পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চিত্রকর পরিবারগুলোর রমণীদের হাতে তৈরি টেপা পুতুল সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক– যা আজও বহমান। কোনও প্রকার ছাঁচের ব্যবহার ছাড়াই, দশকের পর দশক ধরে চিত্রকর পরিবারের রমণীরা হাতে টিপে, বাঁশকাঠি দিয়ে অলংকরণ করে, রোদে শুকিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে এই পুতুলের ধারাকে বজায় রেখেছে। কিন্তু আজও তারা খ্যাতির থেকে ব্রাত্য থেকে গিয়েছে। এসব শিল্পীদের পুতুলগুলো আদতে প্রাচীন এক স্রোতের থেকে আসা। সিন্ধু সভ্যতায় প্রত্ন-খননের সময় যে মাতৃকা পুতুল উঠে এসেছিল তারই ধারা আজও বহন হয়ে চলেছে ফুলজান, আবিরন, ছবি, শেরিফান চিত্রকরের তৈরি পুতুলে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সার্থকতা তার বহমানতায়। গোটা বিশ্বে এমন অনেক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে যা আধুনিকতার চোরাবালিতে তলিয়ে গিয়েছে। আবার এমন ঐতিহ্যও রয়েছে যা বহু প্রতিকূলতার মধ্যে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়ে আজও বিরাজ করছে।
পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চিত্রকর পরিবারগুলোর রমণীদের হাতে তৈরি টেপা পুতুল সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক– যা আজও বহমান। কোনও প্রকার ছাঁচের ব্যবহার ছাড়াই, দশকের পর দশক ধরে চিত্রকর পরিবারের রমণীরা হাতে টিপে, বাঁশকাঠি দিয়ে অলংকরণ করে, রোদে শুকিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে এই পুতুলের ধারাকে বজায় রেখেছে। কিন্তু আজও তারা খ্যাতির থেকে ব্রাত্য থেকে গিয়েছে। এসব শিল্পীদের পুতুলগুলো আদতে প্রাচীন এক স্রোতের থেকে আসা। সিন্ধু সভ্যতায় প্রত্ন-খননের সময় যে মাতৃকা পুতুল উঠে এসেছিল তারই ধারা আজও বহন হয়ে চলেছে ফুলজান, আবিরন, ছবি, শেরিফান চিত্রকরের তৈরি পুতুলে। শিল্পের বিবর্তিত ধারায় সেখানে হয়তো নতুন কিছু সংযোজিত হয়েছে; কিন্তু পুতুলের প্রাথমিক গঠন ও ভাষ্য একই থেকে গিয়েছে।
লোকসংস্কৃতি-গবেষক তারাপদ সাঁতরা তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পসমাজ’ বইতে এই পুতুলগুলো সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘সংক্ষেপিত অভিব্যক্তি এবং সরস ব্যঞ্জনার মাধ্যমে সৃষ্ট এদের পুতুলগুলি লোকশিল্পের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।’ গবেষক ড. সোমা মুখোপাধ্যায়ের মতে উর্বরতাকেন্দ্রিক ভাব ও ধর্ম-ধারার থেকে এসেছে এই পুতুলগুলো। তাম্রপ্রস্তর যুগে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার উন্মেষ হয়। তখন মায়ের প্রজনন শক্তি ও জমির ফসলের প্রজনন ক্ষমতাকে এক হিসেবে দেখা হয়। মা একদিকে সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, অন্যদিকে জমি ফসলের জন্ম দিচ্ছে। এই উর্বরতাকেন্দ্রিক ধর্ম-ধারা থেকেই মাটির দলাকে হাত দিয়ে টিপে পুতুল তৈরি করেছিল মানুষ। যুগের পর যুগ ধরে এই পুতুল নির্মাণ বিবর্তিত হয়ে আসছে। বাংলায় মঙ্গলকোট, পাণ্ডু রাজার ঢিবি খননের সময় এই ধরনের পুতুল বেরিয়ে আসে। অবিভক্ত মেদিনীপুরের চিত্রকর রমণীরা সেই ধারাই বয়ে নিয়ে চলেছেন। বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অনির্বাণ মিত্রের কথায় অবিভক্ত মেদিনীপুরের মহিলা চিত্রকররা সিন্ধু সভ্যতার হাতে টেপা পুতুলের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। শিল্পীর হাতের আঙুলের হালকা ছোঁয়ায় অভিব্যক্তিময় হয়ে ওঠে এই পুতুলগুলো।
কুলো ভরে যায় সারল্যে
দু’দিকে বাঁশঝাড়। মাঝে সরীসৃপ-রেখায় এগিয়ে চলেছে গ্রাম্য রাস্তা। কয়েকটা কলা গাছ আর মাঝখানে থাকা পুকুর জানিয়ে দিচ্ছে এই স্তব্ধতা আদতে শান্তি দেয়। আর সেই শান্তির মাঝে সৃষ্টির সুখের উল্লাসে মেতে ওঠেন বছর ৬৮-র শিল্পী ছবি চিত্রকর। বয়সের সঙ্গে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। তবুও তাঁর তুলির নিখুঁত টানে আজও সজীব হয়ে ওঠে মাটির টেপা পুতুল।
পূর্ব মেদিনীপুরের কেশববারে বাংলার পুতুলের ধারাকে ধরে রেখেছেন তিনি। ছোটবেলায় ঠাকুমা ও মায়ের হাতে পুতুল বানানোর হাতেখড়ি। তারপর বহু বসন্ত পেরিয়েও শিল্প সৃষ্টির খিদে আজও মরে যায়নি তাঁর মধ্যে। প্রায় ৫৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পুতুল বানিয়ে চলেছেন। কিশোরী বয়সে বেতের ঝুড়িতে করে স্থানীয় গ্রামগুলোতে মাটির পুতুল বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন সেই যুগ আর নেই। শিশুরা আর খেলে না মাটির পুতুল দিয়ে। শিল্পীর কথায়, ‘আগে মূলত গ্রাম্য শিশুদের জন্য মাটির পুতুল তৈরি করতাম। কিন্তু এখন সেই চাহিদা নেই।’ তাঁর তৈরি পুতুল মূলত শিশুদের খেলার জন্য। পুজোর জন্য নয়। এখন সরকারি হস্তশিল্প মেলা ও পুতুলপ্রেমীদের জন্য পুতুল তৈরি করা হয়।
২০ থেকে ২৫ রকমের পুতুল বানাতে পারেন ছবি চিত্রকর। শিল্পী জানাচ্ছেন, ‘মাটি ছেনে হাতে টিপে একটি পুতুলের কাঠামো গড়তে সময় লাগে প্রায় কুড়ি মিনিট’। এর পর শুরু হয় পোড়ানো ও রং করার প্রক্রিয়া। আগে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হলেও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে এখন বাজার থেকে কেনা রং ব্যবহার করা হয়। শিল্পীর আক্ষেপ– পরবর্তী প্রজন্ম আর শিখতে চাইছে না। তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
ছবি চিত্রকর ভালোবেসে তাঁর তৈরি পুতুলকে ‘ষষ্ঠী বুড়ি’ বলে থাকেন। নারী-জীবনের সংগ্রাম, মাতৃত্ব ও সন্তানের প্রতি মায়ের আত্মিক টানকে তিনি পুতুল নির্মাণের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন। গ্রাম্য জীবনের রূপ, রস, সরলতা, সহিষ্ণুতা ও নারীর সঙ্গে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য আত্মিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে তার নির্মিত পুতুল। আবিরন চিত্রকরের তৈরি পুতুলের মতো তাঁর পুতুলের নাক কিন্তু টিকলো নয়। একটু ভোঁতা। আর হয়তো সেই কারণেই তাঁর তৈরি ‘ষষ্ঠী বুড়ি’-তে মুখের অভিব্যক্তি রয়েছে। মৌখিক পেশির ভাষায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে তাঁর তৈরি পুতুল। লাল ও হলুদ রঙের মিশেলে স্বকীয় সজীবতা পেয়েছে শিল্পীর ‘ষষ্ঠী বুড়ি’।
তাঁর তৈরি একটি পুতুলে দেখা যায়, এক জননী ডান হাতে সন্তানকে কোলে নিয়েছে আর বাম হাতে একটি পাত্র। জননীর কাঁধে বসা একটি পাখি সেই পাত্র থেকে জল পান করছে। যেন এক সর্বজনীন মাতৃত্ববোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে তাঁর তৈরি পুতুল। অন্যদিকে সংসার-সীমান্তে যে নিরন্তর জীবনসংগ্রাম কড়া নাড়ে– সেখানে দাঁড়িয়ে, মাথায় ঝুড়ি ও কোলে সন্তানকে নিয়ে এক জননীর এগিয়ে চলার দৃশ্য শিল্পী সুনিপুণ ছন্দে প্রস্ফুটিত করেছেন। লক্ষণীয়– শিল্পীর প্রতিটি পুতুলের কপালে লাল টিকা রয়েছে। হাতির পিঠে নারী। এমন দৃশ্য শিল্পীর তৈরি পুতুলে পাওয়া যায়। আর এই সব নিয়েই খ্যাতির আড়ালে থেকে নিরন্তন সাধনা করে চলেছেন তিনি।
মাটির দাওয়ায় বসে সকল দেবতারা
মাটির দাওয়ায় পাতা রয়েছে পাটি। তার ওপর ঝুড়ি থেকে একটার পর একটা পুতুল সাজিয়ে রেখে চলেছেন এক বৃদ্ধা। শরীরে বার্ধক্য দেখা দিলেও মনের জোরে তিনি নবীনা। সেই পুতুলগুলোর মধ্যে যেমন বঙ্গজ মাতৃত্বের পূর্ণ প্রকাশ রয়েছে; তেমনই রয়েছেন পৌরাণিক ও বৈদিক দেবতারা। ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে পাটির ওপর বসেছে গণেশ, বিষ্ণু, গরুড়, কৃষ্ণ, কলসী হাতে রাধা, মনসা, গৌড়-নিতাই, লক্ষ্মী। সঙ্গে একঝাঁক পাখি, ছলনের ঘোড়া, হাতি, ময়ূর।
নিজের সৃষ্ট শিল্পের এই অনিন্দ্যসুন্দর সমাহার প্রতিবেদককে দেখাতে গিয়ে চোখ সজীব হয়ে ওঠে পশ্চিম মেদিনীপুরের বাঘাগেরিয়া-নিবাসী ফুলজান চিত্রকরের। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে পুতুল তৈরি করে চলেছেন। পুতুল তৈরির হাতেখড়ি মায়ের কাছে। বিয়ের পর সেই কাজ কিছুটা ব্যাহত হলেও সন্তানাদি হওয়ার পর ফের শুরু করেন পুতুল তৈরি। পটচিত্র তৈরির পাশাপাশি চলতে থাকে এই লুপ্তপ্রায় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তীব্র চেষ্টা। শিল্পীর তৈরি পুতুল ভিনরাজ্যে, এমনকি বিদেশে পাড়ি দিলেও আর্থিক অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি।
শিল্পীর কথায়, বর্তমানে পুতুল তৈরির জন্য মাটি জোগাড় করাটা বড়ই কষ্টসাধ্য। পুতুল তৈরি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “মাটি ছেনে তার থেকে ছোট পাথর বের করে দিয়ে হাতে টিপে পুতুলের গঠন তৈরি করতে হয়। দু’দিন ঘরে রেখে বাতাসে শুকিয়ে নিয়ে রোদ দিয়ে পরে ভাটিতে পোড়ানো হয়। তারপর শুরু হয় রঙের প্রক্রিয়া।” আগে চড়কের মেলা উপলক্ষ্যে স্থানীয়দের মধ্যে এই পুতুলের চাহিদা থাকলেও বর্তমানে সখের সংগ্রাহকরাই মূলত তাঁর ক্রেতা। শিল্পীর কথায়, ‘চৈত্রমাস হচ্ছে চিত্রকরদের মাস। চড়কের মেলা উপলক্ষ্যে সেই সময় ভাত খাওয়ার সময় থাকত না। কিন্তু এখন স্থানীয়দের মধ্যে পুতুলের চাহিদা কমে গিয়েছে।’ অন্যান্য চিত্রকরেরা যখন ছাঁচের তৈরি লক্ষ্মী, সরস্বতী বানাচ্ছেন তখন ফুলজান হাতে টিপে গড়ে চলেছেন পুতুল।
ফুলজান চিত্রকরের তৈরি পুতুলগুলোর মধ্যে মনসা বিশেষভাবে দর্শনীয়। মনসার মাথায় সাপের উদ্যত ফণা। আর দেবীর হাতে ফণাযুক্ত দণ্ড। অন্যান্য পুতুলগুলোর মাথা ত্রিকোণ আকৃতির করা হয়েছে। তাঁর তৈরি ‘রাধা’ পুতুলে গ্রাম্য মেয়ের জীবনচরিত প্রস্ফুটিত হয়েছে। কোমরে কলসি নিয়ে এগিয়ে চলেছে রাধা। রঙের ব্যবহার মূলত দু’ ধরনের। প্রথম প্রকারে পুতুলটির গোটা শরীর জুড়ে কালো রং করা। মাথায়, গলায় ও হাতে সাদা রং ব্যবহার করে অলংকরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রকারে লাল ও হলুদ রঙের ব্যবহার। শিল্পীর তৈরি বর্ণহীণ পুতুলগুলির মধ্যেও আদি মাতৃকার স্পর্শ রয়েছে। সেগুলির মুখমণ্ডল টিকলো। কিন্তু রং করলে পুতুলের মুখমণ্ডল ল্যাম্ব শেপ বা ভেড়ার মতো দেখতে। এই ভেড়ার মতো মুখমণ্ডলের গড়ন বাংলার প্রাচীন পুতুল-শৈলীর মধ্যে দেখা যায়।
ফুলজান চিত্রকরের তৈরি পুতুলের মধ্যে মাতৃত্বের স্নিগ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সন্তানকে তেল মাখানো পুতুল। পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে রয়েছে মা। হাত দিয়ে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। দুই পায়ের ফাঁকে তেলের কৌটো। আবার কোনওটিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে কোলে ও হাতে সন্তানদের নিয়েছেন মা। ফুলজানের কথায় ষষ্ঠীর থানে সন্তান কোলে মা-পুতুল দেওয়ার রীতি রয়েছে গ্রামে। সেই রীতির মধ্যে থেকেই শিল্পী নিজের মাতৃত্বের অনুভবকে পুতুলের মধ্যে প্রস্ফুটিত করেছেন।
‘মাটির ঘরে থাকতে অসুবিধা হয় না?’ প্রশ্নটি শুনে দার্শনিকভাবে ফুলজান চিত্রকর বললেন, ‘কালো ঘরটি আমার। দেখতে চমৎকার। সেই ঘরে নাই রে আলো, নাই রে বাতাস, নাই রে ছায়াদান। অচেনা, অজানা দেশে হতাশায় থাকতে হবে। ফলে এই ঘরেই থাকতে হবে।’
ফুলজান চিত্রকরের সঙ্গে কথা বলে মনে হল শিল্পীর সাধনার উন্মেষ শুধুমাত্র শহরে থাকে না। তা থাকে বাংলার প্রতিটি মাটির কোনায়, প্রতিটি গ্রামে, পথে ও প্রান্তরে। এই মাটির ঘরের মধ্যেই শিল্পীর সত্তা প্রকৃতি ও পরিবেশের পরম্পরায় মিলেমিশে রয়েছে।
সখী আয় ভেলায় ভেসে যাই
প্রায় পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বুকে মাটির টেপা-পুতুল বানিয়ে চলেছেন আবিরন চিত্রকর। পুতুল তৈরির পাশাপাশি তিনি পটচিত্রও আঁকেন।
তাঁর পুতুল তৈরিতে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের সংঘ-চেতনা রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে বেচেঁ থাকার বাসনার সাক্ষ্য বহন করে তাঁর পুতুল। গ্রাম-বাংলায় বন্যা হলে কলাগাছের তৈরি ভেলাই ভরসা। সেই ভেলায় করে নিজেদের পোষ্যকে নিয়ে চলেছে গ্রামবাসীরা। একটা ভেলায় ছয় বা আটটা মাটির পুতুল। শিল্পীর নান্দনিক তুলির টানে শৈল্পিকভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে মানবজাতির জীবন সংগ্রামের এই দৃশ্য। আবিরনের ভেলা আবার হয়ে উঠেছে ময়ূরপঙ্খী নৌকো। অর্থাৎ ভেলার সামনের দিকটায় ময়ূরের মুখ বসানো।
অন্যদিকে বাঙালির ফেলে আসা বীরত্বের ছবিও ধরা পড়ে তাঁর পুতুল নির্মাণে। হাতি ও ঘোড়ার পিঠে যোদ্ধা বসে রয়েছে। যেন সেই কবেকার বাঙালি যোদ্ধা জীবন্ত হয়ে উঠেছে তুলির টানে। আবার মাতৃত্ব যাপনের ছোঁয়াও পাওয়া যায় তাঁর পুতুল নির্মাণের মধ্যে। মাথায় ঝুড়ি কোলে বাচ্চা। লোকায়ত জীবনের নারীর সংগ্রামের কথা। কিংবা ধানখেতের আলে বসে চড়াইপাখি। এমন প্রাকৃতিক দৃশ্যও পুতুলের মধ্যে বুনেছেন। এছাড়া গৌর-নিতাই, বাড়িতে থাকা পৌষ্যদের খাওয়ানো– সবই পুতুলে তুলে ধরেছেন শিল্পী।
পুতুল নির্মাণ পদ্ধতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আবিরন চিত্রকর জানিয়েছেন– ‘এঁটেলের সঙ্গে বেলে মিশিয়ে তার সঙ্গে সঠিক অনুপাতে অল্প সিমেন্ট, খড় দিয়ে পুতুল গড়া হয়। আগে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে বাজার থেকে কেনা রং দিয়েই পুতুলগুলোকে রাঙিয়ে তোলা হয়।’ উল্লেখ্য আবিরন চিত্রকরের তৈরি পুতুলের মুখমণ্ডল একেবারে পাখিদের মতো টিকলো। মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই।
বিশাল ফণার ছায়ায় মনসা
লোকশিল্পীদের আর্থিক অনটন চিরকালের। সেই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়েও শিল্পসৃষ্টির প্রতি তাঁদের অধ্যাবসায় কুর্নিশযোগ্য। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পূর্ব মেদিনীপুরের ঠেকুয়াচকের পটচিত্র-শিল্পী মাইরুন চিত্রকরের সঙ্গে বিয়ে হয় শেরিফানের। বিয়ের মাত্র দু’ সপ্তাহের মধ্যে সংসারে দেখা দেয় আর্থিক অনটন। মাইরুন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে পটচিত্র দেখিয়ে চাল-ডাল সংগ্রহ করলেও তা দিয়ে সংসার চলত না। ফলে শাশুড়ি-মায়ের কাছে মাটি দিয়ে পুতুল ও প্রতিমা তৈরি শিখতে লাগলেন শেরিফান। ছাঁচের লক্ষ্মী, গণেশ, নারায়ণ তৈরি। পাশাপাশি চলতে লাগল হাতে টিপে পুতুল তৈরি। বেতের ঝুড়িতে করে পুতুল নিয়ে বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করতেন শেরিফান।
তারপর পেরিয়ে গিয়েছে ৪৫ বছর। পুতুল তৈরির শিল্পকে আজও ধরে রেখেছেন তিনি। তাঁর সন্তানদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছেন এই পুতুল তৈরির ধারাকে। শেরিফানের রং করা পোড়ামাটির টেপা পুতুলের মধ্যে মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়। নারী-জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পাশাপাশি লৌকিক দেবী মনসাকে বিশেষ শৈল্পিক ভাবনায় তুলে ধরেছেন তিনি। একটি চার হাতওয়ালা টেপা-পুতুল কুণ্ডলী পাকানো সাপের লেজের ওপর বসে। আর তার ওপর বিশালাকায় ফণা ছায়া দিয়ে রেখেছে। সাপটির বিন্যাস এতটাই প্রাণবন্ত যেন মনে হবে এখনই ফোঁসফোঁস শব্দ করে উঠবে।
এছাড়া তার তৈরি অন্য আরও একটি সৃষ্টিতে দেখা যায় যে কলসি থেকে মুখ বের করে রয়েছে একটি পুতুল আর তার মাথার ওপর রয়েছে সাপের ফণা। শিল্পীর অনবদ্য ভাবনার স্বকীয়তা এই দু’টি পুতুলের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তার তৈরি পুতুলে মাতৃত্বের সংগ্রামকেও লক্ষ্য করা যায়। মুখে হাসি, মাথায় খাদ্যশস্য একটি ঝুড়িতে করে নিয়ে চলেছে মা, কোলে সন্তান। আবার পা ছড়িয়ে বসে রয়েছে মা, তাঁর দুই কাঁধে সন্তান আর পায়ের মধ্যে সর্ষের তেলের কৌটো। স্বামী মাইরুন চিত্রকর পটচিত্র আঁকার পাশাপাশি বেণীপুতুল শিল্পী। সময় পেলে বেণীপুতুল সাজিয়ে দিতে মাইরুনকে সাহায্য করেন শেরিফান।
নিজেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই সকল শিল্পীরা মেদিনীপুরের টেপা-পুতুলের ঐতিহ্যকে বজায় রাখলেও জনপ্রিয়তা থেকে তাঁরা ব্রাত্য। অথচ এই সকল শিল্পীরা বাংলার আদি অকৃত্রিম শিল্পধারার প্রধান স্তম্ভ।
…………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………