তিনি পুষ্কর দাশগুপ্ত। কবি ও অনুবাদক। রাগী ও ক্রমে একা। ‘শ্রুতি আন্দোলন’-এর এই তাত্ত্বিক মনে করতেন, শ্রুতি ছিল ব্যক্তি-লেখকের অনন্য, নিজস্ব, ব্যক্তিগত লিখনের সন্ধান। বাংলা কবিতার প্রাতিষ্ঠানিক ধারায় ‘কবি কবি ভাব’, শূন্যগর্ভ রোমান্টিক উচ্ছ্বাসের প্রবণতাকে কঠোর কশাঘাত করেছেন তিনি বারবার। ৩০ আগস্ট, কলকাতা থেকে বহুদূরে, গ্রিসে প্রয়াত হলেন তিনি।
১.
‘কলম থাকার মানেই হল যুদ্ধ করা।’ ভলত্যেয়ার-এর উক্তি। পুষ্কর দাশগুপ্তর অনুবাদে।
ষাটের উজ্জ্বলতার পর সত্তর। বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালের ধুন্ধুমার সময়। অপ্রাতিষ্ঠানিকদের একটা আলাদা দ্যুতি ছিল। তারপর আটের দশক। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটা তখনও ছেঁড়া পাপোশের মতো হয়ে যায়নি। বুদ্ধিবৃত্তিকে শান দিয়ে ব্যবহার করেছেন এমন মানুষদের চোখে দেখা যেত। ব্যক্তিগত ঈর্ষা থেকে শুরু করে নানা ক্ষুদ্রতাকে সরিয়ে রেখেই তাঁদের উচ্চতা টের পাওয়া যেত। সৌভাগ্যবান যথেষ্ট পরিমাণে হলে তাঁদের সঙ্গ করতে পাওয়া যেত। তাঁরা যখন কথা বলতেন, হাঁ করে গেলা যেত। তাঁদের বই পড়ার পাশাপাশি তাঁদের ব্যক্তিত্বের সৌরভ, টক-মিষ্টি-ঝাল মিশিয়ে, পাওয়া যেত। বিশেষত তখন, আমার প্রজন্মের ওপরে ছায়াবিস্তারী গাছের মতো অনেক শিক্ষক থাকতেন… প্রকৃত শিক্ষার মৃদু তাপহরা আলো-আঁধারি থাকত… আশ্রয় থাকত । যে কোনও বিভ্রান্তিতে উত্তর থাকত। একের পর এক আইকনিক শিক্ষক অধ্যাপকের থেকে আহরণ ছিল পরবর্তী প্রজন্মের, ঈষৎ ছোট থেকে অনেক ছোটদের সম্বল। ‘মেন্টরশিপ’ আজকালকার ভাষা। তখন ছিল আবেগ। ভালবাসা। অনুকরণ। অনুসরণ।
সেই ছাত, সেই ওপরের তাক আজ প্রায় খালি। রোজ দরজায় টোকা দিয়ে মনে করায় কথাটা, আরও কিছু অযাচিত মৃত্যু। মনে করায় আমরা বৃদ্ধ হলাম। মনে করায়, আমাদের মনের ভিত্তি যাঁরা গড়ে দিয়েছিলেন, সেই সুবিশাল একটি প্রজন্ম শেষ হয়ে চলেছে। নয়ের দশকে লেনিনের মূর্তি ভেঙে পড়ার দৃশ্যের চেয়ে কম কিছু মানসিক আঘাত নয় এই অনুভব– যে ওঁরা ছিলেন, আর ওঁরা আপাতত নেই। স্মৃতির দরোজা খুলে দেয়। হু হু বেগে ঢুকে পড়ে পুরনো কথা মনের ঘরদোরে। উড়তে থাকে শুকনো শালপাতার মতো সেইসব তরুণ দিন। সেভাবেই শুনলাম ৩০ আগস্ট চলে গেছেন পুষ্কর দাশগুপ্ত।
১৯৯৫ সাল। পার্ক স্ট্রিট, আলিয়ঁস ফ্রসেঁজ। আমার করা প্রথম ফরাসি ক্লাস। পুষ্কর দাশগুপ্ত নিয়েছিলেন। সেই ছাপ কোনও দিন যাবে না মাথার ভিতর থেকে। শুরুতেই বলেছিলেন, একেবারে শুরুর ক্লাস কামাই করবে না, করলে ভাষাটাকে ধরতেই পারবে না। নিয়েছিলেন প্রথম দুই সেশন। খুব কড়া। রাগী। এলিমেন্টারি ক্লাসেও একটা ইংরেজি বা বাংলা শব্দ চলবে না। প্রচুর অঙ্গভঙ্গি-সহ ফরাসি শব্দের মানে বোঝাবেনই বোঝাবেন। সেখানে আবার কমেডিয়ানদের মতো। অকুণ্ঠ, অবাধ। একেবারে পাশ্চাত্যের সৌরভ বয়ে আনা। ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুলে অপ্রতিরোধ্য একটা ব্যক্তিত্ব আকর্ষণ। ক্লাসের বাইরে হাসিখুশি বাংলাভাষী। জানি তাঁর নাম আগে থেকেই। তখন অলরেডি কবিতা জগতে আমার পদার্পণ ঘটেছে। বাংলা কবিতার জগতের প্রত্যেকে পুষ্করদাকে চেনে, বলে, ‘আলিয়ঁসে পড়ছ? ওখানে তো পুষ্কর আছে।’
এখন ভাবতে অবাক লাগে। এলিমেন্টারি ক্লাসে উনি অংশ নিতেন কেন? না নিতেও পারতেন। অনেক অধ্যাপকই, দেখেছি, বড়দের ক্লাস নিতে বেশি স্বচ্ছন্দ। কারণ এলিমেন্টারি ক্লাসে পড়াতে তুমুল এনার্জি প্রয়োজন। প্রচুর পরিমাণে পরিশ্রম করতে হয়। পুষ্করদার ওই ছবিটাই মাথায় থাকে আমার। অত পণ্ডিত মানুষ, আমাদের অবোধ শিশুর মতো করে ভাষাশিক্ষা দিচ্ছেন। পেশা নয়, ফরাসি পড়ানোটা নেশা না হলে কেউ এভাবে পারে না।
পরে তাঁর লেখা পড়লাম। কনস্তান্তিন কাভাফির বই, তাঁর অনুবাদ তত্ত্বের বই, সেসব পড়া। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের নানা রং। দুটো সেশনের পর তৃণাঞ্জনের কাছে পড়লাম। দেবাশিসদার কাছেও। পুষ্করদার ছাত্র ছিল তৃণাঞ্জন। সেই সূত্রেই আরও কত আড্ডা। কথা। আলোচনা। প্রচুর মজা করা। আলিয়ঁসের ক্যাফেতে বসাটা ছিল এক ধরনের আনন্দময় সংযোজন। ক্লাসের পরে।
তখন তো ফেসবুক ছিল না। ভার্চুয়াল চণ্ডীমণ্ডপ ছিল না। ছিল ক্যাফে বা চায়ের দোকান। ছিল রাস্তায় একসঙ্গে হেঁটে যাওয়া ফুটপাথ ধরে। ছিল রাস্তার কোন, মোড়ে জটলা করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা। অপরূপ সেইসব কথোপকথন। যা থেকে চলত আহরণ। নিজের অজান্তেই শিক্ষিত হয়ে ওঠা।
পুষ্করদার উৎসাহে দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘Le 24’ বেরুত, পরে পলিফনি নামে পত্রিকা। Polyphony নিয়ে আড্ডা, কথা। আড্ডায় আসতেন, তুষার চৌধুরী ( যে কবির কোনও লেখাই গদগদ ভাববাদী বাংলা কবিতার নয়, এবং অকালপ্রয়াণের কিছুকাল আগেই র্যাঁবোর ইল্যুমিনেশন্স অনুবাদ করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন) , প্রদীপ ভট্টাচার্য ( ‘একালের রক্তকরবী’-র বিখ্যাত সম্পাদক), অশোক ভট্টাচার্য, নারায়ণ মুখোপাধ্যায় ( আরেক ফরাসি চর্চার দিকপাল), পবিত্র মুখোপাধ্যায় এইসব বাঘা বাঘা ব্যক্তি। এবং তরুণ পিনাকী ঘোষ, মণীশ সিংহ রায়, বিকাশ গণ চৌধুরী, সর্বজিৎ সরকার।
পরে, গ্রিস নিবাসী হয়ে গেলেন পুষ্করদা। তারপর সম্প্রতি আবার ফেসবুকে। পুষ্করদার টক-ঝাল-মিষ্টি রাগী পোস্ট। অ্যাটিটিউড দেখানো। কথায় কথায় চারিপাশের মিডিওক্রিটিকে তুশ্চু করে দেওয়া। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলা, মহৎ সাহিত্যের কথা। দীর্ঘ দীর্ঘ অনুবাদে সঁদ্রারস। ব্লেজ সঁদ্রারসের কবিতার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও নিজেও কিছু অনুবাদ করার স্পর্ধা– এখন মনে হয়ে পুষ্করদার থেকেই। ওঁর মন ও মননের মধ্যে যে মেধার ঝলক, তার অনেকটাই ফরাসি যুক্তিবাদীদের থেকে পাওয়া, তাই সঁদ্রারসের কথাগুলি যেন অনেকটা ওঁরও নিজের কথা।
‘পানামার দেউলিয়া হওয়ার ঘটনাটাই আমাকে কবি করে দিল
ব্যাপারটা মজার
আমার সমবয়সীরা সবাই এরকমই
কম বয়সীরা
যারা অদ্ভুত ওঠানামা ভোগ করেছে
আমরা আর আসবাব নিয়ে খেলি না
আমরা আর পুরনো দিনের জিনিসপত্র নিয়ে খেলি না
সারাক্ষণ আর সর্বত্র আমরা বাসনপত্র ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো করি
আমরা জাহাজে চড়ে দেশান্তরে পাড়ি দিই
আমরা তিমিমাছ শিকার করি
আমরা সিন্ধুঘোটক মারি’
সেইসব উচ্চারণ। অনুবাদেও যা তাঁর নিজ উচ্চারণের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অবিরত।
‘আমার তেষ্টা পেয়েছে
গোল্লায় যাক
গোল্লায় যাক সব
গোল্লায় যাক সব’
কে বলে এসব অনুবাদ!
২.
ছয়ের দশকে কয়েকজন কবি শব্দের দ্বৈতমাত্রার সন্ধান করতে চেয়েছিলেন। বিদেশি কংক্রিট কবিতা-সহ অন্য কবিতা ভাবনায় তাঁদের আন্দোলন ছিল শ্রুতি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে। এই আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন ফরাসি ভাষাবিদ কবি পুষ্কর দাশগুপ্ত। আজও নতুন লিখতে আসা কবিদের কাছে এই আন্দোলন ও তার কবিরা সমান আগ্রহের বিষয়। সে সময়ের বিখ্যাত কিছু লেখক ছিলেন এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। প্রথমেই মনে পড়ে রমানাথ রায়ের নাম, মনে পড়ে সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। প্রবীর রায়কে অনলাইনে/ টেলিফোনে দেওয়া তাঁর এক সাক্ষাৎকারে তিনি শ্রুতি আন্দোলন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি বারবার বলেছি এবং আরো একবার বলছি শ্রুতি ঠিক কোনো একটা দলের দলগত আন্দোলনের আকার নেয়নি। আমরা তা চাইওনি। শ্রুতি ছিল ব্যক্তি-লেখকের অনন্য, নিজস্ব, ব্যক্তিগত লিখনের সন্ধান। পাশাপাশি গতানুগতিক দার্শনিকতা আর কাব্যিকতা পেরিয়ে আধুনিক কবিতার নির্মাণের প্রয়াস। বাংলা কবিতা ইংরেজি আর রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার সীমা আজও পেরোতে পারেনি, শ্রুতি ছিল ওই সীমা পার হওয়ার একটা প্রয়াস।’
কাটা কাটা বাক্যে পুষ্কর বলেন সমকালীন বাংলা কবিতা সম্পর্কে: ‘এই সময়ের বাংলা কবিতায় দুটো প্রবণতা আমি দেখতে পাই। একটা কাব্যিকতার (জয়, শ্রীজাত, ইত্যাদি) ধারা আরেকটা অন্যতর লিখনের, নিজস্ব কবিতার জগতের সন্ধান ও সৃজনের প্রয়াসী কবিতার ধারা। প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনে প্রথম ধারা জনপ্রিয়। আজকের লিখনের আর নিজস্ব জগতের নির্মাণের প্রয়াসী কবিতার জনপ্রিয় হওয়া প্রায় অসম্ভব। সাহিত্য পড়ানোর মান্ধাতার বাপের আমলের বিদ্যায়তনিক পদ্ধতিও কবিতা পড়ার অক্ষমতার জনক।’
ফরাসি কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘কবিতায় ভাষা বা লিখনের চিন্তাই আজকের ফরাসি কবিতার প্রধান বিষয়। তবে যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হল কবিতা পড়ানোয় ভাষাবিজ্ঞান আর আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের প্রয়োগে সাহিত্য পড়ানো। সাহিত্যের সক্রিয় পঠনের শিক্ষা।’
ঠিক এর বিপ্রতীপে, বাংলা কবিতার প্রাতিষ্ঠানিক ধারায় ‘কবি কবি ভাব’, শূন্যগর্ভ রোমান্টিক উচ্ছ্বাসের প্রবণতা নিয়ে কঠোর কশাঘাত করেন পুষ্কর বারবার। তত্ত্বের দিক থেকে সরে যাওয়া বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালদের প্রতি তাঁর মন্তব্য– কবিতা যে তেলেভাজা নয় এটা বুঝতে হবে।
শেষদিকে ছয় ও সাতের দশকের অপ্রাতিষ্ঠানিক লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সম্পূর্ণ যুগাবসান আমরা দেখেছি। আজকের বাংলা লেখালেখির জগতে কোনও ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক’ নেই। কোনও প্রতিবাদী নেই। ফলে পুষ্কর দাশগুপ্তের মতো যুক্তিমনস্ক, খরশান মানুষের একা হয়ে যাওয়া বিধিনির্দিষ্ট। তার ওপর তিনি ছিলেন বিদেশবাসী। শেষ তিন চার বছর বিরক্ত হয়েই একরকম ফেসবুক ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কলকাতায় সাতের শেষ থেকে গোটা আটের দশক জুড়ে যেসব ছাত্রদের তিনি রেখে গিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের মেন্টর হিসেবে মনে রাখবে পুষ্করদাকে। থেকে যাবে অনুবাদের তত্ত্ব নিয়ে তাঁর গুরুত্বের কাজ। বেশ কিছু অনুবাদ, কিছু প্রবন্ধ। সুকুমার রায় থেকে রোলাঁ বার্ত অবধি বিস্তৃত তাঁর কাজের পরিধি।