পাহাড়ী সান্যাল লিখছেন, ‘একদিন এক ভদ্রলোক আমার বাড়িতে এসে আমাকে বললেন,– “পাহাড়ীবাবু, আপনার বিদ্যাসাগর দেখলাম, সকলেই আপনার খুব সুখ্যাতি করেছে, আমিও খারাপ বলছি না; তবে বিদ্যাসাগর কখনই ‘ব্যাকরণ’ কথাটি ‘ব্যাকারণ’ উচ্চারণ করতেন না; সাধারণ মানুষ অনেক সময় এ ভুল করেন বটে, কিন্তু একজন অভিনেতা যিনি বিদ্যাসাগরের চরিত্রের রূপদান করছেন তাঁর পক্ষে এ ভুল অক্ষমনীয়।’ এ কথা শুনে আমি যে কতখানি লজ্জিত হয়েছিলাম, সেটা প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে সে ভদ্রলোকের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অবধি নেই– এর পর আমি ভেবে ভেবে অনেক উচ্চারণের ভুল, যা আমি করতাম তা শুধরেছি, আর মনে মনে সেই ভদ্রলোককে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি।’ আজ পাহাড়ী সান্যালের ১২০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ।
প্রচ্ছদ দীপঙ্কর ভৌমিক
যৌবনে পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবির গায়ক-অভিনেতা এবং প্রৌঢ় বয়সে জনপ্রিয় চরিত্রাভিনেতা পাহাড়ী সান্যাল এ-বছর ২২ ফেব্রুয়ারি, ১২০ বছরে পা দিলেন। মরশরীরটিকে ছেড়ে যাওয়ার প্রায় ৫০ বছর পরেও বাংলা তথা ভারতীয় ছায়াছবির দর্শক তাঁকে কিন্তু ভুলে যেতে পারেনি। আর এখানেই একজন অভিনেতা হিসেবে তাঁর জয়, তাঁর অমরত্ব। পাহাড়ী সান্যাল কত ভালো অভিনেতা ছিলেন বা কত বড় গায়ক ছিলেন– এ নিয়ে আলোচনা করার যোগ্যতা কিংবা অধিকার কোনওটাই আমার নেই। আমি শুধু নানা সময়ে পড়া প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নানা সময়ে দেখা তাঁর অভিনীত ছায়াছবি এবং নানা সময়ে শোনা তাঁর গাওয়া গানের স্মৃতি হাতড়ে এইটুকুই খুঁজে দেখতে চাই– ঠিক কী কী কারণে আজও আমরা মনে রাখলাম তাঁকে।
প্রথম যেদিন ‘পাহাড়ি’ নামটা শুনি, সেদিন থেকেই নামটার মধ্যে যে ইউনিক ব্যাপারটা ছিল, সেটা টেনেছিল আমাকে। এখনও পর্যন্ত ওই নামের দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তিকে আমি চিনি না বা ওই নামের কেউ আছে বলেও শুনিনি। হ্যাঁ, পাহাড়ি বলে একটা পদবি আছে বটে, কিন্তু তার তো অন্য ইতিহাস। সেই পাহাড়িরা নাকি পাহাড়ের কাছে-পিঠে থাকত আসলে। পাহাড়ী সান্যাল– যিনি দীর্ঘ ‘ই’ দিয়ে লিখতেন নিজের নাম, তিনিও নাকি জন্মেছিলেন এক পাহাড়ি শহরে। কেউ বলে সেটা দার্জিলিং আবার কারও মতে সেটা নাকি সিমলা। আর সেই জন্যই নগেন্দ্রনাথ সান্যাল নামের রাশভারী ছেলেটাকে ওই ডাকনামেই ডাকত সবাই। ঠিক যেভাবে শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস তাঁর ডাকনাম ‘ছবি বিশ্বাস’ কিংবা সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের ডাকনাম ‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’ নামে অভিনয় জগতে পরিচিতি পেয়েছিলেন, তাঁর ক্ষেত্রেও ওই একই ব্যাপার ঘটেছিল।
পাহাড়ী সান্যাল মশায়ের শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন কেটেছে লখনউ শহরে। বাড়িতে সংগীতচর্চার একটা পরিবেশ ছিল। তাছাড়া তিনি নিজেও লখনউয়ের বেশ কিছু উস্তাদের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন। তিনি সেখানে কোন কোন উস্তাদের কাছে কী কী ধরনের সংগীতের তালিম নেন, তা জানতে হলে অবশ্যই শ্রদ্ধেয় কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বিরচিত ‘কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’ নামক অসামান্য স্মৃতি-সংগীতময় গ্রন্থটি পড়ে দেখতে হবে। পরে বাংলা এবং হিন্দি ছায়াছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নিজের গলায় গানও গেয়েছিলেন। তাঁর গানের গলা এতটাই ভালো ছিল যে, একবার কুমারপ্রসাদবাবুর বাবা মাননীয় ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নাকি রাস্তা থেকে তাঁর রেওয়াজ শুনে না-বলে-কয়ে ঢুকে পড়েছিলেন তাঁদের লখনউয়ের বাড়িতে। নিজের পরিচয় দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ শুনেওছিলেন তাঁর গান।
এছাড়া বিশিষ্ট সংগীতস্রষ্টা ও গায়ক অতুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গে ছাত্র হিসেবে পাহাড়ীবাবুর প্রায় এক যুগের ওপর নিবিড় ঘনিষ্ঠতা, তাঁর চরিত্রকে যেন এক আশ্চর্য বর্ণালি দিয়েছিল। অতুলপ্রসাদ সেন এবং ওঁর সৃষ্টি করা গান, অতুলপ্রসাদের ব্যক্তিজীবনের একাকিত্ব ও বিরহ মেশানো দলা দলা ধূসর কুয়াশা, যা ওঁর জীবন থেকে ছড়িয়ে গিয়েছিল প্রিয় ছাত্র পাহাড়ী সান্যালের জীবনে এবং তাঁর স্মৃতিলেখা ‘মানুষ অতুলপ্রসাদ’ নামক ক্ষীণতনু বইটির পাতায় পাতায়। তাই এ-বইটি একবার না-পড়লে হয়তো তাঁদের দু’জনের বিষয়ে অনেক কিছুই অজানা থেকে যাবে। এ-নিয়ে বাড়তি যেটা বলার সেটা হল, গদ্যকার হিসেবে পাহাড়ী সান্যাল এখানে অনেকটাই সফল এবং তাঁকে আলাদা করে মনে রাখার এটা আরেকটা কারণও বটে।
অথচ এই পাহাড়ী সান্যালই বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর গানের গলা ভালো হলেও তা চিকন হওয়ার কারণে সেই সময়কার সিনেমার রেকর্ডিং সিস্টেমে ভালো শোনাচ্ছে না। বিশেষ করে, তাঁর সমসময়ের দুই জনপ্রিয় গায়ক-নায়ক কুন্দললাল সায়গল এবং পঙ্কজকুমার মল্লিকের গাওয়া গানের কাছে তা বেশ মার খেয়ে যাচ্ছে। সিনেমায় তখন আস্তে আস্তে শুরু হয়ে গিয়েছে প্লে-ব্যাক সিংগিং। তাই তিনি গানের দিক থেকে বেশ খানিকটা সরে এসে অভিনয়ের দিকে পুরোপুরি মন দিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ‘বউ ঠাকুরানির হাট’ ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ‘আজ তোমারে দেখতে এলেম’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে অতুলপ্রসাদের গান ‘সে ডাকে আমারে’ কিংবা ‘কমললতা’ ছায়াছবিতে ‘ও মন কখন শুরু, কখন যে শেষ’ গানখানির এক টুকরো শুনলেই তা আর ইহজন্মে ভুলতে পারা যাবে না। প্রমথেশ বড়ুয়া সাহেবের নির্দেশনায় ‘অধিকার’ ছায়াছবিতে ‘কোথা সে খেলাঘর’ কথাগুলি দিয়ে শুরু একটি গান আছে। এটি ডুয়েট গান। পর্দায় ঝকঝকে পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং পাহাড়ী সান্যাল মশায় একসঙ্গে গেয়েছেন গানখানি। এর সুরকার প্রখ্যাত সরোদিয়া তিমিরবরণ। গানের অর্কেস্ট্রেশনের মধ্যে সুরের অদ্ভুত একটা ওঠাপড়া আছে। অনেকটা নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে ডুবে যাওয়া এবং ভেসে ওঠার মতো। ইউটিউব খুললেই পেয়ে যাবেন গানটা। সময় করে একবার শুনে দেখবেন তো কেমন লাগে!
এবার সান্যালবাবুর অভিনয়ের দু’-একটি দিক উল্লেখ করি, যা তাঁকে আমার চোখে সবার চেয়ে আলাদা করেছিল। তিনি বাংলা, হিন্দি এবং উর্দু– তিনটে ভাষাই খুব ভালো জানতেন। ইংরেজিতেও তাঁর খুব ভালো দখল ছিল। কলকাতায় তৈরি হওয়া বাংলা এবং হিন্দি– দুই ভাষার ছবিতেই তখন তিনি অভিনয় করতেন। তাঁর প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবির নাম ‘ইহুদি কি লড়কি’ , যা একটি হিন্দি ছায়াছবি। এর নির্দেশক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মাইলফলক ‘মহাস্থবীর জাতক’-এর রচয়িতা প্রমাঙ্কুর আতর্থী। এতে তিনি একটি ডুয়েট হিন্দি গানও গেয়েছিলেন। হিন্দি ছবি ‘আরাধনা’ তাঁর বৃদ্ধ বয়সে করা ছায়াছবি। সেখানে শর্মিলা ঠাকুরের বাবার ভূমিকায় তাঁর অভিনয় তো মুগ্ধ হয়ে দ্যাখার মতো।
আমি যতটুকু পুরনো ছবি দেখেছি তাতে সেই সময়ের বাংলা সিনেমায় ছবি বিশ্বাস বা কিংবদন্তি তুলসী চক্রবর্তী ছাড়া এত স্বাভাবিক এবং জড়তাবিহীন ফিজিকাল মুভমেন্ট ও মুখের এক্সপ্রেশন আমার অন্তত চোখে পড়েনি। বেশিরভাগ অভিনেতাই তখন রথের মেলায় বিক্রি হওয়া তালপাতার সেপাই খেলনাটির স্টাইলে নিজের শরীর এদিক-ওদিক করতেন। কথাবার্তাতেও কেমন যেন একটা যাত্রা-ঘেঁষা এলানো সুর লেগে থাকত। অভিনয় জীবনের একদম প্রথম দিকে পাহাড়ী সান্যালেরও হয়তো এই আড়ষ্টতা কিছুটা ছিল কিন্তু খুব অল্পদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে আধুনিক করে নিয়েছিলেন। পাহাড়ী সান্যালের ডায়লগ থ্রোয়িং ছিল একদম স্বাভাবিক। কথা বলার মধ্যে একটা জন্মগত ভদ্রতা ও মিষ্টত্ব লুকিয়ে থাকত যেন। আবার শান্ত অবস্থা থেকে উত্তেজিত হয়ে পড়া কিংবা হঠাৎ আনন্দ পাওয়ার যে অভিব্যক্তি– তাতেও তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং এক সুতোও অতি অভিনয় না-করা মানুষ। হাতে একটি কাজ করতে করতে কারও সঙ্গে গপ্প করা কিংবা খাবার খেতে খেতে কথা বলার দৃশ্য তিনি এত ভালো করতেন যে, মনেই হত না পর্দায় কারও অভিনয় দেখছি।
আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে তৈরি হওয়া ‘বিদ্যাসাগর’ ছায়াছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করার সময় যে-দৃশ্যে তিনি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বাল্যবিবাহের যৌক্তিকতা নিয়ে তীব্র তর্ক করছেন হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞদের সামনে দাঁড়িয়ে, তা দেখলে আমাদের সেই না-দেখা বিদ্যাসাগর, আমাদের সেই ভালোবাসার বিদ্যাসাগরের জন্য আজও গর্বে বুক ফুলে ওঠে। মানে, এইখানে পাহাড়ী সান্যাল সিনেমার নায়কের যে ইমেজ তা ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়ে এক এবং একমাত্র রক্তমাংসের বিদ্যাসাগর হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তিনি এমন কিছু ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন যেগুলি কোনও না কোনওভাবে ঐতিহাসিক। বিদ্যাসাগর ছাড়া এইরকম ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে ‘বিদ্যাপতি’, ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’ এবং ‘কেদার রাজা’। ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছায়াছবিতে তাঁর করা নিত্যানন্দ দেখে বাঙালি দর্শক আবেগে চোখের জল ফেলেছে। আবার ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ ছায়াছবিতে মোটা সাদা গোঁফের বসন্ত রায়ের চরিত্রে তিনিই যেন সত্যিকারের বসন্ত রায়। পরে জেনে ভারি অবাক হয়েছি, সত্যি সত্যিই পাহাড়ী সান্যাল একসময় থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার রাজা বসন্ত রায় রোডে। আর সে-বাড়িতে থাকার সময় তাঁর বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন সদ্য কৈশোর পেরোনো ভীমসেন যোশী, যিনি কলকাতায় এসেছিলেন আচার্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়কে খুঁজে বের করে তাঁর কাছে গান শিখবেন বলে। পণ্ডিত ভীমসেন যোশীকে এর অনেক দিন পরে পাহাড়ী সান্যাল আবার খুঁজে পান কলকাতার ডিকসন লেনে সংগীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়িতে, তাঁরই গান শুনতে এসে। ভীমসেন সেদিন পাহাড়ী সান্যালকে প্রণাম করে নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। আর এই তথ্যগুলি আরও বিশদে জানতে হলে আপনাদের পড়ে নিতে হবে সেই সোনার জলে বাঁধিয়ে রাখা আশ্চর্য কেতাব, যার নাম ‘কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’।
এই বইতেই আরও একটি বিষয় পড়ে আমি পাহাড়ী সান্যালের প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করি। আর সেটা হল তিনি ছিলেন একজন নামকরা বৈঠকি আড্ডাবাজ এবং এবং গানের আসরের একজন প্রাণবন্ত শ্রোতা। তিনি যে আসরে যেতেন সেটাই নাকি ঝলমলে হয়ে উঠত তাঁর উপস্থিতিতে। তবে ভালো লাগলে তিনি যেমন উঁচু গলায় সংগীতের তারিফ করতেন, তেমনি পছন্দ না হলে তীব্রভাবে সেটাও প্রকাশ করে ফেলতেন। তাঁর কাছে এসব নিয়ে কোনও ঢাক-ঢাক গুড়গুড় ছিল না। নিজের কোথাও ত্রুটি থাকলে সেটা সবার সামনে স্বীকার করতেও তিনি পিছপা হতেন না।
যে কোনও চরিত্রের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে তাকে বোঝার এক অদম্য আগ্রহ ছিল তাঁর। আগ্রহ ছিল নিজেকে আরও নিখুঁত করার। এই প্রসঙ্গে তাঁর ‘অভিনয়ের মায়া’ নামক বইটি থেকে সামান্য অংশ তুলে দিই। সেখানে তিনি লিখছেন, ‘একদিন এক ভদ্রলোক আমার বাড়িতে এসে আমাকে বললেন,– “পাহাড়ীবাবু, আপনার বিদ্যাসাগর দেখলাম, সকলেই আপনার খুব সুখ্যাতি করেছে, আমিও খারাপ বলছি না; তবে বিদ্যাসাগর কখনই ‘ব্যাকরণ’ কথাটি ‘ব্যাকারণ’ উচ্চারণ করতেন না; সাধারণ মানুষ অনেক সময় এ ভুল করেন বটে, কিন্তু একজন অভিনেতা যিনি বিদ্যাসাগরের চরিত্রের রূপদান করছেন তাঁর পক্ষে এ ভুল অক্ষমনীয়।’ এ কথা শুনে আমি যে কতখানি লজ্জিত হয়েছিলাম, সেটা প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে সে ভদ্রলোকের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অবধি নেই– এর পর আমি ভেবে ভেবে অনেক উচ্চারণের ভুল, যা আমি করতাম তা শুধরেছি, আর মনে মনে সেই ভদ্রলোককে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি।’ মনে রাখতে হবে এই লেখাটি পাহাড়ী সান্যাল তাঁর অভিনয়-জীবনের প্রায় শেষের দিকে এসে লিখেছিলেন। এ-কথা কাউকে না-জানালেও তাঁর কিচ্ছু যেত-আসত না। কিন্তু তিনি নিজের ত্রুটি লিখিত ভাবে স্বীকার করেছিলেন।
অনেক পরে আমি হিন্দি ছায়াছবির তারকাদের তারকা অমিতাভ বচ্চনের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার দেখি, যা নিচ্ছিলেন তরুণ অভিনেতা রণবীর কাপুর। সেখানে রণবীর ‘ব্ল্যাক’ ছায়াছবিতে অমিতাভ বচ্চনের একটি বিশেষ দৃশ্যের ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন। সেই দৃশ্যে একটি চিঠি পড়তে পড়তে এক সময় প্রৌঢ় টিচার অমিতাভ বচ্চনের গলা বুঁজে আসে। তখন তাঁর মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছিল না। শুধু চোয়ালের পেশিগুলো নড়াচড়া করছিল। রণবীর বলেন, খুব শক্তিশালী অভিনেতা ছাড়া নিজের মুখের পেশির ওপর এহেন নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রায় অসম্ভব। এরপর রণবীর তাঁকে জিগ্যেস করেন, এই শট্টির কথা কি তাঁর মনে আছে? এটা শুনে অমিতাভ বচ্চন বলেন, হ্যাঁ, এটা মনে আছে, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে। তিনি এই দৃশ্যে একটা ভুল করেছিলেন– সেই ভুলটার জন্য। রণবীর জিগ্যেস করেন, কী সেই ভুল? তখন অমিতাভ বলেন,ওই দৃশ্যে তিনি চিঠিটা হাতে নেন, খোলেন, বুকপকেট থেকে নিজের চশমা বের করেন এবং চিঠিটা পড়তে শুরু করেন। কিন্তু তিনি ভুল করেছিলেন। কারণ ওই বৃদ্ধ টিচার তখন অ্যালজাইমারস-এ ভুগছিলেন। তিনি কী করে মনে রাখতে পারলেন যে, তাঁর চশমাটা বাঁদিকের বুকপকেটেই রয়েছে! তাঁর তো কোটের অন্যান্য পকেট হাতড়ে, তারপর চশমাটা খুঁজে পাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল! সাক্ষাৎকারের এই অংশটা শুনে আমার মনে হয়েছিল, অমিতজি তো এই ব্যাপারটা ওখানে না-বলতেই পারতেন। এটা তো সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ দর্শক মন দিয়ে দেখবে। তিনি না-বলে দিলে তো কেউ কোনও দিন ঘটনাটা জানতেও পারত না। কিন্তু তিনি সেটা চেপে জাননি। যেমন চেপে যাননি পাহাড়ী সান্যাল। কারণ অমিতাভজিও তো পাহাড়ী সান্যালের মতো অভিনয়ের ভুল শুধরে, নিজেকে একেবারে নিখুঁত করে তুলতে চেয়েছিলেন। আসলে উনিও তো আসলে একজন পাহাড়ি, মানে পাহাড়ের মতো বিশাল মানুষ। উনি আমাদের প্রিয় পাহাড়ি অমিতাভ।