কর্মরত যুবক-যুবতীকে যেচে উপদেশ দেওয়া চলে সময় থাকতে থাকতে সংসারধর্ম পালন না করলে চরিত্রবিচ্যুতি ঘটা খালি সময়ের অপেক্ষা! আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, বিবাহের মতো একখানা বিষয় নিয়ে যে আলটপকা এক্তিয়ার বহির্ভূত আলাপ-আলোচনা চলে, এবং বিপরীতের মানুষেরা অস্বস্তি সহকারে তা নির্বিবাদে হজম করেও নেন, তার এক শতাংশও সন্তান-পালন, গার্হস্থ্য হিংসা এসব নিয়ে হয়ে ওঠে না। তখন সেখানে তর্জনী ঠোঁটের ওপর রেখে জ্ঞানী জ্যাঠা সেজে ‘পার্সোনাল ব্যাপার’-এর ঢাল খাড়া করা চলে অতি সহজেই। এ এক আজব কিসসা!
যস্যস্তু না ভবেদ ভরাতা না বিজ্ঞায়েতা ভা পিতা |
নৃপয়চেতা তান প্রজানাঃ পুত্রিকা’ধর্মসংকায়া ||
শ্লোকখানা যদি চেনা লেগে থাকে, প্রি-ওয়েডিং, পোস্ট ওয়েডিং-এর সাজানো ফ্রেমের ঝাঁ চকচকে মোড়কে চোখ না ধাঁধিয়ে থাকে, তাহলে এর অর্থ নিয়ে ভাবার সময় আগতপ্রায়। মনুস্মৃতি-র এহেন শ্লোকখানায় পরিষ্কার বলা আছে যে, জ্ঞানী ব্যক্তি (এখানে ব্যক্তি অর্থে অবশ্যই পুরুষ!) এমন কন্যাকে কখনওই বিয়ে করবেন না যাঁর ভ্রাতা ও পিতা পরিচিত নয়। বেচারা মনু, ডেটিং অ্যাপের সময়ের মানুষ নন। তবু এই যে সাবধানবাণীখানা তিনি রেখে গিয়েছিলেন তা থেকে সহজেই অনুমেয়, বিয়ে নামক জটিল প্রক্রিয়াতে মেপে-বুঝে পা ফেলাই সমীচীন। তার ওপর কন্যার ব্যাকগ্রাউন্ড যদি তেমন না হয়, তবে সে বিপদে জেনেবুঝে না ঝাঁপ দেওয়াই ভালো! উচিত কথা, সন্দেহ নাস্তি। জেন্ডার বাইনারির যুগে এ নিদান শুধু শিশ্নধারীদের স্বার্থরক্ষা করেছে; এখন যখন মোটামুটি একখানা জায়গায় দাঁড়ানো গিয়েছে, তখন ‘বিয়ে’ নামক ব্যাপারখানা সবদিক ভেবেচিন্তে তবেই ঘটাতে আগ্রহী মানুষ নামের জীবেরা।
এ তো গেল যাঁরা বিবাহে ইচ্ছুক তাঁদের কথা। কিন্তু ধরুন, যাঁরা জেনেবুঝেই এই বিষয়ে জড়াতে চান না– তাঁদের কী হবে? না না, আগেই ভুরু কুঁচকে মনুস্মৃতি-র পাতা উল্টে নিদান ঠাওরাতে বসবেন না। বা গলা কাঁপিয়ে অবিবাহিত-অবিবাহিতাদের সমাজ-বহির্ভূত বলে দেগেও দেবেন না। সেসব নয় রয়েসয়েই হবেখন; আগে ভাবা দরকার, এমনটা কেউ চাইলে তাঁকে ঠিক কোন খাপে বসানো যায়? মিলছে না তো হিসেবখানা? মেলার কথাও নয়।
…………………………………………………………………………………………..
রিলসের যুগে ব্যক্তিগত বলে কিছু না রাখাই ট্রেন্ড। তাই সদ্য-বিবাহিত দম্পতিদের আবেগ থেকে আরম্ভ করে বিবাহ-পরবর্তী বিচ্ছেদের কূটকচালিও আমাদের ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেই থাকে। সম্ভবত পড়ে পাওয়া চার আনার মতো এই সুযোগ আমাদের অধিকার দিয়ে দেয়, যে কারও ব্যক্তিগত জায়গায় নিজের নাসিকা প্রবেশে। তাই তরুণী অভিনেত্রীকে তাঁর কাজ সংক্রান্ত প্রশ্নের বদলে অনায়াসে জিজ্ঞাসা করা চলে– তিনি তাঁর দাম্পত্যজীবন কবে শুরু করতে চলেছেন! অথবা কর্মরত যুবক-যুবতীকে যেচে উপদেশ দেওয়া চলে– সময় থাকতে থাকতে সংসারধর্ম পালন না করলে চরিত্রবিচ্যুতি ঘটা খালি সময়ের অপেক্ষা!
…………………………………………………………………………………………..
যে খাপ ও খোপসমন্বিত জীবনে আমরা সংস্কারের নামে ব্যক্তিস্বাধীনতার কনসেপ্টখানা মোটামুটি হজম করে ফেলেছি, তাতে এমন বেয়াড়া আবদার (?) করলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়াই স্বাভাবিক। প্রথমত, বিয়ে না হলে বংশবৃদ্ধি হবে না। কারণ কে না জানে, বংশের বাড়বাড়ন্ত আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়ত, একা থাকা মানুষজনের জন্য সমাজের গড়নখানাই বদলে যেতে পারে। মানে সংসারী জীবদের মতো তাঁদের আচার-আচরণ হবে না, এ তো জানাই কথা! কেউ যদি নিজের জীবনের হাল নিজের হাতে রাখেন, প্রাণ খুলে বাঁচতে চান, তাহলে এ যুগেও গাত্রদাহ হওয়া অসম্ভব কি? উত্তর, না। কিন্তু যে কথাখানা তলিয়ে ভাবা যেত, বা ভাবাটাই উচিত, সেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো একখানা বেয়াড়া জিনিস মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়। বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া অথবা না-হওয়া যে দিনের শেষে যেকোনও মানুষ-মানুষীর স্বীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছা দ্বারাই নির্ধারিত হওয়া ভদ্র সমাজের নিয়ম, সে কথাখানাই আমরা ভুলে যাচ্ছি না তো?
রিলসের যুগে ব্যক্তিগত বলে কিছু না রাখাই ট্রেন্ড। তাই সদ্য-বিবাহিত দম্পতিদের আবেগ থেকে আরম্ভ করে বিবাহ-পরবর্তী বিচ্ছেদের কূটকচালিও আমাদের ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেই থাকে। সম্ভবত পড়ে পাওয়া চার আনার মতো এই সুযোগ আমাদের অধিকার দিয়ে দেয়, যে কারও ব্যক্তিগত জায়গায় নিজের নাসিকা প্রবেশে। তাই তরুণী অভিনেত্রীকে তাঁর কাজ সংক্রান্ত প্রশ্নের বদলে অনায়াসে জিজ্ঞাসা করা চলে– তিনি তাঁর দাম্পত্যজীবন কবে শুরু করতে চলেছেন! অথবা কর্মরত যুবক-যুবতীকে যেচে উপদেশ দেওয়া চলে– সময় থাকতে থাকতে সংসারধর্ম পালন না করলে চরিত্রবিচ্যুতি ঘটা খালি সময়ের অপেক্ষা! আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, বিবাহের মতো একখানা বিষয় নিয়ে যে আলটপকা এক্তিয়ার বহির্ভূত আলাপ-আলোচনা চলে, এবং বিপরীতের মানুষেরা অস্বস্তি সহকারে তা নির্বিবাদে হজম করেও নেন, তার এক শতাংশও সন্তান-পালন, গার্হস্থ্য হিংসা এসব নিয়ে হয়ে ওঠে না। তখন সেখানে তর্জনী ঠোঁটের ওপর রেখে জ্ঞানী জ্যাঠা সেজে ‘পার্সোনাল ব্যাপার’-এর ঢাল খাড়া করা চলে অতি সহজেই। এ এক আজব কিসসা!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন অনুব্রত চক্রবর্তী-র লেখা: জীবনে বৃষ্টিই শুধু একপশলা নয়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আসলে ভব্যতার দায়ভার নিতে আমাদের বরাবরই বড় আলস্য। খোপে ঢুকিয়ে না নেওয়া অবধি অন্তরের প্রবল অ্যাবিউজার শান্তি পায় না। নচেৎ একটু ভাবলেই বোঝা যাওয়ার কথা যে কারও জীবনের চালিকাশক্তি নেওয়ার কোনও অধিকার বা প্রয়োজন আমাদের আদপেই নেই। ছিলও না কোনওদিন। যুগ বদলেছে, বদলেছে সময় ও জীবনদর্শন। তাল মিলিয়ে বদলেছে সামাজিক বেড়াজালও। খামোকা গায়ে পড়ে উপদেশ দিয়ে অপরের শান্তি নষ্টে ক্ষণিকের যে অর্গাজম পাওয়া গেলেও যেতে পারে, তার বদলে অনেক বেশি আরাম আপন নাসিকা আপনার জীবন অভিমুখে রেখে চলায়।
এটুকু সহিষ্ণুতা শিক্ষা করে নিলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো বা প্রত্যাশার চাপে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা না হয়েই শ্বাস ফেলে দু’দণ্ড বেঁচে থাকার কথা ভাবতে পারে। তাহলে?
বিয়ে কবে করছেন?