Robbar

কাঁধে ঝোলানো ল্যাপটপে কাজ আসে অকস্মাৎ আততায়ীর মতো

Published by: Robbar Digital
  • Posted:April 30, 2025 9:26 pm
  • Updated:May 1, 2025 7:47 pm  

সপ্তাহে ৭০-৮০-৯০ ঘণ্টার পরেও অবশিষ্ট সময়ে যা পড়ে থাকে, তা হল ল্যাপটপ। কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ল্যাপটপ ব্যাগকে দেখিয়ে আমার এক বন্ধু বলেছিল, ‘এর মধ্যে কী আছে জানিস? আত্মআর্তনাদ। আততায়ীর মতো কাজ আসে এখানে।’ কোভিডকালের পরে অনেক সংস্থা তাদের কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করার জন্য ইন্ধন দিচ্ছে। অফিসের ভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ বাঁচছে প্রভূতভাবে। বেঁচে যাচ্ছে ‘আনপ্রোডাক্টিভ’ চা কফি-র খরচও। কমছে অকাজের হা হা হি হি। তুমুল কাজের চাপে কর্মীরা কার্যত গৃহবন্দি। বহু বাড়ির অন্দরমহলে মধ্যরাতেও জেগে থাকে ল্যাপটপ, অন্তরমহলকে নিঃস্ব করে। 

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

–আমার ডেস্কে চলে এসো ভ্রমর। কোথায় কেমন করে গুণগুণ করতে হবে বুঝিয়ে দিই তোমায়। হাতে সময় বড় কম।

ভ্রমর আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। ভ্রমর বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা যে বয়সে পরোপুরি মজে ছিলাম ফেলুদা-কাকাবাবু-ব্যোমকেশে, ভ্রমর হাতে তুলে নিয়েছিল ম্যানেজমেন্টের সেল্ফ-হেল্পের বই। কীকরে শীর্ষে উঠবেন, কীভাবে লোক চিনবেন, কীভাবে ঘোড়ার মতো অন্যদের টপকে দৌড়োবেন– এমন বহু বই পড়ে, আন্তর্জাতিক স্তরের বেস্টসেলার গুলে খেয়ে ও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে ফেলেছিল টিকে থাকার মূলমন্ত্র। ‘চেঞ্জ ইজ অলওয়েজ গুড’। এই কথাটা ওর মুখ থেকে শুনেছি কয়েক হাজার বার। কর্মজীবনে ঢোকার পরে আরও একটা বুলি আউড়াত। ‘কাম আউট অফ ইওর কমফোর্ট জোন’। সোজা কথায়, আরাম হারাম হ্যায়। উন্নতি করতে চাইলে আরামকেদারা ছেড়ে বেরিয়ে এসো। তাই টানা পাঁচ বছর ওষুধ বিক্রি করার পরে চলে গেল মাছের খাবারের সেলসম্যান হয়ে। ছিল মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। হয়ে গেল ম্যানেজার–ফিস ফিড। ভ্রমর অবশ্য পরে বলেছিল, ‘ভুল হয়ে গেল বিলকুল।’

কার্টুন: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়

ওই সংস্থায় সেদিন ছিল ভ্রমরের প্রথম দিন। সামনে ম্যানেজার।

–চলে এসো ভ্রমর। সময় বড় কম।

–এই যে স্যর। ডায়েরি নিয়ে চলে এসেছি।

–বেশ। নতুন পাতা খুলে ফেলো। বাঁদিকে এক থেকে তিরিশ অবধি তারিখ লেখো। ডানদিকটা খালি রাখো।

–লিখে ফেলেছি স্যর।

–বেশ। কোথায় থাকো তুমি।

–দমদম।

–ক্যায়াবাত। জায়গাটা তো যোগাযোগব্যবস্থার এপিসেন্টার। লিখতে থাকো। এক তারিখে কাঁথি। দু তারিখে হাসনাবাদ। তিন তারিখে গুসকরা। চার তারিখে হাবড়া। পাঁচ তারিখ মেচেদা। ছ তারিখে বর্ধমান…। লিখছো তো?

–বলছি স্যর, প্রতিদিন দমদম থেকে অতটা দূরে গিয়ে বাড়ি ফিরে পরের দিন আবার নতুন জায়গায়? কখন যাব? কখন ফিরব? আপ ডাউন তো দেড়শো দুশো কিলোমিটার প্রায়।

–গুড কোয়েশ্চেন। তুমি কী বিক্রি করবে জানো?

–জানি তো। মাছের খাবার। আমাদের কোম্পানির প্রোডাকশন।

–বাঃ। চাষিদের সঙ্গে দেখা করার সময় কখন?

–যখন পুকুরে জাল ফেলতে যায়। খুব ভোরবেলা।

–এক্সিলেন্ট। তোমার হবে। তাহলে কখন পৌঁছতে হবে তো জেনেই গেলে। এছাড়া আরও একবার মিট করতে হবে। যখন বিকেলে ওরা চা খেতে বেরোয়, তখন। তোমার কাজটা রুরাল সেলস আর মার্কেটিংয়ের।

–মানে ভোর পাঁচটায় পৌঁছতে হবে?

–ঠিক কথা। 

–বাড়ি ফিরতে ফিরতে তো রোজ রাত এগারোটা হয়ে যাবে স্যর। 

–ঠিক কথা। ফিরে সেদিনের কাজের রিপোর্ট আমাকে পাঠাতে হবে।

–তা হলে তো শুতে শুতে রাত বারোটা। পরের দিন ভোর পাঁচটায় আবার নতুন জায়গায় পৌঁছব কী করে?

–সেটা আমি জানি না। তোমার হেডেক।

–দিনে তো আঠারো ঘণ্টা কাজ। কী করে ম্যানেজ করব?

–ওই যে বললাম। তোমার মাথাব্যথা। আমার নয়। আর কোনও প্রশ্ন আছে? আমার হাতে সময় বড় কম।

ভ্রমর ওখানে টিকেছিল ঠিক দিন পনেরো। ওজন কমেছিল চার কেজি। ফের ওষুধ বিক্রিতে ফিরে আসে। দশ টাকা কেজি দরে জীবনে উন্নতি করার কোটেশন জোগানো সেল্ফ-হেল্পের বইগুলো বিক্রি করে আড়াইশো টাকা পেয়েছিল। 

এক সাম্প্রতিক উইকএন্ড আড্ডায় আমার কলেজজীবনের বন্ধু গেয়ে উঠেছিল, ‘কতটা কাজ করলে পরে বলবে তুমি শেষে, বড্ড বেশি লোকের আজ জীবন গেল ফেঁসে!’ বন্ধু তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। রবিবার সন্ধেতেও খোলা ছিল ল্যাপটপ। এসিতেও ঘামছিল। আর বিড়বিড় করে বলছিল, ‘কোনও এক কালে বুঝি সময়ের দাম ছিল! হায় রে অবসর।’

কোন কাজ যে করব কখন ভেবে যখন খাবি খাচ্ছেন অধিকাংশ মানুষ, ঠিক তখনই প্রকৃত কাজের সময় কতটা হওয়া উচিত– তা নিয়ে দুনিয়া তোলপাড়! নারায়ণমূর্তি সাহেব এবং ইনফোসিস সমার্থক। শীর্ষকর্তা দাবি করেছিলেন, কর্মীদের সপ্তাহে অন্তত ৭০ ঘণ্টা কাজ করা উচিত। ট্রোল-মিম বিদ্রোহ করেছিল সমাজমাধ্যমে। পরে অবশ্য তিনি জানিয়েছিলেন, ৭০ ঘণ্টা কাজ করার জন্য কাউকে জোর করা উচিত নয়। ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স, অর্থাৎ কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষার বিষয়টি প্রত্যেকের একান্ত নিজের বিষয় বলেই উল্লেখ করেন তিনি। তবে একইসঙ্গে নিজের কাজের স্টাইল জানাতেও ভোলেননি। জানা গিয়েছে, গত ৪০ বছর ধরে তিনি প্রতিদিন ভোর ৬টা ২০ মিনিটে অফিসে ঢোকেন। কাজ করেন রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত। এমন তথ্য সহজপাচ্য নয়। স্বাভাবিকভাবেই চোখ কপালে উঠেছে নেটিজেনদের। আন্তর্জালে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে যা মালুম হল, প্রশংসার থেকে তিনি ঢের বেশি সিক্ত হয়েছেন ব্যঙ্গাত্মক কমেন্টে। বাছাই করা কয়েকটি কমেন্ট উল্লেখ করা যাক। 

আপনি তো করবেনই স্যর, কোম্পানির সঙ্গে আপনার যে প্রফিট শেয়ারিং রয়েছে। 

কর্মীরা যদি এত বেশি কাজ করেন, তার জন্য ওভারটাইম? সে গুড়ে বালি! 

তোমার ভুবনে ফুলের মেলা, আমি কাঁদি সাহারায়।

রাতে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করেন কেন?

জগতের প্রফিটযজ্ঞে আপনার নেমন্তন্ন, আমার নয়।

No Stare At Wife For Long': How Narayana Murthy Sparked Work-Life Balance Debate In India - News18
নারায়ণ মূর্তি

আশ্চর্যের বিষয় হল, গাড়ি থামেনি সত্তরে। লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোর চেয়ারম্যান এস এন সুব্রহ্মণ্য়ন এর সঙ্গে আরও ২০ ঘণ্টা জুড়ে দিলেন। বললেন, ‘কাজ করতে হবে সপ্তাহে ৯০ ঘণ্টা, এমনকী, রবিবারেও।’ আরও বললেন, ‘ঘরে বসে করেনটা কী? আপনি কতক্ষণ আপনার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন? স্ত্রীরাই বা কতক্ষণ তাকাতে পারেন স্বামীর দিকে? ছুটির দিনেও অফিসে যান। কাজ করুন।’ সমাজমাধ্যমে ফের ঝড় উঠল। সুব্রহ্মণ্যন এবং ওই সংস্থার কর্মীদের বেতনের ফারাক চলে এল প্রকাশ্যে। আন্তর্জাল বলল, কয়েকশো কোটি আর কয়েক লক্ষের মধ্যে যতগুলো শূন্যের ব্যবধান, সেই শূন্যগুলো আসলে নিংড়ে নেওয়া কর্মীদের চোখের জলের ফোঁটার মতো।

The Case for Working 70 Hours a Week
সূত্র: ইন্টারনেট

আট ঘণ্টা  কাজ আজকের দিনে অলীক স্বপ্নের মতো লাগে। যেন কোনও রূপকথার গল্প। ‘বিমলবাবু সকাল দশটায় অফিসে প্রবেশ করিয়া ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় কর্মস্থল হইতে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হইলেন।’ পরের লাইনটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে। ‘বিমলবাবু রাজা হইলেন।’ আগের লাইনটার শেষে দাড়ি দেব না জিজ্ঞাসাচিহ্ন, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দীর্ঘশ্বাসের কোনও যতিচিহ্ন ব্যাকরণ বইতে নেই! গত বছরের এপ্রিলে কাজের চাপ আর সহ্য করতে না পেরে অকালে চলে গেলেন ২৬ বছরের আনা সেবাস্টিয়ান পেরাইল। পুণের একটি বহুজাতিক সংস্থায় মাত্র চার মাস আগে কাজে যোগ দিয়েছিলেন ওই তরুণী। জীবনের প্রথম চাকরি। মেয়ের মৃত্যুর পর ওই সংস্থার উপরমহলের উদ্দেশে কড়া ভাষায় চিঠি দিয়েছিলেন মৃতার মা। জানিয়েছিলেন দিনের পর দিন মেয়ের রাত জেগে অফিসের কাজ করার কথা। ‘ছুটির দিন’ বলে আদতে কিছু ছিল না। শরীর ও মনের উপরে ক্রমাগত এই ধকল আর নিতে পারেননি মেধাবী চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বুকে ব্যথা হচ্ছিল। কয়েক দিনেই সব শেষ। সমীক্ষা বলে, কয়েক লক্ষ আনা ছড়িয়ে রয়েছে এই দুনিয়ায়। কিছু তথ্য উগড়ে দিতে ভয় করে। শরীরে বয়ে যায় হিমস্রোত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথভাবে করা এক গবেষণার কথা জানতে পারলাম। মাত্রাতিরিক্ত সময় কাজ করার জন্য ২০১৬ সালে স্ট্রোক এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৭ লক্ষ ৪৫ হাজার মানুষ, বিশ্বজুড়ে। সংখ্যাটা ২০০০ সালে এমন মৃত্যুর থেকে ২৯ শতাংশ বেশি। ২০১৬-র পরে আর কোনও রিপোর্টের সন্ধান পাইনি। ভাগ্যিস।

70-Hours Work Week: A Sustainable Practice or a Path to Burnout?
সূত্র: ইন্টারনেট

সপ্তাহে ৭০-৮০-৯০ ঘণ্টার পরেও অবশিষ্ট সময়ে যা পড়ে থাকে, তা হল ল্যাপটপ। কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ল্যাপটপ ব্যাগকে দেখিয়ে আমার এক বন্ধু বলেছিল, ‘এর মধ্যে কী আছে জানিস? আত্মআর্তনাদ। আততায়ীর মতো কাজ আসে এখানে।’ কোভিডকালের পরে অনেক সংস্থা তাদের কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করার জন্য ইন্ধন দিচ্ছে। অফিসের ভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ বাঁচছে প্রভূতভাবে। বেঁচে যাচ্ছে ‘আনপ্রোডাক্টিভ’ চা কফি-র খরচও। কমছে অকাজের হা হা হি হি। তুমুল কাজের চাপে কর্মীরা কার্যত গৃহবন্দি। বহু বাড়ির অন্দরমহলে মধ্যরাতেও জেগে থাকে ল্যাপটপ, অন্তরমহলকে নিঃস্ব করে। 

আট ঘণ্টা কাজ আজ রূপকথার মতো। এই লাইনটা, কেন জানি না, বার বার লিখতে ইচ্ছে করছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে আনন্দবৃষ্টি। আমি চোখ বুজে আছি।

আরও এক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বন্ধুর কথা বলে শেষ করি। ওর সত্তরোর্ধ্ব বাবা-মা সোফায় বসে ছিলেন। একটা সিনেমা শুরু হবে এবারে। সাদা কালো। বন্ধু অফিস থেকে ফিরল। বিধ্বস্ত। দৌড়ে গিয়ে প্রথমেই টিভি বন্ধ করে দিল। সিনেমাটা শুরু হচ্ছিল। টাইটেল স্ক্রিন। 

এমনটা ও করে না কখনও।

সিনেমার নাম ছিল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’।