আসল-নকল; সিনেমা-জীবন, সত্যি-মিথ্যে সবই যে এক ও একাকার, তাই-ই একটু ফরাসি কায়দায় বুঝিয়ে দিলেন চ্যেইলান। সত্যি বলতে কী ছবিটা দেখতে দেখতে বারবার মনে হয়েছে, সামেতের গল্প হয়তো চ্যেইলানেরই– এই জটিলতা, এই একাকিত্ব, এই শৈত্য, স্বার্থপরতা, তীর্যকতা আর ওই শুকনো ঘাসের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া সবটাই হয়তো ব্যক্তিগত, এবং তাইই পবিত্র। ন্যুরি বিলি চ্যেইলান-এর ‘অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাসেস’ নিয়ে একটুকরো আলোচনা।
২০২৩-এর কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের ছবির সম্ভার সত্যিই অতুলনীয়। প্রচুর ছবি, দেশি, বিদেশি, মাস্টার্সদের, নিউ মাস্টার্সদের, স্পেশাল ফোকাস, রেট্রোস্পেকটিভ, রেস্টোর্ড ক্লাসিক– ক্যাটেগরি এবং জঁরের ছড়াছড়ি। এর মধ্যে থেকে একেক দিনের একটি বিশেষ ছবি নিয়ে লিখতে বসলে বেশ ফাঁপরে পড়তে হয়, কোন ছবিটি বাছব আর কোন ছবিই বা বাছব না– এই নিয়ে মস্তিষ্কে তর্ক-বিতর্ক চলে খানিক। গতকাল, উৎসব উদ্বোধনের পরের দিন, বিভিন্ন হলে যে ছবিগুলি দেখানো হয়েছে, তার ভিতর থেকে আমি বেছে নিলাম তুর্কি পরিচালক ন্যুরি বিলি চ্যেইলান-এর সাম্প্রতিক ছবি, ‘শুকনো ঘাসগুলির বিষয়ে’ অথবা ‘অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাসেস’। এই ছবিটি নিয়ে কথা বলতে চাই– এমন সিদ্ধান্তে আসার আগে বিস্তর দ্বন্দ চলেছে নিজের সঙ্গে, তার কারণ ছবিটি আমার ভালো লাগেনি। ভালো লাগা বলতে যা বোঝায়, মনে আনন্দ, কাথারসিস, পরিতৃপ্তি, চোখের জল– কোনও কিছুই এই ছবি আমাকে দেয়নি, তবু এই ছবি নিয়েই আমাকে আজ লিখতে হবে, কারণ ছবিটি আমাকে ঘন জাঁদরেল শীতের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে, ছাড়ছেই না। অন্য পছন্দের ছবিগুলি নিয়ে ভাবতে বসলেও বুলডোজারের মতো ঢুকে পড়ছে ন্যুরি বিলি চ্যেইলান। যেন তাঁর ভাঙাচোরা ইংরেজি, স্বভাবসিদ্ধ মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া বাক্যে বলছে – আমি তো বানাতে চাইনি তোমাদের ভালো লাগার ছবি, আমি তো বিশ্বাস করি না পজিটিভ, ইতিবাচক সমাপ্তিতে। আমার ছবি পেসিমিসটিক, আমি ব্যালান্স করতে পারব না, চাই না। হ্যাঁ তাই, তো কী করা যাবে!’ অগত্যা! এই ছবি এবং পরিচালককে উপেক্ষা করার উপায় আমার নেই। তাছাড়া, ভালো লাগা ছবি নিয়ে অনেক ভালো কথা বলা যায়, কিন্তু ‘ভালো-না-লাগা’ ছবি যখন এমন জুড়ে বসে, তখন সে ছবি নিয়ে চর্চার দরকার হয়, এ. আই-এর যুগে, ‘চর্চা’ ব্যাপারটি মূল্যবান বটে!
চ্যেইলান তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ‘থ্রি মাংকিস’ ছবিতে, তারপর একের পর এক ‘উজাক’, ‘স্লিপিং উইন্টার’, ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আনাতোলিয়া’; কান চলচ্চিত্র উৎসবের যাকে বলে ‘ব্লু-আইড-বয়’; অন্যতম ‘কনটেম্পোরারি মাস্টার্স’। তার তুরুপের তাস হল, তুরষ্ক বা টার্কির অবিশ্বাস্য জায়গায় কিছু মানুষের গল্প বুনে তোলা, কিছু সম্পর্কের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া ক্যামেরা, যা তীব্র, প্রগাঢ় এবং নানা দ্বন্দ্ব, দ্বিচারিতায় ভরা। এই দ্বন্দ্ব বা দ্বিচারিতা তাদের একান্ত অন্তরের, সম্পর্কগুলির কণা-অনুকণায়, চরিত্রগুলির নিভৃতে– অসহ্যকর আর ঘাম ছুটিয়ে দেওয়া সত্যি বা বাস্তব, আর তাইই যে কোনও ভাল-মন্দ বিচারের অপর প্রান্তে থাকা।
‘অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাসেস’-এর প্রথম শটটিতে হাঁ হয়ে যেতে হয়– ওয়াইড লেন্সে, সম্ভবত পঁয়ত্রিশ, একটি লং শট– সাদা বরফে মোড়া একটি চরাচর, সেই ধূ ধূ করা সাদার মধ্যেই সাদা আলো এসে পড়েছে, সাদা ছায়ার শুয়ে আছে, পেঁজা তুলোর মতো বরফ পড়ছে, আর ফ্রেমের ডানদিকে, দূরে একটি উল্টো লাল ত্রিভুজের সাইনবোর্ড। কালো একটি বাস এসে দাঁড়ায় দূরে, নামে একজন, কালো ওভারকোট, টুপি পরে এক-হাঁটু বরফ ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে আসে সে– সামেত, এই বরফ-গাথার নায়ক, খলনায়ক অথবা মূল মানুষ। সামেত এগিয়ে আসে ক্যামেরার দিকে আর দূরে জেগে থাকে সেই উল্টো লাল ত্রিভুজ; আমার চোখে তা এখন একটি যোনি-র সদৃশ; হয়তো বা কোনও রোবট-নারীর। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে, এমনই সেই সাউন্ড ডিজাইন যে, মনে হবে হাড়ে এসে ধাক্কা মারছে হাওয়া। সামেত এই ছোট্ট তুর্কি গাঁয়ের ইশকুলের টিচার। টিচারদের কোয়ার্টারে তার বন্ধু, সহকর্মী; কেনানের সঙ্গে রয়েছে গত চারটি বছর। সে আর থাকতে চায় না এই নিশ্ছিদ্র বরফের দেশে, এই কয়েক ঘরের জনপদে– শ্লেষ আর এক ধরনের চাপা তিক্ততা, আক্রমণাত্মক ভাব তার স্বভাবজাত। কেনানের মতো সহজ জীবন, তার ছোট-বড় ভালো লাগায়, মুগ্ধতায় শামিল হতে পারে না সামেত। তাদের বান্ধবী ন্যুরি যখন কেনানকে বলে, কেনানের সহজতার গভীরে একটুকরো বিষণ্ণতা খুঁজে পায়ে ন্যুরি, আর তাই কেনানকে ‘ইন্টারেস্টিং’ লাগে তার, তখন বিচ্ছিরি বেঁকা হাসি ফুটে ওঠে সামেতের মুখে। ন্যুরিকে ভালোবাসে না সামেত, কিন্তু ন্যুরির কেনানকে ভালো লাগা নিতে পারে না সামেত; যেমন নিতে পারে না কেনানের এই সরলতা, সহজেই আনন্দ খুঁজে নেওয়া জীবন থেকে– সামেত আঘাত করতে চায় ওদের, আঘাত করেও চুপি চুপি প্ল্যানমাফিক। তবু সামেত ভিলেনও নয়, কারণ সে একটি আশ্চর্য চেনা চরিত্র– শিক্ষিত, ভদ্র, ভালো এবং জটিল; পাশের মানুষটির মতো অথবা আয়নার মানুষটির মতো; যে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে ভালোবাসে, কাজের জায়গায় অবাক হয়ে যাওয়া মুখে প্রিয় বন্ধুর সম্পর্কে কেচ্ছায় ইন্ধন দেয়, ছাত্রীর ওপর রাগে তার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পড়ে, কেনানকে চেপে যায় ন্যুরির বাড়ির ডিনারের নেমন্তন্নের কথা আর ন্যুরির বারণ করা সত্ত্বেও কেনানকে ঠিক জানিয়ে দেয় তার আর ন্যুরির রাত্রিযাপনের কথা। বারো-তেরো বছর বয়সি ছটফটে হাসিখুশি ছাত্রী সাভিমের সঙ্গে সামেতের সম্পর্ক রীতিমতো একটি অস্বস্তিকর জায়গায় নিয়ে গেছে পরিচালক। অতীব সূক্ষ্ণ আর তীব্র এই অংশের বুনোট এমন এক দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, যেখানে একটি পা-ও এধার ওধার পড়লে সিনেমা তলিয়ে যেতে পারত বিশ বাঁও জলে। ছবির শেষে যখন বরফকাল কেটে গিয়ে এসেছে গ্রীষ্ম, শুকিয়ে যাওয়া ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সামেত, সঙ্গেই রয়েছে ন্যুরি আর কেনান, কিন্তু সামেত যথারীতি একা, তখন ভয়েস ওভারে শোনা যায় সামেতের কথা। কবিতার মতো সেই লাইনগুলিতে প্রথম উঠে আসে ‘হোপ’-এর কথা। সামেত সাভিমকে বলে, সাভিমের ওই উচ্ছলতা, ওই কিশোরী পাকামি, ঔদ্ধত্য তাকে আকর্ষণ করে; জাগিয়ে তোলে, যদিও সে জানে বয়স বাড়লেই সাভিমও তারই মতো জীবনের গতে ঢুকে পড়বে। আশা করার বা ইতিবাচক ভাবের এক ক্লান্তিকর প্রচেষ্টা আর তার একঘেয়েমির মধ্যে শেষ হয়ে যায় ‘অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাসেস’।
সামেতের ছুটির পর কাজের জায়গায় ফিরে আসা আর শীতের শেষে অন্য শহরে ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ার মধ্যেকার সময় ঘিরেই প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার এই ছবি। ছবিটির ফার্স্ট কাট নাকি পাঁচ ঘণ্টার ছিল, চ্যেইলানের দীর্ঘতম চিত্রনাট্য। সে অর্থে কোনও গল্প নেই ছবিটির, যেমন থাকেও না বিশেষ কোনও গল্প বা ঘটনা চ্যেইলানের ছবিতে, কিন্তু জীবনের চেয়ে মনোগ্রাহী, মানুষের চেয়ে রহস্যময় গল্প আর কী-ই বা হতে পারে। বেশ কিছু দীর্ঘ কথোপকথনের মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে এই ছবি। একেবারেই ফ্রেন্চ নিউ ওয়েভ-এর ধরন। সংলাপ, কথার পিঠে কথা, মত-মতবিরোধ, ডিবেট। এত কথা ভালো লাগে না আমার, চ্যেইলানের প্রথম দিকের ছবিতে সাকুল্যে কুড়ি-পঁচিশটি সংলাপ থাকত। শিল্পীর এই পথচলা, পাল্টানোর সাক্ষী থাকা দারুণ ইন্টারেস্টিং। চ্যেইলান নিজে একসময় স্টিল ফোটগ্রাফার বা স্থিরচিত্রী ছিলেন, এই ছবিতে সামেত-ও তাই। দু’টি দীর্ঘ স্থিরচিত্রর মন্তাজ রয়েছে ছবিতে– অবশ্যই তা একটি সিগনেচার ট্রিটমেন্ট। হঠাৎ সামেতের ন্যুরির ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ফিল্ম স্টুডিও, ফিল্ম সেটের মধ্যে বেরিয়ে আসা নিশ্চয়ই শুধু চমকের জন্য ছিল না; আমার মনে হয়েছে আসল-নকল; সিনেমা-জীবন, সত্যি-মিথ্যে সবই যে এক ও একাকার, তাই-ই একটু ফরাসি কায়দায় বুঝিয়ে দিলেন চ্যেইলান। সত্যি বলতে কী ছবিটা দেখতে দেখতে বারবার মনে হয়েছে, সামেতের গল্প হয়তো চ্যেইলানেরই– এই জটিলতা, এই একাকিত্ব, এই শৈত্য, স্বার্থপরতা, তীর্যকতা আর ওই শুকনো ঘাসের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া সবটাই হয়তো ব্যক্তিগত, এবং তাই-ই পবিত্র।
আমার ব্যক্তিগত ভাবে চ্যেইলানকে বরাবর মনে হয়েছে আজকের বার্গম্যান; সহজ লিনিয়ার ন্যারেটিভ পরতে পরতে জাপটে ধরে, কখন যে সহজ সোজা লাইনটি ছেড়ে বিনুনির মতো হয়ে ওঠে, তার বুনোট বোঝা যায় না, শুধু হঠাৎ খেয়াল হয় বেশ কিছুক্ষণ শ্বাস নেওয়া হয়নি। ছবির শেষে মনে হয় একটা চরিত্রর সঙ্গে হাতে হাত রেখে হাসতে-কাঁদতে পারলাম না, ভালোবাসতে পারলাম না তাদের গল্পগুলোও, অথচ রাতে বরফ এসে ঢেকে দেয় ঘর, খাট, বিছানা; বরফ গলানো জলের ধারার কুলকুল শব্দে ডুবে যায় কলকাতা।
অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাসেস
পরিচালক: ন্যুরি বিলি চ্যেইলান