Robbar

রমজানি তেলেভাজা রহস্য

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 26, 2025 9:28 pm
  • Updated:March 26, 2025 9:29 pm  

ঘরে বানানো হোক বা দোকান থেকে কিনে আনা। ইফতারের পর গামলায় মুড়ি নিয়ে তেলেভাজা মেখে খাওয়ার মধ্যেকার যে সুখ! ইফতার পরবর্তী আড্ডায় এইসঙ্গে বসে এক পাত্রে মুড়ি মেখে খাচ্ছেন কয়েকজন– এ দৃশ্য দেখা যাবে মেসে-হস্টেলে কিংবা ঘরোয়া পরিসরে। অফিসে কিংবা কাজের জায়গায় মুসলিম সহকর্মীর সঙ্গে বসে খবরের কাগজে মুড়ি তেলেভাজা মাখিয়ে খাওয়ার মধ্যেকার যে বন্ধুত্ব, সে-ও বাঙালির অনন্য অভিজ্ঞতা।

সেখ সাহেবুল হক

বাঙালি মুসলমান এক আশ্চর্য প্রজাতি। ইফতারে তারা তেলেভাজা খায়। তা নিয়ে বেরসিক এবং অতি স্বাস্থ্য-সচেতনদের সে কী গেল গেল রব! যেন ‘আনহেলদি’ খাওয়াটা আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়!

প্রথমে ফলমূল-শরবত, তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ে মুড়ি-তেলেভাজা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে আসা এই অভ্যাস। সঙ্গত কারণে বিশ্বব্যাপী বহুকাল ধরে গবেষণা চলছে সারাদিন নির্জলা উপবাস করার পর ইফতারে ফল-পাকাড়ি-শরবতের পর কীভাবে গান্ডেপিন্ডে তেলেভাজা খাওয়া যায়? কীভাবে তা উদরে সয়ে যায়! এ রহস্যের সমাধান হওয়া উচিত।

রমজানের খাদ্যতালিকার অন্যতম আকর্ষণ: মুখোরোচক তেলেভাজা

আবহমান কাল ধরে বাঙালির ঘরে ঘরে সগৌরবে চলেছে রমজানে তেলেভাজার জয়যাত্রা। তেলভাজা প্রিয় মানুষের চোখে ভেসে ওঠে মুখরোচক চপের পাহাড়। বেগুনির নৌকো ভাসে। জিভে পেঁয়াজকুচির স্পর্শ,  লঙ্কার ঝাঁঝ ছুঁয়ে যায়। এমন চপ-বসন্তে পাখি সুমধুর কণ্ঠে ডেকে ওঠে, ‘ফুলুরি খাও’।

ভারতের পুণ্যভূমিতে রোজার মাসকে উৎসবের আঙ্গিকে যথাযথভাবে তুলে ধরেছিলেন মুঘল সম্রাটরাই। তাঁদের হাত ধরে ইফতারের এলাহি আয়োজন। মুঘল সম্রাটদের সেই ‘খাদ্য সংস্কৃতি’ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলার চিরন্তনী খাবারেও আসে সেই আঁচ, মিলেমিশে যায় সবকিছু।

আকবর-শাহজাহানদের দরবারে পোলাও– বিরিয়ানিকেন্দ্রিক নবাবিয়ানায় পথ ধরে লখনউ ঘরানার বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, তেহারি ইত্যাদির আগমন। মুঘল দরবারে খাবারের ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে পৃথক এবং বিস্তারিত আলোচনা দাবি করে। মুঘলাই খানা সম্পর্কে খাদ্যরসিকরা নানাভাবে অবগত থাকবেন। হালুয়ার হাজার ফিরিস্তি শুনলে মনে হবে এঁরা কীভাবে এত খেতে পারতেন! সঙ্গে নানাবিধ পানীয়ের কথাও উঠে আসে।

কিন্তু আমরা এখানে কথা বলছি তেলেভাজা নিয়ে। মুঘল আমলের ইফতারে কাবাবের মধ্যে থাকত শিক কাবাব, শামি কাবাবের মতো অন্তত ডজনখানেক কাবাবের তালিকা। মাংসের নানা ভাজাপোড়া, কাবাবের প্রাচুর্যের ইতিহাস, এমনকী, মাংসের কিমা দিয়ে শিঙাড়ার কথাও শোনা যায়। কিন্তু বাংলার শস্যশ্যামল ভূমিতে আলু-পেঁয়াজ-বেগুন দিয়ে তেলেভাজাই রমজানের খাদ্য সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এমনি সময় তেলেভাজা একরকম, আর রমজানি তেলেভাজার আবেদন আলাদা। ঘরোয়া আবেগ, ইফতারের অপেক্ষা ইত্যাদি মিশে জিভে অন্যরকম ভাবে ধরা দেয়।

………………………………………

শুধু কি তেলেভাজা? সহযোগী হিসেবে ইফতারের ছোলাসেদ্ধর কথা না বললে খাদ্যদেবতা পাপ দেবেন! গুনাহের খাতায় কয়েকশো গুনাহ লিপিবদ্ধ হবে। কাঁচা ছোলাকে তেল-পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা-মশলা সহযোগে সামান্য সেদ্ধ করে নেওয়ার মাধ্যমে তৈরি হয় ছোলা সেদ্ধ। মুড়ি খাওয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

………………………………………

আমাদের ছোটবেলায় যখন পাড়ার মোড়ে মোড়ে চপের দোকান গড়ে ওঠেনি। আরও স্পষ্টভাবে বললে, চপ যখন শিল্পের মর্যাদা পায়নি। তখন অজ পাড়া-গাঁয়ে প্রায় সর্বাত্মকভাবে ঘরে ঘরে তেলেভাজার উৎপাদন হত। আসর এবং মাগরিবের মাঝামাঝি সময়ে মা-চাচিমারা ঘরোয়া তেলেভাজার জোগাড় করতেন। বঁটিতে সরু সরু করে কাটা পেঁয়াজ, তার সঙ্গে বেসনের কোমল প্রলেপ দিয়ে পেঁয়াজি। বেগুনির গন্ধে ভরে উঠত রমজানি সন্ধে। কালোজিরের সুবাস। দাদির ডাকে মায়াভরা সন্ধে। কোনও রবিবাসরীয় পাতায় লেখা স্মৃতিচারণার মতো ফিরে দেখা।

শুধু কি তেলেভাজা? সহযোগী হিসেবে ইফতারের ছোলাসেদ্ধর কথা না বললে খাদ্যদেবতা পাপ দেবেন! গুনাহের খাতায় কয়েকশো গুনাহ লিপিবদ্ধ হবে। কাঁচা ছোলাকে তেল-পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা-মশলা সহযোগে সামান্য সেদ্ধ করে নেওয়ার মাধ্যমে তৈরি হয় ছোলা সেদ্ধ। মুড়ি খাওয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

‘রমজানি সাঁঝ’ উঠে এসেছিল কবি শামসুর রাহমানের লেখায়–
‘নানী বিষাদ সিন্ধুর স্পন্দে দুলে
দুলে রমজানি সাঁঝে ভাজেন ডালের বড়া।’

Iftar Food | Breaking the fast with vegetarian food on Zakaria Street during Ramzan - Telegraph India
জাকারিয়া স্ট্রিটের শরবত

আমাদের ফুরিয়ে যাওয়া বয়সকাল জানে এমন ঘরোয়া তেলেভাজায় মায়াভরা অনেক সন্ধে স্মৃতি হয়ে র‍য়ে গেছে। দাদি-নানি-নানাদের সাহচর্যে কুড়িয়ে নিয়েছি অনেক অমূল্য রত্ন।

গরমাগরম তেলেভাজা ঢাকা দিয়ে রাখা হয়েছে। খেতে মন চাইছে। কিন্তু মুসলিম সমাজে ‘আদব’ বলে একটা ব্যাপার হয়। তাই আগেভাগে খাওয়া যাবে না। মাগরিবের আজান হল মসজিদে। মা-আব্বা দোয়া পড়ে ইফতার করলেন। রোজা রাখার বয়স তখনও হয়নি, কাজেই শুধু ইফতার-সেহেরিতেই আছি। আব্বা নামাজ পড়ছেন। তাঁর দেখাদেখি মাথার চেয়ে বড় টুপি পরে কয়েকবার ডিগবাজি খেয়ে নিলাম। খোদ আল্লাহতাহলাও হয়তো হাসছেন সেই নামাজ পড়ার বহর দেখে। নামাজ শেষ, এবার তেলেভাজা খাওয়ার পালা। অনেক সহ্য করেছি, লোক-দেখানো নামাজও পড়েছি, আর না।

ঘরে বানানো হোক বা দোকান থেকে কিনে আনা। ইফতারের পর গামলায় মুড়ি নিয়ে তেলেভাজা মেখে খাওয়ার মধ্যেকার যে সুখ! ইফতার পরবর্তী আড্ডায় এইসঙ্গে বসে এক পাত্রে মুড়ি মেখে খাচ্ছেন কয়েকজন– এ দৃশ্য দেখা যাবে মেসে-হস্টেলে কিংবা ঘরোয়া পরিসরে। অফিসে কিংবা কাজের জায়গায় মুসলিম সহকর্মীর সঙ্গে বসে খবরের কাগজে মুড়ি তেলেভাজা মাখিয়ে খাওয়ার মধ্যেকার যে বন্ধুত্ব, সে-ও বাঙালির অনন্য অভিজ্ঞতা। ছোট ছোট করে তেলেভাজা ভেঙে তা দিয়ে মুড়িমাখা। সঙ্গী হয় পেঁয়াজ-শশাকুচি, চানাচুর, কাঁচালঙ্কা।

কালো রঙের দৈত্যকার কড়াইতে তেল ফুটছে, তাতে সাঁতার কাটছে নাদুস-নুদুস আলুর চপ। একটু পরে ওই সুইমিং পুলে নামবে বেগুনি, ফুলুরি, বোমেরা। ইফতারে আর বেশি বাকি নেই। চপ কিনে ফিরছেন রোজাদারেরা। অমুসলিম কেউ, কিংবা যিনি রোজা রাখেননি, ইচ্ছে হল, প্রথমে ওখানে দাঁড়িয়ে গরমাগরম একজোড়া তেলেভাজা খেলেন। তারপর নিয়ে গেলেন বাড়ির জন্য।

নাদুস-নুদুস আলুর চপ

ইফতারে ইদানীং হালিম ‘মেনস্ট্রিম’ হয়েছে। জাকারিয়া স্ট্রিটের দৌলতে কাবাব-চিকেন ফ্রাই–চাপ-শরবত-ফিরনি ইত্যাদিকে আপন করে নেওয়া হয়েছে। তা অমুসলিমদের খাদ্য অভিযানেরও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ফুড ভ্লগারদের আনাগোনা, রিভিউ– সবমিলিয়ে উৎসবটাই প্রধান হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই আদি-অকৃত্রিম তেলেভাজা, তার উপস্থিতি আসলে রমজানে ‘চপমুড়িতে থাকা’, যার সঙ্গে গ্রামবাংলার আত্মার সম্পর্ক। পরিবার ছেড়ে কর্মক্ষেত্রে একলা ইফতারের শেষপর্বে ঠোঙায় অল্প মুড়ির সঙ্গে তেলেভাজা। ঠোঙা পড়তে পড়তে মুড়ি হাপিশ! চপের শেষ টুকরোটা মুখে পুরে ঠোঙাতেই হাত মুছে নেওয়া। কখনও তেলেভাজা উৎকৃষ্ট পর্যায়ের না হলে আক্ষেপ করে বলা, ‘এত বড় দোকান, চপ বানাতে জানে না। শূলে চড়ানো উচিত!’

‘অন্য দোকান খুঁজতে হবে’– এমন সিদ্ধান্তে থাকে ভালো তেলেভাজা খোঁজার উদ্যোগ। খুঁজে পাওয়ার আনন্দে বলতে পারা, ‘আমি চপমুড়িতেই সুখী।’

চপ নিয়ে এত বেঢপ কথার ভিড়ে আসল তর্কটাই ঘুরে-ফিরে আসে। বাঙালি মুসলমান কীভাবে সহ্য করে এত তেলভাজার আফটার এফেক্ট? বিজ্ঞানীরা কেউ কেউ বলেন, ‘তেলেভাজার সঙ্গে মুড়ির উপস্থিতি তেলেভাজার তেল শুষে নিয়ে পেটের উপর চাপ কমিয়ে পরিপাকে সহায়তা করে।’

কারও দাবি, ‘পুরোটাই জীববিজ্ঞানের সাধারণ ব্যাপার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইফতারে তেলেভাজা খাওয়ার পর অভিযোজন ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে। ফলে সয়ে যায়।’

বাঙালি সমাজে বিজ্ঞজনরা এটাও মনে করেন, ‘গ্যাস-অম্বল নিয়েই বাঙালি। তাতে এসব বিষয়ে গবেষণা করে সময় এবং অর্থ নষ্ট করার দরকারই বা কী বাপু। খাচ্ছ খাও, ছাড়িও না!’

……………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………..