হারিয়ে যাওয়া দিনের স্মারকে সাজানো বাড়িটিকে এক পলক দেখলে মনে হয়– কোনও এক নির্লিপ্ত জাদুঘর যেন শখ করে বাড়ির ছদ্মবেশে আত্মগোপন করে রয়েছে। আর এই জাদুঘরের নেপথ্যে থাকা মানুষটির নাম পরিমল রায়; সংগ্রাহকদের দুনিয়ায় যিনি সত্যিই এক জাদুকর। ৮৯ ছুঁইছুঁই বয়সে এই চিরতরুণ মানুষটি ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় একরকম হুট করেই পাড়ি দিলেন অন্যলোকে। সাবেক ভবানীপুরের অন্যতম একটি উজ্জ্বল আলো চিরতরে নিভে গেল।
ভবানীপুরের বেলতলা গার্লস স্কুলের অদূরে একটি গলি, গলির মধ্যে পুরনো আমলের বাড়ি। ফটকের পাশে বাহারি কায়দায় লেখা নাম: ‘তামাম্ শোধ’। দরজা ঠেলে ঢুকতেই চক্ষু চড়কগাছ! আরে! এ যে আরেক ‘এল ডোরাডো’! প্রবেশ পথের দু’ধারে দেওয়ালে টাঙানো আদ্যিকালের সারি সারি ঝলমলে এনামেল বোর্ড। ‘ভারত পেট্রোলিয়াম’, ‘গুরু টিন’, ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েজ’, ‘কোলে বিস্কুট’ থেকে শুরু করে কী নেই সেখানে? হারিয়ে যাওয়া দিনের স্মারকে সাজানো বাড়িটিকে এক পলক দেখলে মনে হয়– কোনও এক নির্লিপ্ত জাদুঘর যেন শখ করে বাড়ির ছদ্মবেশে আত্মগোপন করে রয়েছে। আর এই জাদুঘরের নেপথ্যে থাকা মানুষটির নাম পরিমল রায়; সংগ্রাহকদের দুনিয়ায় যিনি সত্যিই এক জাদুকর। ৮৯ ছুঁইছুঁই বয়সে এই চিরতরুণ মানুষটি ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় একরকম হুট করেই পাড়ি দিলেন অন্যলোকে। সাবেক ভবানীপুরের অন্যতম একটি উজ্জ্বল আলো চিরতরে নিভে গেল।
কেবলমাত্র ‘সংগ্রাহক’ বললেই পরিমল রায়ের সবটুকু পরিচয় মেলে না। বরং একই নিঃশ্বাসে ইংরেজি ভাষার ‘raconteur’ শব্দটি উচ্চারিত হলে তাঁকে অনেকখানি চেনা যায়। ভবানীপুরের বনেদি ভদ্রতার সঙ্গে তুমুল ভালো গল্প-বলিয়ে এক স্নেহময় ব্যক্তিত্ব। হবে না-ই বা কেন? বয়স বাড়লেও মনের বয়সকে যে ঠিক বেঁধে রেখেছিলেন পূর্বসূরিদের মতো! তাই রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, বসন্ত চৌধুরীর মতো সংগ্রাহক এবং আলোকচিত্রী জ্যোতিষ চক্রবর্তীর সঙ্গে বয়সের তফাতকে তোয়াক্কা না করে তাঁর ছিল চিরকেলে বন্ধুত্ব।
এহেন মানুষটির সঙ্গে (একই এলাকার বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও) প্রতিবেদকের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটেছিল ‘সন্দেশ’ পত্রিকার দৌলতে। ২০১৩ সালে সন্দেশের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে সদ্য প্রয়াত কাজী অনির্বাণের সঙ্গে একযোগে একটি অসাধারণ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন পরিমল রায়। নন্দন-৪-এ অনুষ্ঠিত হওয়া সে প্রদর্শনীর কথা এখনও ভোলেননি উৎসাহী বাঙালি পাঠক। সেই উপলক্ষে একটি ফোলিও লিফলেটও প্রকাশিত হয়েছিল পরিমল রায়েরই উদ্যোগে। ভাঁজ করা বিরাট মাপের ঝকঝকে কাগজে সুবিন্যস্তভাবে ধরা ছিল সন্দেশের প্রথম যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সমস্ত সম্পাদকের কথা এবং প্রতিটি পর্যায়ের ‘সন্দেশ’ থেকে কিছু প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ। ফোলিওটি সংগ্রহ করে প্রদর্শনী চত্বরেই চিরতরুণ মানুষটিকে প্রতিক্রিয়া জানাতে ভারি ইচ্ছে হল। সংগ্রাহক চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আলাপ করিয়ে দিলেন ওঁর সঙ্গে। ‘সন্দেশী’ জেনে পরম স্নেহে কাছে টেনে নিলেন। যেন কতদিনের চেনা। এরপর যখন কথায় কথায় শুনলেন অধমও ভবানীপুরের বাসিন্দা, সোজা ‘তুই’ সম্বোধনে নেমে এসে বললেন, ‘এই দেখ, আমায় স্যর বলবি না। জেঠু বলবি। বাড়িতে চলে আয় একদিন। তোর তো হাঁটাপথ।’
এর ক’বছরের মধ্যেই প্রদর্শনী ছাড়াও ওঁর এবং কাজি অনির্বাণের যুগ্ম সম্পাদনায় অবিশ্বাস্য কিছু বই আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে! এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: ২০১৩ সাল পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত সবাক যুগের সমস্ত বাংলা সিনেমার বুকলেট ও তথ্য দিয়ে সাজানো আকর গ্রন্থ, ‘আ ডিরেক্টরি অফ বেঙ্গলি সিনেমা’ এবং ওঁর নিজের সংগ্রহে থাকা মহানায়ক উত্তমকুমার অভিনীত ১৯৬টি ছবির পোস্টার এবং বুকলেটের ছবি দিয়ে সাজানো উত্তম-এনসাইক্লোপেডিয়া, ‘পৃথিবী আমারে চায়’। ২০১৭ সালের শেষদিকে একটি কাজের সূত্রে জেঠুর বাড়ি প্রথম যাওয়ার সুযোগ ঘটে। প্রথম সাক্ষাতের পর চার বছর অতিক্রান্ত। ফলে ওঁর বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে যখন উঠছি, তখন দেওয়ালে ঝোলানো বিচিত্র সব মুখোশ, ঝাড়বাতি, এনামেল বোর্ডের দিকে চেয়ে খানিক নার্ভাস লাগছিল। ভাগ্য ভালো, সে যাত্রা দুই প্রবীণ সন্দেশী– যথাক্রমে ভবানীপ্রসাদ দে এবং বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন পুরোভাগে।
সিঁড়ির ধাপের মুখে পোর্সেলিনের দুটো ভাস। তারপর টানা বারান্দা, ফের এনামেল বোর্ডের সারি। বাঁ-হাতে জেঠুর কাজের ঘর। আবারও সেই একই ব্যাপার। নিমেষে আপন করে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা যেন ওঁর মজ্জাগত। জেঠুর ঘরটিও দেখার মতো। একটি পুরনো খাট। তার একপাশে আলমারি। দেওয়াল জুড়ে দেবদেবীর পুরনো লিথোগ্রাফ, আলতা-পাউডারের হাতে আঁকা লেবেল, এবং রিলিফের নানা কাজ বাহারি ফ্রেমে বাঁধানো। কড়িবরগার একপাশ থেকে নেমে এসেছে বেলজিয়ান কাচের বাহারি বাতিদান। সংগ্রাহকের পক্ষে মানানসই ঘর। খাটের উপর স্তূপীকৃত বই, এবং কাগজ। একপাশে পড়ে একটা জোরালো আতশকাচ। বাকি দুই সন্দেশীর সঙ্গে জেঠুর আড্ডা চলছে আর আমি একদৃষ্টে ঘরের এদিক ওদিক চেয়ে দেখছি। হঠাৎ, সৎবিৎ ফিরল জেঠুর ডাকে, ‘অ্যাই, তুই আমাদের বুড়ো ভেবে এড়িয়ে যাচ্ছিস না কি? এদিকে আয়, এইটে দেখ একবার। এ কাজ করতে গিয়ে প্রায় হয়েছিল আর কী।’ বলে এগিয়ে দিলেন একখানি বই। মলাটে ডালে বসা কাকের ছবি আর নীচে লেখা ‘হিতোপদেশের গল্প’। লেখক রাজশেখর বসু। বইয়ের পাতা উল্টে চক্ষু স্থির! এ তো রাজশেখর বসু’র হস্তাক্ষর সম্বলিত খাতাটারই হুবহু প্রতিলিপি। দৌহিত্রী-পুত্র দীপংকর বসু-র জন্য গোটা বইটি সহস্তে লিখে এঁকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং পরশুরাম। সেই পাণ্ডুলিপিই হুবহু বই আকারে পাঠকের দরবারে তুলে এনেছেন জেঠু। বইয়ের প্রিন্টার্স লাইনে বিনিময় মূল্যের জায়গায় ‘অমূল্য’ মুদ্রিত আছে দেখে চমৎকৃত হয়ে বললাম, “কিন্তু এ বই তাহলে পাঠকেরা পাবে কীভাবে জেঠু?” এক মুহূর্ত না ভেবেই উত্তর দিলেন অশীতিপর তরুণ, ‘আমি উপহার দিলে তবেই পাবে। এই বইটা আজ থেকে তোর। এবার খুশি তো?’ বলেই খানিকক্ষণ ভাবলেন, তারপর খাটের পাশ থেকে প্লাস্টিকে মোড়া আনকোরা নতুন আরেকটি বই হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘তুই এটাও রাখ। বাড়ি গিয়ে খুলে দেখিস। খুব মজা পাবি।’ বইটা হাতে নিয়ে দেখি সেটা রাজশেখর বসু’র সহস্তে লেখা শ্রীমদ্ভগবদগীতা-র হুবহু প্রতিলিপি। আমায় কিছু বলতে না দিয়েই জেঠু বললেন, ‘তোকে বললে বিশ্বাস করবি না, অমর্ত্য সেনকে যখন গত মাসে উপহার দিয়েছিলুম এ বই, তখন সে অবধি ভাবতেই পারেনি এমনটাও সম্ভব এদেশে।’
সেদিন সংগ্রাহক পরিমল রায়ের এক অন্য আঙ্গিক জানার সৌভাগ্য হয়েছিল। উপহার দেওয়া বইয়ের একটিতে সই করতে করতে এক আশ্চর্য কাহিনি শুনিয়েছিলেন জেঠু। ‘‘‘রাজশেখর বসু’র বাড়ি থেকে কোনও কাগজপত্র ইত্যাদি বাইরে ফেলে দেওয়া হয়নি’’ এই প্রবাদসম সত্যির উপর নির্ভর করে আশি পেরোনো পরিমল রায় বেশ কয়েক মাস ধরে, রুটিনমাফিক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটাতেন পরশুরামের বকুলবাগান রোডের বাসভবনে। ধুলোয় ঢাকা কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে অমূল্য সব রত্ন এক এক করে আলোর মুখ দেখতে লাগল বটে, কিন্তু ওই অত্যাচারের ফলে জেঠু আক্রান্ত হলেন নিউমোনিয়ায়। বেশ কিছুদিন যমে-মানুষে টানাটানি চলল। অবশেষে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেই আবারও কাজে ফেরা। সেদিন পুরনো কাগজ ঘেঁটে পাওয়া আরেকটি অমূল্য দলিল জেঠু আমাদের দেখিয়েছিলেন। রাজশেখর বসু যে তাঁর নিজের শ্রাদ্ধের কার্ডের খসড়া বয়ান (নোট, টীকা-সহ ) নিজেই লিখে রেখে গিয়েছিলেন তা চাক্ষুষ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম!
…………………………………………
জেঠুর বিশেষ দুর্বলতা ছিল সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার, এবং তাঁর বাসস্থান ভবানীপুর নিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ হয়েছিল পাড়ার হাতে লেখা পত্রিকা ‘কথা বিচিত্রা’র দৌলতে। শিল্পী নীরদ মজুমদারের সঙ্গে গিয়ে প্রথমবার চাক্ষুষ দেখেন সত্যজিৎ রায়কে। এর অনেক পরে ‘হীরক রাজার দেশে’-র সময়ে আলাপ বদলে যায় সংযোগে।
…………………………………………
গল্প বলতে বলতে জেঠু দেখিয়েছিলেন রাজশেখর বসু-কে নিয়ে তাঁর আগামী বইয়ের ডামি। হাতে করে আঠা দিয়ে সেঁটে ছবি এবং লেখা বসিয়ে আদি-অকৃত্রিম পদ্ধতিতে করা সেই কাজে ছিল আশ্চর্য পারিপাট্য এবং পরিমিতিবোধ। মাপজোক একেবারে ছবির মতো সুন্দর। জেঠুকে সেকথা বলায় উনি সলজ্জ হেসে বলেছিলেন, ‘দেখ বাবা, আমার কোনও বই তৈরির তালিম নেই। কিন্তু আমায় কেউ একবারটি কোনও কিছু দেখিয়ে দিলে আমি দিব্যি সেইটিকে ফলো করে কাজ করতে পারি। জাপানি কোম্পানিতে দীর্ঘদিন চাকরি করার এই একটা সুফল বলতে পারিস।’ এই কারণেই বোধহয় কোনও কাজ, লে-আউট অপছন্দ হলে জেঠু একেবারে খাঁটি কলকাত্তাইয়া ঢঙে বলতেন, ‘থার্ড-কেলাস কাজ।’
জেঠুর বিশেষ দুর্বলতা ছিল সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার, এবং তাঁর বাসস্থান ভবানীপুর নিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ হয়েছিল পাড়ার হাতে লেখা পত্রিকা ‘কথা বিচিত্রা’র দৌলতে। শিল্পী নীরদ মজুমদারের সঙ্গে গিয়ে প্রথমবার চাক্ষুষ দেখেন সত্যজিৎ রায়কে। এর অনেক পরে ‘হীরক রাজার দেশে’-র সময়ে আলাপ বদলে যায় সংযোগে। ‘ঘরে বাইরে’ ছবির এক থলি সোনার মোহর থেকে শুরু করে ‘আগন্তুক’ ছবিতে দেখানো পাল যুগের মূর্তি, চোল শিল্পকর্মের অর্ধনারীশ্বর, সবই সরবরাহ করেছিলেন স্বয়ং পরিমল রায়। সম্প্রতি কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি-তে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে হওয়া একটি প্রদর্শনীতে ‘ঘরে বাইরে’-র মোহরগুলি রাখা হয়েছিল। জেঠু গিয়ে সেকথা বলায় উনি রহস্য ফাঁস করে বলেছিলেন, ‘‘ওগুলোকে বলে পয়সা-মোহর। আরেক ধরনের হত অবিশ্যি সে সময়। তাকে বলত ‘খেজুরছৌড়ী’। মানিকদা বলেছিলেন ওঁর পয়সা-মোহর চাই। কিন্তু যখন বললেন শ’খানেক লাগবে, আমার তো মাথায় হাত! কী করি, কী করি, শেষটায় বড়বাজারের সোনাপট্টি থেকে শ’খানেক ভিক্টোরিয়ান তামার পয়সা কিনে তাতে রেডিয়াম প্লেটিং করে সোনার মোহর বানিয়ে দিয়েছিলুম। মানিকদার সেই খুশিতে অবাক হওয়া মুখটা ভীষণ মনে পড়ে।’’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় যখন হিউস্টন থেকে অস্ত্রোপচার সেরে দেশে ফেরেন, তখন পরিমল জেঠু বিমানবন্দরে ছুটে গিয়েছিলেন। আনন্দলোক পত্রিকার ‘সুস্থ সত্যজিৎ স্বদেশে’ শীর্ষক সংখ্যায় জেঠুর সে হাসিমুখের ছবি ধরা আছে। এমন আন্তরিকতা আজকের দিনে বিরল। রায় পরিবারের সঙ্গে পরিমল রায়ের সংযোগ শেষদিন পর্যন্ত অটুট থেকেছে।
…………………………………………
কখনও খিদিরপুরের আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করে এনেছেন প্রখ্যাত শিল্পীর অরিজিনাল আর্টওয়ার্ক, আবার কখনো দেশলাই বাক্স, তাস, পোস্টার, বিজ্ঞাপনের লেবেল জোগাড় করতে পাড়ি দিয়েছেন দূরের পথ। কিন্তু চিরকাল কেন্দ্র থেকেছে তার নিজের পাড়া, ভবানীপুর। শেষ ক’বছর বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন তিল তিল করে গড়ে তোলা নিজের অসাধারণ সব সংগ্রহ। ওঁর ঝোঁক চলে গিয়েছিল মূলত সেলাইচিত্র বা সূচ-সুতোয় করা ছবি সংগ্রহ করায়। গত শতকের বহু অখ্যাত মহিলা শিল্পীর হাতের কাজের নমুনাগুলিকে সংরক্ষণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন ২০১৭ থেকে আমৃত্যু।
…………………………………………
পাড়ার লোক হিসেবে যে ক’জনকে নিয়ে জেঠু ভয়ানক গর্ববোধ করতেন তার মধ্যে প্রথম নামটিই উত্তমকুমারের। তখন জেঠুর বয়স ১৫ কি ১৬, তখনই লুকিয়ে সিনেমার বুকলেট জমাতেন। ১৯৫২ সালে উত্তমকুমারের (তখনও অরুণ চ্যাটার্জি) ‘মর্যাদা’ ছবিটি রিলিজ করে, তার বুকলেট জোগাড় করে বাড়ি ফেরার পথে বড়দা-র কাছে তুমুল বকুনি খান। তবুও শখ বিসর্জন দেননি। উত্তমকুমারের প্রায় সব ছবির বুকলেট এবং পোস্টার সংগ্রহ করেছিলেন অপরিসীম যত্নে। জেঠুর পরম শ্লাঘার বিষয় ছিল এই যে তিনি স্কুলে পড়াকালীন গো অ্যাজ ইউ লাইকে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন স্বয়ং উত্তমকুমারের হাত থেকে। উত্তম-প্রয়াণের পর টালিগঞ্জের অন্দরে যে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাও শোনার সুযোগ হয়েছিল জেঠুর থেকেই। বহু বিখ্যাত অভিনেতাই নাকি টালিগঞ্জের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে একরকম পাকাপাকিভাবেই পেশা বদলানোর কথা ভেবেছিলেন।
তাল, মান, সুর– এই নিয়ে ভবানীপুর। জেঠু মাঝেমধ্যেই বলতেন, ‘‘ওরে, এ হল পাঁচমুখো পাড়া। এই যে শ্যামানন্দ রোডের দু’টো মুখ টাউন শেন্ড রোডের দিকে, দু’টি নরেশ মিত্র সরণির দিকে, আর একটি সোজা গিয়ে পড়েছে বকুলবাগানে।’’ আশৈশব কাটানো ভবানীপুরের পাড়াটিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন জেঠু। ছবির খোঁজে, ক্ষণস্থায়ী শিল্পকলার খোঁজে সারাজীবন দৌড়ে বেরিয়েছেন পরিমল রায়। কখনও খিদিরপুরের আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করে এনেছেন প্রখ্যাত শিল্পীর অরিজিনাল আর্টওয়ার্ক, আবার কখনো দেশলাই বাক্স, তাস, পোস্টার, বিজ্ঞাপনের লেবেল জোগাড় করতে পাড়ি দিয়েছেন দূরের পথ। কিন্তু চিরকাল কেন্দ্র থেকেছে তার নিজের পাড়া, ভবানীপুর। শেষ ক’বছর বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন তিল তিল করে গড়ে তোলা নিজের অসাধারণ সব সংগ্রহ। ওঁর ঝোঁক চলে গিয়েছিল মূলত সেলাইচিত্র বা সূচ-সুতোয় করা ছবি সংগ্রহ করায়। গত শতকের বহু অখ্যাত মহিলা শিল্পীর হাতের কাজের নমুনাগুলিকে সংরক্ষণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন ২০১৭ থেকে আমৃত্যু।
গত বছর ‘সন্দেশ’ এবং ‘বিচিত্রপত্র গ্রন্থন বিভাগ’ আয়োজিত ‘লীলা মজুমদার স্মারক বক্তৃতা’ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে পরিমল রায়কে তাঁর বাড়ি থেকে নন্দনে নিয়ে আসা এবং পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল প্রতিবেদকের উপর। ফিরতি পথে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। অসুস্থতার কারণে তখন জেঠুর চলাফেরায় খানিক বয়সের ছাপ পড়েছে। হাত ধরে গাড়ি থেকে যে মুহূর্তে তিনি তাঁর বাড়ির সামনে নামলেন, তাকে এগিয়ে দিতে যাব, অমনি বলে উঠলেন, ‘থাক না বাবা। আর অতটা অথর্ব করে দিসনি। নিজের পাড়ায় এসে গেছি, ভয় কীসের রে? দিব্যি চলে যাব। তুই বাবা, সাবধানে অনুষ্ঠানের ওখানে ফিরে যা।’ এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে, লাল পাঞ্জাবি পরিহিত প্রাজ্ঞ মানুষটি ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছেন গলি ধরে, তার স্বপ্নরাজ্যের দিকে। যার নাম, ‘তামাম্ শোধ’। কিন্তু তাঁর কাছে আত্মবিস্মৃত বাঙালির ঋণ? এককথায়– অপরিশোধ্য।
লেখায় ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই লেখকের সূত্রে প্রাপ্ত