উস্তাদ রাশিদ খান গাইছেন। কী গাইছেন? রাগ পুরিয়া। শুরুর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তো সমস্ত মেহফিল সম্মোহিত! তারপর ওঁর গান শেষ হল। উচ্চকিত প্রশংসা, হাততালি! কিন্তু আমি দেখছি, ওঁর চোখদুটো খুঁজছে বন্ধুদের। ওঁর ট্রাম-ডিপোর বন্ধুদের, ওঁর কবরখানা আর গলফ ক্লাবের বন্ধুদের।
টালিগঞ্জ কবরখানা, টালিগঞ্জ গলফ ক্লাব আর টালিগঞ্জ ট্রাম-ডিপো। কী পড়ছেন পাঠক? কমন শুধুই ‘টালিগঞ্জ’? একটা জায়গার নাম? না কি দেবু, বিতান, অতনু, বিভাস, রাশিদ এবং ওদের, আরও অনেক বন্ধুর, সূর্যমুখী দুপুর আর পুরিয়া থেকে সোহিনী হয়ে, সুরে সুরে, কথায় কথায়, দরবারি হয়ে যাওয়া রাতের রূপকথা!
টালিগঞ্জ ট্রাম-ডিপোর গুমটিতে তখন আমাদের আড্ডা বসত। যাদের নাম বললাম আমি– বিতান, অতনু, বিভাস, রাশিদ আরও অনেকে। কী-ই বা তখন আমাদের বয়স! রাশিদ সদ্য এসেছে উত্তরপ্রদেশ থেকে। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে শিখেছে। একটার পর একটা ট্রাম চলে যাচ্ছে, শহরময় ঘটাং-ঘটাং ট্রামের শব্দ। তার মধ্যেই রাশিদের ওই উচ্চাঙ্গ সংগীত! গান গাওয়ার সময় বাবু হয়ে বসত। ওর চোখের সামনে থেকে যেন মুছে যেত এই ইট-কাঠ-পাথরের শহর। যমুনার তীর আর টালিগঞ্জের ট্রাম-ডিপোর গুমটি, কোথায় কোন অজানা কুয়াশায় মিশে যেত। আর তৈরি হত এক একটা অবিস্মরণীয় মুহূর্তের মালা। তখনও রাশিদ খান, ভারতের ‘উস্তাদজি’ হননি। অবশ্য তা না হলেও রাশিদ ছিল আমাদের ওই ট্রাম-ডিপোর গুমটির নিজস্ব উস্তাদ! আমাদের সঙ্গে গৌতমদাও থাকতেন। মানে, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গৌতম চট্টোপাধ্যায়। একটার পর একটা রাশিদের গাওয়া গান শুনতেন, আর আমার বেহালা।
কখনও যেতাম গলফ ক্লাবে। ভাঙা পাঁচিল টপকে অবলীলায় আমরা পৌঁছে যেতাম, আমাদের তারুণ্যের স্বর্গোদ্যানে! আবার একঝাঁক আড্ডা, নীল নীল আকাশ, আমি ভায়োলিন বাজাচ্ছি, এক একটা ছড়, এখনও যেন সেইসব স্মৃতি নিয়ে জেগে বসে আছে, আমাদের অপেক্ষায়। শুধু আমরা আর নেই। রাশিদ গান গাইত। সেই ওর খেতাবহীন উস্তাদি গান। ওই প্রথম, নিয়ম টপকানো বাগানেই, ঈশ্বরের বাগান থেকে নেমে আমরা যেন পৌঁছে যাচ্ছি পিলুতে, দেশে, কিংবা নতুন কোনও অনুভূতিতে। যে অনুভূতি, মানুষের।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমরা সব, জীবনে যে যার ব্যস্ততায় ঢুকে পড়লাম। তবু যখনই দেখা হয়েছে, রাশিদের সঙ্গে, ততবারই মনে হয়েছে, এ তো আমাদের সেই দোস্তমহলের উত্তরপ্রদেশ থেকে সদ্য আসা তরুণ ছেলেটা! যে ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে, যে গান ধরলে মনে হয়, সকাল হল!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আজীবন নাস্তিক আমি। কিন্তু রাশিদের তৈরি করা ওই অনুভূতিকে অবিশ্বাস করি কী করে? অবজ্ঞা করি কী করে? কী করে ভুলি সেই দুপুরগুলো? টালিগঞ্জের গলফ ক্লাবের সেই হলুদ দুপুরগুলো, কত দুপুর শুধু ঘুমিয়ে কাটিয়েছি, ক্রিকেট খেলেছি। আড্ডা দিয়েছি। কত গল্প করেছি। সংগীতজ্ঞ হওয়ার কোনও দায় ছিল না তখন, যদিও রাশিদ এসেছিল উত্তরপ্রদেশ থেকে এই বাংলায়, গানেরই জন্য। ও তখন সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির শিক্ষানবিশ। আমি থাকি টালিগঞ্জের চণ্ডীতলায়।
আমরা তখন সেইসব অনুভূতির আঘাতে আঘাতে এমনই জর্জরিত, এমনই বুঁদ– জায়গা-টায়গা আমাদের কাছে মোটেই জরুরি নয়। কী ট্রাম-ডিপো, কী গলফ ক্লাব– এমনকী কবরখানা পর্যন্ত! রাশিদের ওই অদ্ভুত সরল চোখগুলো দিয়ে আমরা একটা শহর দেখতাম। আর গলা দিয়ে দেখতাম, একটা অজানা পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে, আমার শহর, আমার দেশ, আমার সংগ্রাম, আমার পাওয়া, আমার না পাওয়া– সব কিছুই ফুটে আছে, ফুটপাথের পাশে ছোট্ট চারাটার মতোই। তারপর কত দিন এল-গেল। কত ট্রাম ডিপো ছুঁল, কত আলো ছুঁল রাগরাগিণী! আমরা সব, জীবনে যে যার ব্যস্ততায় ঢুকে পড়লাম। তবু যখনই দেখা হয়েছে, রাশিদের সঙ্গে, ততবারই মনে হয়েছে, এ তো আমাদের সেই দোস্তমহলের উত্তরপ্রদেশ থেকে সদ্য আসা তরুণ ছেলেটা! যে ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে, যে গান ধরলে মনে হয়, সকাল হল! একদিন এরকমই দ্যাখা হয়েছে, ‘দেবু, আজ আমার ডোভার লেন আছে, যাবি!’ কথাটা লিখলাম ঠিকই, কিন্তু ওর ভঙ্গিটা তো আর দেখাতে পারলাম না। পারলে বুঝতেন, জীবনের কোনও খেতাবই ওর গানের শিকড়কে দাম্ভিক করে দিতে পারেনি।
গেলাম! ডোভার লেনে। উস্তাদ রাশিদ খান গাইছেন। কী গাইছেন? রাগ পুরিয়া। শুরুর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তো সমস্ত মেহফিল সম্মোহিত! তারপর ওর গান শেষ হল। উচ্চকিত প্রশংসা, হাততালি! কিন্তু আমি দেখছি, ওর চোখদুটো খুঁজছে বন্ধুদের। ওর ট্রাম-ডিপোর বন্ধুদের, ওর কবরখানা আর গলফ ক্লাবের বন্ধুদের।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: নারীবাদী সত্তায় নিজেকে উচ্চকিতভাবে চিহ্নিত করতে চাননি দেবারতি মিত্র
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ততদিনে আমরা প্রত্যেকেই নিজের জীবনে কিছু না কিছু করছি। আমি সংগীত পরিচালনা, রাশিদ তো যথেষ্ট পরিচিত নাম! প্রশংসিত গলা! উচ্চাঙ্গসংগীতের মেহফিলে রাশিদ খান তখন সারা ভারতের উস্তাদ। গুলজার গান লিখেছেন রমেশ শর্মার ছবিতে। এসেছেন কলকাতায়। রাশিদকে দিয়ে, ওর মাটিতেই গান রেকর্ড করাবেন বলে! তেরে আঁখো কা রং হ্যায় মাটি কা।… এরপর গেছি বম্বেতে (মুম্বই)। ‘মিলে সুর তুমহারা হামারা’-র রেকর্ডিং। আমার তো লাগবে মাত্র ২ থেকে ৩ মিনিটের গান, কিন্তু রাশিদের সঙ্গে গান তুলতে বসলেই, অন্তত ৩০-৪০ মিনিট তো গাইতই। ইচ্ছে করত পরিচালককে বলি, তোমার ছবি হিট হোক কি না হোক, রাশিদকে গাইতে দাও। কারণ ওর গান সংগীতের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেই!
অনন্তকাল ধরে গাইতে পারতিস রাশিদ। আমার কথা, পরিচালকের কথা, ঘড়ির কথায় তোর কী এসে যায়! তুই না উস্তাদ? তুই না ট্রাম-ডিপোর হট্টগোলের মাঝে নন্দনকানন তৈরি করতে পারতিস? তোর তো কোনও দিন সাজানো মেহফিল লাগত না । কী এক আশ্চর্য জাদুস্বরে তুই যে কোনও জায়গাকে তোর মেহফিল করে নিতিস।
এ শহরে, আজও ট্রাম চলে। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের ঊর্ধ্বে, তার ঢং ঢং ঘণ্টি এখনও দোলা দিয়ে যায় বুকে। আজও সব ট্রাম গুমটিতে ফেরে ঠিক। আমরাও, সবাই একদিন এভাবেই ফিরে যাব, নিজের নিজের গুমটিতে। শুধু আমাদের গল্পগুলো থেকে যাবে। ট্রাম-গুমটি বা কবরখানার কোনও দায় নেই, একঝাঁক কিশোরের গল্প মনে রাখার, কিন্তু ট্রাম-গুমটি আলো করে থাকা আমাদের নিজস্ব মেহফিলের, সেই ননহা মুন্না নটখট উস্তাদজি আর তার সুরের গল্পগুলো থাকবে, অমলিন। আলো হয়ে।