ্রিয় গালাগালি হল ‘ব্লিস্টারিং বার্নিক্যালস’। এর সঙ্গে আবার ক্যাপ্টেনের নাবিক জীবনের অনুষঙ্গ জড়িয়ে। বার্নিক্যালস হল এক ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণী– যা সাধারণত জলযানের তলায় আটকে যায়, যা জলযান চালানোর ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারে। কাজে বিপত্তির সেই বিরক্তিটাকে জ্বালাধরা ফোসকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ উপমা! কখনও আবার রঙের বর্ণনাও দিয়েছেন ‘blue blistering barnacles’ বলে।
এরপর আসি বেশ কিছু অসাধারণ পেশার উপমাতে। যেমন ক্যাপ্টেনকে চেঁচাতে শোনা গিয়েছে Body Snatcher বলে, আসলে আঠেরো এবং উনিশ শতকে কিছু লোকে কবরখানা থেকে মৃতদেহ গায়েব করে মেডিকেল কলেজে বেচে দিত কাটাছেঁড়া করার জন্য। আরেকটা মজার গালাগাল ছিল ‘Bootlegger’, একটা সময় পশ্চিমে ১৮৮০ নাগাদ এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীদের উৎপাত হয়েছিল যারা বেআইনি মদ পাচার এবং বিক্রি করত তাদের বুটের ওপরের অংশের মধ্যে লুকিয়ে। পরের দিকে অন্যান্য জিনিস পাচার করত। প্রায় ১৯২০ থেকে ’৩০ সাল পর্যন্ত এদের কাজ-কারবার চলত পশ্চিমে। এদের বলা হত বুটলেগার। আর বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু পোকামাকড় তো অহরহ পাওয়া যায় ক্যাপ্টেনের বাক্যিবাণের মধ্যে। বিভিন্ন ধরনের কেন্নো, কাঁকড়াবিছে– যাঁদের বলা হয় Centipade, অর্থাৎ যারা শতপদী বা অনেক পা যাদের। ছোট জীবজন্তুর নাম বলেই যে ক্যাপ্টেন ক্ষান্ত থেকেছেন তা নয়, ক্যাপ্টেনের চেঁচামেচির সময় ‘Brontosaurus’-এর নাম শোনা যায়, যা আসলে উত্তর আমেরিকা অঞ্চলের প্রাচীন ডাইনোসর। এছাড়া বাঁদর, বেবুন, হুনুমান, মেরু অঞ্চলের লোমশ ভেড়া কিছুই বাদ ছিল না! আবার ‘ফ্যান্সি ড্রেসড ফ্যাসিস্ট’ বলে হিটলার পন্থীদেরও একহাত নিয়েছেন তিনি।
গালাগালের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন কিন্তু শালীনতার মাত্রা ছাড়ায়নি। অথচ সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজকে বিভিন্ন উপমায় উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে কোথাও রক্ত সেভাবে দেখাননি হার্জ। হানাহানি-যুদ্ধ-মারামারি– সবই ঘটেছে কিন্তু তার হিংস্র কদর্যতা নেই কোত্থাও। এ এক আশ্চর্য রূপকথা!