কে সেই নির্ভীক সেলিব্রিটি, যিনি সরাসরি বলতে পারেন– আই সাপোর্ট প্যালেস্তাইন উইথআউট এনি ফিয়ার। কে তিনি, যাঁর হৃদয়ের একটা অংশ প্যালেস্তাইনের মতোই রক্তাক্ত। তিনি রাজনীতির জগতের লোক নন, আবার তিনি প্রখর রাজনীতির লোক। হ্যাঁ, নাম তাঁর দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। ২০১২ সাল থেকে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত বারবার তিনি প্যালেস্তাইনের পক্ষে কথা বলেছেন। ২০০৮ সালে মারাদোনাকে নিয়ে ছবি করেছিলেন ক্রোয়েশিয়ার চলচ্চিত্রকার এমির কুস্তুরিকা। স্বভাবতই সে ছবি যখন কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হল, তখন বক্রক্তির ঝড় বয়ে গেল। যত বড় প্রতিভাই তিনি হন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করার স্পর্ধা কেন রাখেবেন!
‘ইন মাই হার্ট আই এম এ প্যালেস্তিনিয়ান।’ কে বলছেন এ কথা? সাধারণত আমরা দেখি সেলিব্রিটিরা বড় সতর্ক। তাঁদের অর্থ আছে, প্রতিপত্তি আছে, খ্যাতির বিড়ম্বনা আছে। আর আছে সর্বোচ্চ শিখর থেকে পতনের ভয়। কিন্তু কে সেই নির্ভীক সেলিব্রিটি, যিনি সরাসরি বলতে পারেন– আই সাপোর্ট প্যালেস্তাইন উইথআউট এনি ফিয়ার। কে তিনি, যাঁর হৃদয়ের একটা অংশ প্যালেস্তাইনের মতোই রক্তাক্ত। যিনি রক্তাক্ত প্যালেস্তাইনের রক্তক্ষরণের মূল্য দেন। তিনি রাজনীতির জগতের লোক নন, আবার তিনি প্রখর রাজনীতির লোক। হ্যাঁ, নাম তাঁর দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। ২০১২ সাল থেকে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত বারবার তিনি প্যালেস্তাইনের পক্ষে কথা বলেছেন। সম্মান জানিয়েছেন প্যালেস্তাইনের মানুষকে, তাদের সংগ্রামকে। ভয় পাননি কোনও দিন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার আগ্রাসী ক্ষমতাকে। তাঁর বন্ধু তালিকায় তাই আমরা দেখি ফিদেল কাস্ত্রো, উগো চাভেজ, ইভো মোরালেস, প্যালেস্তাইন-প্রধান মেহমুদ আব্বাস।
তিনি কত বড় ফুটবলার ছিলেন, তা বিচার করার ক্ষমতা হয়তো আমাদের নেই। ব্রিটিশ ফুটবলার গ্যারি লিনেকার বলেছেন, ফুটবল স্কিলের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে মারাদোনার ধারেকাছে কোনও ফুটবলার আসবেন না। তাঁর মতে, মারাদোনা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ। তিনি শ্রেষ্ঠতম কি না, সে বিচারের প্রয়োজন নেই। সে ভার ইতিহাসের হাতে অর্পণ করাই ভালো। সবচেয়ে বড় কথা লিনেকার বলছেন, ফুটবলের প্রতি প্যাশন আর মানুষ হিসেবে তাঁর সহৃদয়তাও কিন্তু ভোলার নয়। লিনেকার সরাসরি রাজনীতির উল্লেখ করেননি হয়তো। কিন্তু এই ‘প্যাশন’ ও ‘সহৃদয়তা’ শব্দ দু’টি দিয়ে মারাদোনার রাজনীতিকে বোধহয় বোঝা যায়।
১৯৮২ সালে তিনি প্রথম বিশ্বকাপে অবতীর্ণ হন। বিশ বছরের এই তরুণকে যেভাবে ম্যাচের পর ম্যাচ নৃশংসভাবে আক্রমণ করা হয়েছিল, তা দেখে শিউরে উঠতে হয়। ইতালির স্টপার জেন্টিল যেভাবে বল ছেড়ে তাঁর বাঁ-পা, বাঁ-হাঁটু লক্ষ্য করে মেরেছে, তা বিশ্বকাপের আঙিনায় তুলনারহিত! ইউরোপীয় রেফারি এসব দেখেও না দেখার ভান করে। মারাদোনা অভিযোগ করতে গেলে উল্টে তাঁকেই হলুদ কার্ড দেখানো হয়! একবার তো তাঁর মুখে ঘুঁষি মেরে তাঁকে ধরাশায়ী করে এই কুখ্যাত ইতালিয়ান ডিফেন্ডার। ওই ম্যাচে মোট ২৩ বার মারাদোনাকে ফাউল করা হয়, জেন্টিল একাই ১১ বার তাঁকে আঘাত করে। ঘাতক সৈন্যের মার মার রবে সেদিন হারিয়ে গিয়েছিল শিল্পীর প্রতিভার বিচ্ছুরণ। একের পর এক বিষাক্ত ট্যাকলে মেজাজ হারানো মারাদোনা যখন পরের ম্যাচে লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখনই হয়তো তিনি বুঝে নিয়েছিলেন পরাজিত হওয়া তাঁর জন্য নয়। তাঁকে জিততে হবে আর জেতাতে হবে। জীবনের প্রতিটি লড়াইয়ে তাঁর জেতা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। কেউ আসবে না তাঁকে সহানুভূতি জানাতে। ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ করে তাঁকে রূপকথার নায়কের মতো একা হাতে সাফল্যের ইমারত গড়তে হবে।
তিনি তাই-ই করেছিলেন। ১৯৮৬ সালের মারাদোনা সেই স্বপ্নকে স্পর্শ করলেন। নবীন মারাদোনাকে যারা ১৯৮২-র বিশ্বকাপে হতাশ, পরাজিত, অনামি এক তরুণ বলে অবজ্ঞা করেছিল, তারাই তাঁর প্রতিভায় চন্দ্রাহত হয়েছিল চার বছর পর। সাফল্যে নৃত্য করার সঙ্গী সহজেই জুটে যায়, কিন্তু পরাজিত নায়কের ব্যর্থতায় সমব্যথী পাওয়া দুষ্কর। আর ১৯৯০-র বিশ্বকাপ ফাইনালে তাই দেখা গেল। তাঁর কান্নায় সঙ্গী হল অর্ধেক দুনিয়া। ট্রফি পেল জার্মানি, হৃদয় জিতলেন মারাদোনা। এ সাফল্য তুলনারহিত। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিক ও ক্রনিক্লার এদুয়ারদো গালিয়ানো বলছেন, ‘‘মারাদোনার অপরাধ তিনি শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছেন। তাঁর অপরাধ তিনি কথা বলেছেন এমন সব বিষয়ে, ক্ষমতাবানরা চায় না সেই সব বিষয়ে কেউ মুখ খুলুক। মারাদোনা একটা বোঝা কাঁধে নিয়ে জীবনের পথ হেঁটেছে, সে বোঝার নাম ‘মারাদোনা’।’’ সেই ভারে তাঁর পিঠ নুয়ে পড়েছে, কিন্তু মাথা তিনি উঁচু রেখেছেন। স্বেচ্ছায় তুলে নেওয়া বোঝাটা সে কখনও নামিয়ে রাখেননি। সুখী রাজপুত্র হতে তিনি চাননি। তিনি বিদ্রোহী হতে চেয়েছিলেন, তার অভিধানে ‘থেমে যাওয়া’ কথাটা ছিল না।
২০০৮ সালে মারাদোনাকে নিয়ে ছবি করেছিলেন ক্রোয়েশিয়ার চলচ্চিত্রকার এমির কুস্তুরিকা। স্বভাবতই সে ছবি যখন কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হল, তখন বক্রক্তির ঝড় বয়ে গেল। কে নেই সেই সমালোচনায়, বিলেতের গম্ভীর ‘অভিভাবক’ পত্রিকা থেকে মার্কিন সবজান্তা খবরের কাগজ– সবাই। সত্যিই তো! কেন করবেন এরকম ছবি? যত বড় প্রতিভাই তিনি হন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করার স্পর্ধা কেন রাখেবেন! কেন পাশ্চাত্যের উপনিবেশিক মনোভাবের বিরোধিতা করে কথা বলবেন! ছবি করতে হয় তো ‘হ্যান্ড অফ গড’ আর তাঁর কোকেনাসক্তি নিয়ে ছবি করুন বরং!
কিন্তু ছবিটা দেখলে বোঝা যায়, কুস্তুরিকা একতরফাভাবে মারাদোনাকে দেখাননি মোটেই। ছবিতে উঠে এসেছে মানুষ মারাদোনা, জিনিয়াস মারাদোনা, পাগল মারাদোনা, বিদ্রোহী মারাদোনা– যিনি শিশুর মতো উচ্ছসিত হয়ে উঠতে পারেন, আবার যিনি কিনা অকপটে অনুতাপ করতে পারেন তাঁর কোকেনের নেশার জন্য। কুস্তুরিকা ও মারাদোনার একটা অদ্ভুত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এই ছবিটাকে ঘিরে। বোধহয় সেটাই স্বাভাবিক ছিল। দু’জন মানুষ– একজন ফিল্মমেকার, যুদ্ধবিধ্বস্ত পূর্ব ইউরোপের একটা অংশে ছিল যাঁর বাড়ি। সারাইয়াভো নামের সেই দেশটা পৃথিবীর ম্যাপ থেকে মুছে গেছে। আর একজন ফুটবলার, এক আশ্চর্য শিল্পী, যিনি বোয়নোস আইরেস শহরতলির বস্তি থেকে তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন। দু’জনের মধ্যেই অতীত আর শৈশবের প্রতি এক গভীর টান থেকে গিয়েছিল। আমরা দেখি, দিয়েগোর ভিলা ফিয়োরিতো বস্তির শৈশবের সেই বাড়িতে কথোপকথনে ব্যস্ত কুস্তুরিকা এবং মারাদোনা। মারাদোনার চোখেমুখে উপচে পড়ছে খুশির আবেশ।
ফুটবলের রাজপুত্রকে কি সুখী মানুষ হিসেবে দেখেছেন? কুস্তুরিকা বলছেন, শৈশবের সেই বাড়িতে মারাদোনা যেদিন তাঁর সঙ্গে গেলেন, সেই কয়েকটা ঘন্টা এই যন্ত্রণাকাতর রাজপুত্রকে বড় সুখী মনে হয়েছিল। তিনি বলেছেন মারাদোনা বোধহয় সবচেয়ে সুখী হতেন যদি এমন একটা ম্যাচ তিনি খেলতে পারতেন, যেখানে রেফারি কোনও দিন শেষ বাঁশি বাজাবে না। ফুটবল মাঠ তাঁর কাছে কেবল প্যাশন ছিল না, ছিল মুক্তি ও স্বাধীনতার অপর নাম। ‘কুস্তুরিকা’-র ছবি মারাদোনাকে আরেকভাবে চেনায়। একজন সংগীত পাগল মানুষ, একজন অসম্ভব উষ্ণ পারিবারিক মানুষ। সূচনা পর্বের পরেই আমরা দেখি ছবি আমাদের নিয়ে যাচ্ছে ২০০৫ সালের ৪ নভেম্বর বোয়নোস আইরেসের উত্তাল রাজপথে। জর্জ বুশ এবং আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেখানে লক্ষ্য মানুষের মিছিলে সামিল হচ্ছেন দিয়েগো মারাদোনা এবং এমির কুস্তুরিকা। এরপরেই ছবিটা চলে যায় অন্য এক ঘটনায়। সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় মারাদোনার জীবনের, যখন তিনি কোকেনাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন, প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।
ফুটবলের রাজপুত্র মারাদোনাকে দেখে কী মনে হয়েছিল এমির কুস্তুরিকার? বলছেন, মনে হয়েছিল ‘আ ক্যারেক্টার ফ্রম আ ফিল্ম অ্যাবাউট দ্য মেক্সিকান রেভোলিউশন, দ্যান দ্য বেস্ট ফুটবলার অফ অল টাইম’। পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের যতই গাত্রদাহ হোক না কেন, ‘বুশ: এ কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার’ লেখা টি-শার্ট পরিহিত হাতে চে-র উলকি আঁকা মারাদোনাকে ভালো লেগেছিল এই পরিচালকের। বলছেন, ‘আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল দিয়েগো মারাদোনার বিশ্ববীক্ষা, তাঁর রসবোধ এবং সর্বোপরি তাঁর মানবিকতাবোধ’। কিন্তু মারাদোনাকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র কেন বানালেন, একটা ফিকশন ফিল্ম নয় কেন? কুস্তুরিকা বলছেন, ‘মারাদোনা ইজ আ ট্রু স্টোরি। দেয়ার ইজ নো নিড টু অ্যাড ফিকশন।’
আসলে তিনি হ্যামলেট, ফুটবলের রাজপুত্র। অসুখী, বর্ণময়, রাগী। তাঁকে ফিকশনে বর্ণনা করতে শেক্সপিয়ারের প্রতিভা দরকার হয়। ট্র্যাজেডির নায়ক তিনি। তিনি হেরে যাবেন এটাই বোধহয় নিয়তি। জীবন ট্র্যাজেডির নায়কদের অন্যায় যুদ্ধে হারিয়ে দেয়। কারণ তারা ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করেন। মারাদোনা নীলকণ্ঠ। কেবল তাঁরা আহত বাঁ-পায়ের গোড়ালি নয়, হ্যামলেটের মতো শেষ দৃশ্যে তাঁর সারা শরীর বিষে নীল হয়ে যায়। সব বিষ একা পান করে তিনি নীলকণ্ঠ। হ্যামলেটের মতোই অস্থির, প্যারানয়েড, আহত, রিক্ত, অসুখী তিনি। তবু ডেনমার্কের রাজকুমারের মতোই ন্যায়ের যুদ্ধে তিনি নিবেদিত প্রাণ। দারিদ্রের অন্ধগলি থেকে রাজপথের আলোকমালায় অসম যুদ্ধে একা হাতে লড়াই করে যিনি উঠে আসেন, তাঁকে পরাজিত করা সহজ নয়। তবু এই নিরন্তর যুদ্ধ তাঁকে কি ক্লান্ত করেনি? করেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কার সাধ্য তাঁকে নির্বাসন দেবে! তিনি বিশ্বনাগরিক, ফুটবল মাঠে লাতিন আমেরিকার মুক্তিযুদ্ধ আর নিঃসঙ্গতার প্রতীক তিনি। তাঁর বাঁ-পায়ের জাদুবাস্তবতায় আবিষ্ট হয়ে থাকে আপামর ফুটবলপ্রেমী। সে-পায়ে মাতিসের ছন্দময় তুলির টান, নেরুদার মহাকাব্যিক উচ্চারণ। কবি সব্যসাচী দেব লিখেছেন–
‘সবুজ ঘাসে ছন্দ জাগে, সে ছন্দে তো ছন্দ ভাঙা
তোমার পায়ের বিদ্রোহ তার খুঁজল ভাষা
আগুন-রাঙা।’
৩০ অক্টোবর ১৯৬০, ফুটবলের হ্যামলেট জন্মেছিলেন। আজ জন্মদিনে আপনাকে উষ্ণ অভিবাদন দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।