Robbar

শিশু সাহিত্যে কমছে শিশুদের ভিড়, প্রকাশকরা ঝুঁকছে বড়দের বইয়ে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:April 2, 2024 3:55 pm
  • Updated:April 2, 2024 6:05 pm  

বাবা-মায়েরা চেষ্টা করছে প্রত্যেকের সন্তান আকাশ ছোঁয়া চাকরি করবে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়বে না। গল্পের বইয়ের পিছনে অর্থ বিনিয়োগ করাকে তারা টাকা নষ্ট করা ভাবছে। শিশু মন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। প্রকাশকরাও ভয় পাচ্ছে, শিশু সাহিত্যের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করতে। একটা সময় ‘দেব সাহিত্য কুটির’, ‘শিশু সাহিত্য সংসদ’ আরও অনেক প্রকাশনা সংস্থা ছোটদের বইয়ের ওপর বেশি জোর দিত। বর্তমানে তারা বড়দের বইয়ের ওপর একটু একটু করে জোর দিচ্ছে। এটা প্রকাশনা জগতে এটা বড় অন্ধকার দিক।

পিনাকী মজুমদার

আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় যখন বড়দের হাত ধরে ছোটদের ভিড় দেখা যায়, তখন মনটা বড্ড হালকা হয়। শিশু সাহিত্যে শিশুদের ভিড় বড্ড কমে যাচ্ছে। দায়ী কারা? আমরা সকলেই বোধহয়।

সুকুমার রায় আবোল তাবোল সৃষ্টি করে যেমন একটা আলোড়ন ঘটিয়ে গিয়েছিলেন, তেমনই নারায়ণ দেবনাথ, ময়ূখ চৌধুরী আরও অনেকে কমিকস সৃষ্টি করে শিশু সাহিত্যের ভিড় একটু একটু করে জমাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রকাশকরাই শিশু সাহিত্যের জন্য এগোতে সাহস পাচ্ছেন না আজকাল। কারণ অনেকগুলো। কারণগুলো সমাধান করতে যদি আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি, তাহলে একটা বড় পাঠক আগামী দিনে তৈরি হবে। আর সেটা শিশু সাহিত্যের হাত ধরেই। সবথেকে কঠিন কাজ সেটাই।

আমরা যদি কারণগুলোকে একে একে খুঁজতে চেষ্টা করি, সমাধানের রাস্তা নিশ্চয়ই আমরা খুঁজে পাব। আমরা যদি লেখকদের ওপর আলোকপাত করি? বড়দের জন্য যাঁরা লিখছেন, তাঁদের লক্ষ্য, আর ছোটদের জন্য যাঁরা লিখছেন, তাঁদের লক্ষ্য আলাদা। ছোটদের জন্য যাঁরা লেখেন, তাঁদের উদ্দেশ্য থাকে ছোটদের কল্পনার জগৎটাকে আরও বড় করা, ছোটদের মানসিক বিকাশে সাহায্য করা। আর ছোট মনকে আনন্দ দেওয়া। এতগুলো পয়েন্ট যদি সুন্দরভাবে কোনও একজন লেখক পূরণ করতে পারেন, তবে শিশু সাহিত্যের জন্য ভালো একটা রাস্তা তৈরি হবে। বড়দের জন্য যাঁরা লিখছেন, সেইসব পাঠকের মনের বিকাশ হয়ে যায়, তাই লেখকদের এতটা ভাবতে হয় না। শিশু সাহিত্যে তাই লেখকদের আলাদা একটা অবদান নিশ্চয়ই থাকে। লক্ষ করা গেছে, শিশু সাহিত্যের লেখক এবং প্রকাশনা সংস্থা তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু এদিকটা সফল হলে আগামী দিনে অনেক পাঠক তৈরি হতে পারে। যেমন একজন শিশুর মধ্যে অভিভাবক লুকিয়ে থাকে, তেমনই একজন শিশুর মধ্যে ভবিষ্যৎ পাঠক লুকিয়ে থাকে। শিশু সাহিত্যে এই দিকটা সকলে মিলে ভাবলে বাংলা সাহিত্যের একটা বড় আলোর রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাবে।

শিশু-কিশোরদের মানস গঠনে সাহিত্য | ১৯ অক্টোবর, ২০১৮

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

আরও পড়ুন: লাইব্রেরি কার্ডই শিশুদের স্বপ্নলোকের চাবি, হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব অভিভাবকের

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আমরা বড়রা যখন বই কিনতে যাই, বই দেখে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিই বইটা কিনব কি না; কিন্তু ছোটরা যখন বই কেনে, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কারণ, তাদের বই পছন্দ হলেও কেনার ক্ষমতাটা থাকে না। সেক্ষেত্রে বই বিক্রেতাদের কাছে টার্গেট অডিয়েন্স দু’জন হয়ে যায়– শিশুটি এবং তার বাবা কিংবা মা। প্রকাশক কিংবা লেখকরা, বই তৈরি করার সময় দু’জনের কথাই যদি মাথায় রাখেন, তবে বইটা বিক্রি করতে সুবিধা হয়। আর সেই জায়গাটা যদি সুন্দরভাবে পূরণ করা যায়, তবে শিশু সাহিত্যের ক্ষেত্রে পজিটিভ দিক অবশ্যই দেখা যাবে।

একটা সময় দেখা যেত, শীতকালে দুপুরবেলা কিংবা গরমকালে বিকালে ছাদে বসে মা কিংবা দাদু ঠাকুমারা বাড়ির ছোটদের গল্প শোনাত। আজকাল প্রত্যেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যৌথ পরিবার খুব একটা চোখে পড়ে না। ছোটরা বড্ড একাকিত্বে ভুগছে। তাদের গল্প বলার দাদা-ঠাকুমারাও নেই। বাবা-মায়েরা চেষ্টা করছে প্রত্যেকের সন্তান আকাশ ছোঁয়া চাকরি করবে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়বে না। গল্পের বইয়ের পিছনে অর্থ বিনিয়োগ করাকে তারা টাকা নষ্ট করা ভাবছে। শিশু মন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। প্রকাশকরাও ভয় পাচ্ছে, শিশু সাহিত্যের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করতে। একটা সময় ‘দেব সাহিত্য কুটির’, ‘শিশু সাহিত্য সংসদ’ আরও অনেক প্রকাশনা সংস্থা ছোটদের বইয়ের ওপর বেশি জোর দিত। বর্তমানে তারা বড়দের বইয়ের ওপর একটু একটু করে জোর দিচ্ছে। এটা প্রকাশনা জগতে এটা বড় অন্ধকার দিক। তার থেকেও অন্ধকার দিক শিশুদের। কারণ তাদের কল্পনার শক্তি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। মানসিক বৃদ্ধির জন্য কেবলমাত্র পাঠ্য পুস্তক নয়, গল্পের বই পড়া খুব জরুরি। হাসি, কান্না, মান ,অভিমান সবটা ভুলে গিয়ে তারা একটা যন্ত্রতে পরিণত হচ্ছে দিনের পর দিন। বলতে পারেন ক্ষতি হচ্ছে কাদের? সবার সবার সবার।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

সত্যজিৎ রায় ছোটদের জন্য আলাদাভাবে ভাবতে শুরু করেছিলেন, তার জোয়ার এখনও চলছে শিশুসাহিত্যে। ছোটদের সঙ্গে সঙ্গে বড়রাও তুলে নিচ্ছে সেই বইগুলো। সম্ভাবনার রাস্তা তো রয়েছে। তবে কেন ছোটদের জন্য আলাদা করে লেখক উঠে আসছে না বাংলা সাহিত্যে? ইংরেজি সাহিত্যতেও কিন্তু ছোটদের জন্য আলাদা ভাবে ভাবা হচ্ছে। বেশ কিছু বেস্ট সেলার বই আছে, যেগুলো ছোটদের জন্যই।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

সব খারাপের মধ্যেও একটা ভালো দিক অবশ্যই থাকে। শিশু সাহিত্যে কমিকস-এর একটা বড়সড় জায়গা আছে। যেখানে তারা চোখের সামনে গল্প, ছবি সবটা দেখতে পাচ্ছে। বাবা-মায়েরাও কমিকসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছেলে মেয়েদের বই কিনে দিচ্ছে। নারায়ণ দেবনাথ , ময়ূখ চৌধুরী– যাঁরা কমিকসের জগতকে জয় করে শিশুসাহিত্যের জন্য যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটালেন, সেই রাস্তা বর্তমানেও বেশ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠছে। ‘দেব সাহিত্য পরিষদ’ বাংলা ক্লাসিকের জগতে সুকুমার রায়-এর ‘আবোল তাবোল’-এর ছড়াগুলো সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে কমিকসের আকার দিল, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর টুনটুনির নানান গল্প কমিকসে আলোড়ন তৈরি করল। একের পর এক বাংলা ক্লাসিক কমিকসের আকার নিয়ে শিশু মনকে নাড়িয়ে দিল । প্রকাশনা জগতে এল খুশির জোয়ার।

Buy Bantul Samagra Book Online at Low Prices in India | Bantul Samagra Reviews & Ratings - Amazon.in

সত্যজিৎ রায় ছোটদের জন্য আলাদাভাবে ভাবতে শুরু করেছিলেন, তার জোয়ার এখনও চলছে শিশুসাহিত্যে। ছোটদের সঙ্গে সঙ্গে বড়রাও তুলে নিচ্ছে সেই বইগুলো। সম্ভাবনার রাস্তা তো রয়েছে। তবে কেন ছোটদের জন্য আলাদা করে লেখক উঠে আসছে না বাংলা সাহিত্যে? ইংরেজি সাহিত্যতেও কিন্তু ছোটদের জন্য আলাদা ভাবে ভাবা হচ্ছে। বেশ কিছু বেস্ট সেলার বই আছে, যেগুলো ছোটদের জন্যই। আশা করা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যে এমন আরও অনেক লেখক উঠে আসবেন, যাঁদের ওপর ছোটদের আলাদা আকর্ষণ তৈরি হবে। প্রকাশনা জগৎ সমৃদ্ধ হবে।

 

কিন্তু শুধুমাত্র কমিকস দিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রকাশনা জগতকে পুরোপুরি সমৃদ্ধ করা সম্ভব নয়। হয়তো ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ শিশুদের জন্য বই বিক্রি হচ্ছে। যেদিন শিশুদের জন্য ৫০ শতাংশ বই বিক্রি হবে, সেদিন কিছুটা হলেও শিশুদের সাহিত্য জগৎ সমৃদ্ধ হবে। ছোট থেকেই যদি মানুষের মধ্যে চেতনার বীজ বপন করা যায়, তাহলে বটবৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে সেই গাছ ভবিষ্যতেও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেক দূর। জয় হবে প্রকাশনা জগতের, জয় হবে শিশু সাহিত্যের, জয় হবে মানুষের। সেদিন তো বেশি দেরি নেই, সকলে মিলে বই পড়ার অভ্যাসটা যদি আরও বাড়িয়ে তুলি, বড়দের দেখেই ছোটরাও হাতে বই তুলে নেবে। সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধন ছেড়ে বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের গল্প শোনাবে এবং বোঝাবে, সেদিনই একটা সুন্দর সমাজ তৈরি হবে। তাই অল্প অল্প করে আমরা সকলে মিলে ছোটদের পাঠক হিসাবে যদি তৈরি করি, প্রকাশকরাও সাহস পাবে আরও বেশি করে ছোটদের জন্য বই প্রকাশ করার। তৈরি হবে শিশু সাহিত্যের আরও লেখক এবং লেখিকা। একা নয়, দরকার সবাইকেই।

 

প্রচ্ছদের শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী