শ্রাবন্তী মজুমদার মানেই একরাশ নস্টালজিয়া। প্রায় বছর দশেক পরে নতুন বাংলা আধুনিক গান গাইলেন তিনি। একসঙ্গে নিয়ে এলেন তিনটি গান। সঙ্গে তাঁর মিউজিক ভিডিও। দীর্ঘ সময় অতিক্রম করেও তিনি এখনও স্টাইল আইকন। মাথায় সেই ব্যান্ডানা, ছোট করে ছাঁটা চুল, কাজলঘেরা চোখে নিরলস উৎসাহ। এবং সেই অনণুকরণীয় কথা বলার ভঙ্গিমা। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে বসে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ইউকে থেকে এসেই এখানে থাকেন তিনি। রোববার.ইন-এর পক্ষ থেকে কথা বললেন শম্পালী মৌলিক।
দেশে ফিরে কেমন লাগছে?
আমার তো এখানে ফিরে খুব ভালো লাগে, না হলে আসতাম না। গানও করতাম না। আমার বর কলিন বিদেশি, ফলে বিদেশেই থাকি। কলিনও এখানে আসতে খুব ভালোবাসে। সেটা কিছুটা আমারও কৃতিত্ব। না হলে ৩০ বছর আমরা একসঙ্গে থাকতেই পারতাম না! আমাদের দু’জনেরই ভারতে আসতে, কলকাতায় আসতে খুব ভালো লাগে। চারপাশে সব নিজের লোকজন আছে। তোমরাও আমার নিজের লোকজনের মধ্যে পড়ো (হাসি)।
এই বয়সে নিজেকে এত চনমনে রেখেছেন কীভাবে? সেভেনটি প্লাস না?
না, আই অ্যাম এইট্টিন প্লাস। ওয়ান এইট! ‘আই অ্যাম সেভেনট্টিন গোয়িং অন এইট্টিন’ (সুর করে বলে উঠলেন)।
বুঝলাম, এত তরতাজা থাকার চাবিকাঠি কী? এখনও সেই স্টাইলিশ উপস্থিতি!
অনেকে বলেছেন সেটা। তোমরা কেন স্টাইল করো না!
আপনার মতো হবে না।
কে বলেছে? আমার ডিকশনারিতে ‘নো’ বলে কোনও কথা নেই। আমি সবসময় বিশ্বাস করি সবটাই করা যায়। যদি সত্যি চাও। লেখাপড়া করা, গান গাওয়া, আর সব পজিটিভ জিনিস করছ যখন, তাহলে তরতাজাও থাকা যায়। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ফিনিশিং স্কুল করি। একটা পডকাস্ট করব, কেমন একটা ছেলে বা মেয়ের জীবন হতে পারে। সত্যি বলতে, ঠিক বলতে পারব না, কী করে তরতাজা আছি। যে পারিপার্শ্বিকের মধ্যে বড় হয়েছি হয়তো তেমন গুড ভাইবস পেয়েছি। আমি আকাশের স্বপ্ন দেখে বড় হয়েছি, এখনও আকাশের স্বপ্ন দেখি।
১৯৯৪- ’৯৫ সালে আপনি দেশ ছেড়েছেন এতগুলো বছর পরেও বাংলা গানের প্রতি এই ভালোবাসা টিকিয়ে রাখলেন কীভাবে?
’৯৫-এ যদি দেশ ছেড়ে থাকি, তাহলে বুঝবে আমার জীবনের পিক পিরিয়ড এখানে। সব গান এখানে। বাংলা গান, অন্যান্য ভারতীয় ভাষার গান এবং বিদেশি গান নিয়ে বড় হয়েছি। কীভাবে বাংলা গান ভুলব!
বিদেশে থেকেও বাংলা গান শুনতেন?
আমি শুনি। বিদেশি গান সারাক্ষণ শুনি। ক্লাসিক ‘এফ এম’ ফলো করি। খুব ভালো লাগে।
প্রায় দশ বছর বাদে বাংলা গান গাইলেন। তিনটে গান নিয়ে এলেন। তিন ধরনের গান। একটু বিশদে বলুন।
যে গানটা পাশ্চাত্য থেকে নেওয়া, সেটা ছোটবেলার ভালোলাগা গান। যিনি গেয়েছিলেন তাঁর গলা, এখন আমার গলা যেমন ভাঙা-ভাঙা শোনায় সেইরকম। ওদের দেশে এমন গলা নিয়ে অনেকেই গান করেন এবং অসম্ভব ভালো করেন, যেটা আমাদের দেশে চলে না। আমার গলা নিয়েই আমি কত সমালোচিত হয়েছি। ওখানে যে ধরনের গলা নিয়ে সবাই গান করে, ভাবাই যায় না! সেই গান সকলে হইহই করে শোনে। পার্টিকুলার এই গানটার কথা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৬৮ সালে লুই আর্মস্ট্রং ‘হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড’ রেকর্ড করেছিলেন। এখন সারা পৃথিবীতে যে অস্থিরতা চলছে, এই গানটা গাওয়ার আমার খুব ইচ্ছে ছিল। মনে হয়েছিল সময় এসেছে বলার। এটা আমার আশাবাদী গান, ‘কী সুন্দর পৃথিবী’। উনি যে গানটা করেছিলেন, এত পজিটিভ, আমার মনে হয়েছিল দেশকে, শ্রোতাবন্ধুদের, ভাইবোনদের এই কথাটা বলি। সারা পৃথিবী আবার খুশিতে ভরে উঠবে।
আর অন্য গান?
অন্য গানটাও বিদেশি ইন্সপিরেশন। ওদের দেশে হাজার হাজার বছর ধরে ‘সিশ্যান্টি’ হয়ে আসছে। সমুদ্রের নাবিকরা দাঁড় বেয়ে খাবার-টাবার টানত মালিকের জন্য। সেগুলো বিক্রি করলে তবে পয়সা পেত, খাবার কিনতে পারত। ‘সিশ্যান্টি’ গ্রুপ খুব পপুলার। বিশেষ করে দু’বছর আগে একটা গান দারুণ জনপ্রিয় হয়। ওখানে তো গান বাজে, একজনের গান বাজে প্রায় ১৫ বার। সব রেডিও স্টেশন, টেলিভিশন চ্যানেলে বাজে। যেটা আমাদের এখানে নেই। দুর্ভাগ্য। আমাদের এখানে শিল্পীদের গান কোথায় বাজে! না বাজালে, কী শুনবে! পপুলার হবে কী করে। আমাদের সময়ে কম ছিল, তাও ছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও। সৌম্য দাশগুপ্ত, ব্রিলিয়ান্ট মিউজিশিয়ান, দারুণ কম্পোজারও, সৌম্যর সঙ্গে এই গানটা নিয়ে আমি কথা বলেছিলাম। ‘সিশ্যান্টি’ পুরোটা বসানো নয়, বরং আমাদের জেলেদের নিয়ে গানটা। শুনলেই বুঝবে। এই গানটার শুটিং আমরা ইউকে-তেই করেছি। মিউজিকের মিল থাকলেও দুটো গান আলাদা। ওখানকার বাসিন্দাদেরও এই গানটা খুব ভালো লেগেছে। ভীষণ খারাপ ওয়েদারের মধ্যে সমুদ্রের ধারে আমরা শুটিং করেছিলাম। আরেকটা গান হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ থেকে করা। সৌম্যই লিখেছে, তারপর সুর দিয়েছে। প্রথমে বলেছিল কী করে হবে। আমি তো ওইরকম পাগলামি করি (হাসি)। বলেছিলাম গান, কথা মিশিয়ে কর। অ্যারেজমেন্টস-এর পুরো আইডিয়াটা ওর। শিস দেওয়া আর মাউথ অরগান বাজানো আমি সাজেস্ট করেছিলাম।
এই তিনটে গান কি আপনার অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া যাবে?
একদম পাওয়া যাবে। অন্যরাও আগ্রহী। তাঁরা অডিও চেয়েছেন। তবে ভিডিও আমার চ্যানেলেই থাকবে।
আপনার শুরুটা বিজ্ঞাপনের গান দিয়ে। ‘বোরোলিন’, ‘ওয়েসিস’, যেগুলো এখনও মানুষের গেঁথে আছে। এখনকার কোনও জিঙ্গল আপনার ভালো লেগেছে?
না, আমার কানে লাগে না। অন্তত এখনও পর্যন্ত আমি তেমন শুনিনি। আমি তো ১৩টা ভাষায় জিঙ্গল গাইতাম। সব ভারতীয় ভাষায় গেয়েছি, সে ‘বোরোলিন’-ও তাই। সবগুলো ভাষায় হয়েছিল, আমিই গেয়েছিলাম। আমার কাছে এখনও তেমন জিঙ্গল আর আসেনি। হয়তো আছে কোনও বুলবুল, লুক্কায়িত প্রতিভা। আমি শুনিনি।
কী খামতি মনে হয়?
আমি জানি না, সে অনেক বিশাল আলোচনা। আজ থাক।
রেডিও-তে আপনার বেশ কিছু শো খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘বোরোলিনের সংসার’, ‘আরব্য রজনী’র মতো অনুষ্ঠান। এবং সেই সময় আপনার আর কাজী সব্যসাচীর জুটিকে রেডিওর সুচিত্রা-উত্তম বলা হত। এখনকার আরজে-দের সম্পর্কে আপনার কী মতামত?
সে কথা থাক। ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, এটাই আমার উত্তর (হাসি)।
এখন বাংলার রেডিও শোনেন একটুও?
কানটাকে আর খারাপ করতে চাই না।
বিজ্ঞাপনের পরে আপনি গানের জগতে আসেন। সেই সময় আপনার ‘আয় খুকু আয়’, ‘বনমালী তুমি’, ‘মধুপুরের পাশের বাড়িতে’ অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। এইভাবে কি মানুষ এখন গান শোনে? কী বলেন আপনি?
আমার ধারণা শোনে না। সেটা ধরে নিয়েই আমি গান করেছি। এবং ভবিষ্যতেও করব। অ্যালবামটা শেষ করব। যতদিন বাঁচব আমি গান গাইব। সেটাই আমার ইচ্ছে। এরপর ওপরওয়ালা কী করবেন, তিনি জানেন। লোকে যদি না শোনে, আমি নিজে নিজেই শুনব।
এখনকার মিউজিক ফ্রেটারনিটির কারও সঙ্গে যোগাযোগ আছে? আপনি আর ঊষা উত্থুপ-ই তো জিঙ্গলে বাংলার প্রতিষ্ঠিত নাম। যোগাযোগ আছে?
সেভেনটিজ থেকে ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক। হ্যাঁ, আমরা দু’জনেই জিঙ্গল পারতাম, আর তো কেউ পারত না। যখন কথা হয় তখন হয়, সবসময় হয় না। কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে না।
এখন যে সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা মানুষ কেবল রিলস দ্যাখে।
আমি যেখানে থাকি, মানুষ গান শোনে এখনও। ওখানে এল পি বেরচ্ছে, সিডি বেরচ্ছে, ক্যাসেট বেরচ্ছে। ৮০ বছরের ওপরের শিল্পীরও এলপি বেরচ্ছে। নতুনদেরও বেরচ্ছে। ওখানকার দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে এখানকার তুলনাই করতে পারব না এখন। স্টেজে উঠলে যেভাবে ওরা উদ্বুদ্ধ করে শিল্পীকে ভাবাই যায় না। এখন যদি আমি ‘আয় খুকু আয়’ গাই, অডিয়েন্স কিন্তু গাইবে না, আগে গাইত যখন আমি শো করেছি। প্রচুর জলসায় মাইক্রোফোন নিয়ে হেঁটে দর্শকের কাছে চলে যেতাম। অর্গানাইজাররা ভয় পেয়ে যেত, কিন্তু কোনও দিন কিচ্ছু হয়নি। কখনও অসম্মানিত হইনি। এটা আমার দেশের কাছে বড় প্রাপ্তি। শ্রোতারা আমার সঙ্গে গেয়েছে। কত সুন্দর সব স্মৃতি। এখন কী হয়েছে, এখানে জানি না। ও দেশে আগের মতোই। এখন মানুষের অ্যাটেনশন স্প্যান থার্টি সেকেন্ডে নেমে এসেছে। স্বপ্ন দেখতে হবে জীবনে। স্বপ্ন না দেখলে কিচ্ছু করা যাবে না (হাসি)।
চিত্রগ্রাহক: কৌশিক দত্ত
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved