বসে গাওয়ার মধ্যে তাঁর যে শারীরভাষা ফুটে উঠত, তা আমি খুব কম শিল্পীর মধ্যে দেখেছি। মনে হত ওই গানটা বিশেষভাবে তাঁর নিজের গান হয়ে উঠেছে, ওই দেহ ওই কণ্ঠের জন্যই যেন গানটি তৈরি হয়েছিল। আজ তাঁর মৃত্যুদিন। তাঁর জন্মদিন ২২ আগস্ট। স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন পবিত্র সরকার।
আমরা যে সময়ে যৌবনে পৌঁছেছি, গত শতকের পঞ্চাশের বছরগুলির মাঝামাঝি, তখন জর্জদা ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অনুষ্ঠানের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রামোফোন রেকর্ড আর রেডিয়োর জগতে পৌঁছে গিয়েছেন। কিন্তু যতদূর মনে হয়, সুবিনয় রায়ের মতোই, ১৯৬১-তে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর বিস্ফোরণের আগে, তাঁর খুব বেশি একটা রেকর্ড বেরয়নি। মনে পড়ে, কনক দাসের বা বিশ্বাসের সঙ্গে ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’ বেরিয়েছিল একটি ৭৮ ঘুরনের রেকর্ডে, আর সম্ভবত তাঁর একক ‘তুমি রবে নীরবে’ একটি রেকর্ডে। কেন যেন উল্টোপিঠের (তখন দু’টি মাত্র গানই থাকত দু’পাশে) গানগুলোর কথা মনে নেই। পাঠকদের অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে।
কিন্তু রেডিয়োতে তাঁর গানের জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম। তখন ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকা বেরত, তাতে দেবব্রত বিশ্বাসের নাম থাকলে নীচে লাল কলমে দাগ দিয়ে রাখতাম। পুববাংলার গ্রামের উদ্বাস্তু ছেলে তখন মফস্সল-শহরের সর্বব্যাপ্ত হিন্দি সিনেমার গানের সম্মোহন পার হচ্ছি, রবীন্দ্র সংগীতের ঝরোকা খুলে একটু করে তার ঐশ্বর্যপুরীর আভাস পাচ্ছি, আর পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, এমনকী, সন্তোষ সেনগুপ্ত– এই নামগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক স্মরণে জায়গা করে নিচ্ছে। কিন্তু রেডিয়োতে দেবব্রত বিশ্বাসের জন্য আলাদা একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতে লাগল, শুধু তাঁর অবিশ্বাস্য রকমের বলিষ্ঠ ও দরাজ কণ্ঠের জন্য নয়। আমাদের শোনা রবীন্দ্রসংগীতের সংখ্যা খুব বেশি তখন হয়নি, তারই মধ্যে তিনি যেসব গান গাইতেন সেগুলি আমাদের বহুশ্রুত রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে পড়ত না। প্রতিবারই নতুন নতুন, আগে না-শোনা গান। আজ ‘মহারাজ এ কী সাজে’ তো কাল ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে’ বা ‘হৃদয় আমার যায় যে ভেসে’ বা ‘আমি কেমন করিয়া জানাব’। পরে তাঁর গান সামনে বসে শুনে দেখেছি যে, সেটা অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা। তাঁর চোখেমুখে আর স্বরভঙ্গিতে যে আত্মনিবেদন ফুটে বেরত, রেডিয়োতে তা না পেলেও, বেতার তরঙ্গে তার আবেগটি এসে পৌঁছত। আর পুরনো গানও যখন গাইতেন, তখন মনে হত গানটা একটা নতুন প্রাণ পেয়েছে। যেমন বলি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমার খুব প্রিয় শিল্পী, আমাদের যৌবনকালের সংগীতনায়ক বলা যায়। তাঁর লতা মঙ্গেশকারের সঙ্গে ‘তোমার হল শুরু’ আর ‘মধু গন্ধে ভরা’ গান দু’টি শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু দেবব্রত যখন পরে একদিন রেডিয়োতে প্রথম গানটি, তারও পরে একদিন দ্বিতীয় গানটি গাইলেন, তখন মনে হল গানটা নতুন এক অর্থ নিয়ে ভেসে এল। ফলে তাঁর গাওয়া গানগুলো সম্বন্ধে আমার পুরনো বাংলা থিয়েটারের একটা কথা খুব মনে পড়ে। তখনকার দিনে কোনও অভিনেতা কোনও চরিত্রে খুব ভাল অভিনয় করলে বলা হত, ‘অমুকে ওই পার্টে একেবারে জ্বালিয়ে দিয়েছে’। মানে চরম ভাল একটা চেহারা দিয়েছে, যাকে ডিঙিয়ে যাওয়া আর কারও পক্ষে সম্ভব হবে না। দেবব্রত বিশ্বাসের বহু গান শুনলে আমার সেই কথা মনে না হয়ে যায় না।
বস্তুতপক্ষে আমরা সেই প্রজন্মের মানুষ, গর্ব না-লুকিয়েই বলি, অন্যরা আমাদের ঈর্ষা করতেই পারো; কারণ আমরা দেবব্রত বিশ্বাসকে সামনে বসে গান গাইতে শুনেছি। ইউনিয়নের পান্ডা ছিলাম বলে তাঁকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচুর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে এনেছি, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউর হিন্দুস্থান বিল্ডিংয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দর-কষাকষি করেছি। তিনি চল্লিশ টাকা চেয়েছেন, তো আমরা বলেছি পঁয়ত্রিশের বেশি দিতে পারব না। তিনি ‘আমারে তোমরা মাইরা ফালাইবা’ বলে পাজামা আর ময়লা গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে, পাশে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে, বাইক ভটভট করে চলে এসেছেন কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বা রাজাবাজার ক্যাম্পাসে। ইউনিয়ন অফিসের সামনে বাইক রেখে বসেছেন, কিছু জলখাবার খেয়ে আশুতোষ হলে, সামনের প্রাঙ্গণে বা দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ের ছাদে গান গাইতে উঠেছেন। তাঁর চেহারা তো প্রচলিত অর্থে সুদর্শন ছিল না। কিন্তু তিনি যখন রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, তখন তাঁকে আমার দেবদূতের চেয়ে সুন্দর বলে মনে হত। আমার মনে আছে, ছাত্রজীবনে একবার পঁচিশে বৈশাখে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়েছি, সেখানে তিনি ধরলেন ‘তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে’। ওই গান যে অমনভাবে গাওয়া যায়, তা ভাবতে পারিনি। তাঁর পাশে বসে বিশ্বভারতীর তৎকালীন উপাচার্য সুধীরঞ্জন দাস কাঁদছেন, আমাদের চোখও ভিজে উঠছে। বসে গাওয়ার মধ্যে তাঁর যে শারীর-ভাষা ফুটে উঠত, তা আমি খুব কম শিল্পীর মধ্যে দেখেছি। মনে হত ওই গানটা বিশেষভাবে তাঁর নিজের গান হয়ে উঠেছে, ওই দেহ ওই কণ্ঠের জন্যই যেন গানটি তৈরি হয়েছিল।
পরে মনে হত, তাঁর ক্যাসেটের গানগুলিতে অত বাজনা, বিশেষত কি-বোর্ড ইত্যাদির সংগতের কোনও দরকার ছিল না। হ্যাঁ, বয়সের কারণে গলা দুর্বল হতেই পারে, কিন্তু তাঁর আশ্চর্য গায়ন যে কোনও রবীন্দ্রসংগীতকে আমাদের কাছে বিচিত্র ও দুর্ধর্ষ করে পৌঁছে দিত।
আমি খুব আনন্দিত যে গত শতকের পঞ্চাশের বছরগুলির অস্পষ্টতা থেকে রবীন্দ্র-শতবার্ষিকীর পরে জর্জদার যে মূর্তি তৈরি হয়েছে, তাকে ইংরেজিতে বলে ‘মাচ লার্জার দ্যান লাইফ’। আসলে ওইটাই ছিল তাঁর আসল আকার, আমরা সেটা আগে আবিষ্কার করতে পারিনি। এই মহিমা তাঁর প্রাপ্য ছিল। শতোত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথ এসে হাত রাখলেন তাঁর মাথায়।