কখনও কি খেয়াল করেছ বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে কোনও শেডের তলায় আশ্রয় নেওয়ার সময় তুমি আসলে হাসো। কখনও বৃষ্টির মধ্যে দৌড়নোর সময় কেউ গম্ভীর থাকে না, থাকতে পারে না। বরং রেনকোটের মধ্যে ঘামতে ঘামতে তুমি ভাবো কতক্ষণে রেনকোট খুলবে। কতক্ষণে শরীর একটু জুড়োবে। এই দমবন্ধ, এই হাঁসফাঁসের মধ্যেই তো বেশিটা সময় কাটে তোমার। কাজে বেরনোর সময় বৃষ্টি আসলে বিরক্তিতে ফেটে পড়ো। রেনকোটে ঢেকে, ছাতার তলায় নিজেকে গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়ো। সেই একই বৃষ্টি ছুটির দিনে, আলস্যে, নরম মনে ভালো লাগে, গায়ে চাদর টেনে নিতে ইচ্ছে করে, কারও কাঁধে মাথা রাখাও সহজ মনে হয়।
পৃথিবীর দীর্ঘতম রাতে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম প্রেমের গল্প যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন ঝড় উঠেছিল। ঝড়ের আগমুহূর্তের নৈঃশব্দে ভর করেছিল যে অলৌকিকতা, তার নিশানা আদতে কোনদিকে, বোঝেনি অমলকান্ত। তবুও এই পৃথিবীর প্রতিটি ঝড়ের রাতের মতো সেদিনের এই রাতটিও ছিল সম্ভাবনাময়। ঠিক সময়ে ট্রেন না-আসার মতো রুটিনমাফিক। ট্রেনের অপেক্ষা করার মতো লোকায়ত। একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেশলাই ফুরিয়ে যাওয়ার মতো দৈনন্দিন। তবুও আশা, দূরে লেপমুড়ি দেওয়া চাচার কাছে হয়তো থাকতে পারে দেশলাই, প্রতিদিন যেমন ভাবে হেরে যাওয়া প্রতিটি মানুষ। তবে, ওই যে, রাতটা শুরু হয়েছিল যে সম্ভাবনায়, তা এড়াবে কে? ঝড়ে লেপ উড়ে গেলে, প্রেম আসে। এক কাপ গরম চায়ের চাহিদায় প্রেম শুরু হলে অকস্মাৎ ট্রেন এসে যায়। যে ট্রেনের আসার কথাই ছিল। ট্রেন এসে যায়, প্রেম চলে যায়, দু’কাপ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অমলকান্ত। ট্রেন চলে যাওয়ার দৃশ্যের মাঝে এসে পড়ে আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি, বারিধারাজল। চায়ের কাপে বৃষ্টির ফোটা টপ টপ টপ। বৃষ্টির জল থেকে বাঁচার কথা সেদিন মনে পড়েনি অমলকান্তর। লাল জ্যাকেটটাতেই কোনওরকমে মাথা গোঁজা, দু’হাতে বৃষ্টির জলে টলমল চায়ের কাপ হাতে। পৃথিবীর দীর্ঘতম ঝড়ের রাতে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম প্রেমের গল্প!
প্রস্তুতি ছিল, মাপঝোকে কোনও গন্ডগোল ছিল না, সুরক্ষাপত্র সইসাবুদও করা ছিল আগাম। শখ করে বেছে বেছে রেনকোট কেনা ছিল, দরদাম করে খুশি হয়ে বাড়ি ফেরাও ছিল। মরশুমের প্রথম বৃষ্টিতেই রেনকোটে ঢেকে বৃষ্টিতে মাথা উঁচু করে হেঁটে বেরবে ভেবে খুশিই ছিলে। ভেবেছিলে আর কখনও বৃষ্টি মাথায় নেবে না, ভেবেছিলে এড়িয়ে যাবে, তাকাবে না, চায়ের কাপে বৃষ্টির জল মিশবে না, বরং নিজেকে বাঁচিয়ে জানলা থেকেই দেখে নেবে বৃষ্টির তোড় এ বছর বেশি না কম। আবহাওয়া দপ্তরের প্রতিটি বিজ্ঞপ্তি তুমি খুঁটিয়ে পড়ো, নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করো, নরম হবে না জানো, বর্ষার গন্ধ ভুলে গেছিলে তুমি, শুধু মনে রেখেছিলে বৃষ্টি-শেষের ক্লান্তির কথা, হেরে যাওয়া মলিনতার কথা, জল জমে রাস্তা আটকে যাওয়ার কথা, পা ভিজে যাওয়ার অস্বস্তির কথা। কিন্তু–
‘–সেদিন সে উজ্জ্বয়িনী প্রাসাদ-শিখরে
কিনা জানি ঘনঘটা, বিদ্যুৎ-উৎসব,
উদ্দাম পবন বেগ গুরু গুরু রব
গম্ভীর নির্ঘোষ সেই মেঘ-সংঘর্ষের
জাগায়ে তুলিয়াছিল সহস্র বর্ষের
অন্তর্গূঢ় বাষ্পাকুল বিচ্ছেদ-ক্রন্দন
একদিনে। ছিন্ন করি কালের বন্ধন
সেইদিন ঝরে পড়েছিল অবিরল
চির দিবসের যেন রুদ্ধ অশ্রুজল–’
তাই তোমার আর সেদিন রেনকোট পরা হল না। ছাতা নিতেও ভুলে গেলে। শ্লোক-স্মৃতিতে তুমি জানতে কোথাও কোনও যক্ষ আজও চিরজ্ঞাত সেই সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আসলে তো বিরহী মন তোমার, অমান্য করবে সাধ্য কী? চায়ের কাপে বৃষ্টি পড়ুক, টিনের চালা দিয়ে অবিরাম ধারা নামুক, চশমা ব্যাগে ভরে নাও, সিগারেট ভিজে গেছে যখন ফেলেই দাও এবার। ছাতা নিয়ে যে যাচ্ছে নিজেকে কোনও রকমে বাঁচাতে, তার দিকে তাকাও হাসিমুখে, ইশারায় অন্তত জানাও তার কাঁধ ভিজে গেছে, পিঠের ব্যাগ ভিজছে, জলের স্রোতে পা রাখাই দায়। ইশারা না-বুঝলে চিৎকার করেই বলো। জলে পা রাখো, চুল ভিজে যাক, বৃষ্টির তোড়ে দৃষ্টি ঝাপসা হোক, জামার সঙ্গে শরীর জুড়ে যাক।
এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে, ভ্যাপসা গরমের দেশে এই তো কয়েকটা দিনই মাত্র তোমার আছে গাছের পাতার রং দেখার, পিচ ঢালা রাস্তার পাশে কয়েক ইঞ্চির মাটির নড়েচড়ে বসা দেখার, ভেজা কাকের ডানা ঝাপটানো দেখার, কিশোর-কিশোরীর বৃষ্টিতে ভেজার জেদ। যদি ভাগ্যবান হও, তাহলে আলোকবর্ষের মাঝে হঠাৎ লোডশেডিং, মস্তিষ্কের ভেতর ঝমঝম ঝমঝমে ঘুমিয়ে পড়া। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, আর ভেতরে তুমি ঘুমচ্ছ– এই আহ্লাদ কিছুদিনের, কয়েক মুহূর্তের।
কখনও কি খেয়াল করেছ বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে কোনও শেডের তলায় আশ্রয় নেওয়ার সময় তুমি আসলে হাসো। কখনও বৃষ্টির মধ্যে দৌড়নোর সময় কেউ গম্ভীর থাকে না, থাকতে পারে না। বরং রেনকোটের মধ্যে ঘামতে ঘামতে তুমি ভাবো কতক্ষণে রেনকোট খুলবে। কতক্ষণে শরীর একটু জুড়োবে। এই দমবন্ধ, এই হাঁসফাঁসের মধ্যেই তো বেশিটা সময় কাটে তোমার। কাজে বেরনোর সময় বৃষ্টি আসলে বিরক্তিতে ফেটে পড়ো। রেনকোটে ঢেকে, ছাতার তলায় নিজেকে গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়ো। সেই একই বৃষ্টি ছুটির দিনে, আলস্যে, নরম মনে ভালো লাগে, গায়ে চাদর টেনে নিতে ইচ্ছে করে, কারও কাঁধে মাথা রাখাও সহজ মনে হয়। মনে হয়, বৃষ্টিতে একবার হেঁটে আসলে হয়, একবার দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে আসা যায়, ভেজা মাথা ঝাঁকিয়ে পাখির ভঙ্গিমা ধারণ করা যায়, পাশ দিয়ে জল উড়িয়ে গাড়ি গেলে তেড়ে খিস্তিও করা যায়।
পিচঢালা রাস্তা, উঁচু বাড়ি, তারের পোস্ট, বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং, ল্যাম্পপোস্ট পেরিয়ে আকাশের দিকে তাকানো বড়ই কষ্টের। ইচ্ছে করে না বৃষ্টিতে ভিজতে, বাড়ি গিয়ে স্নান করতে, মাথায় জল বসে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে। কিন্তু আমার শহরে প্রকৃতি বলতে ওইটুকুই, কালবৈশাখীর দৃশ্য ও খানিক বৃষ্টি। ওইটুকুতেই যতটা পারা যায় মাটির গন্ধ খোঁজা, গাছের চাকচিক্য, অতীতের লোডশেডিং-এর আবছা স্মৃতি। এটুকুই যার অবলম্বন, তার কি মানায় অগ্রাহ্য করা? পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম প্রেমও আমাদের কাছে সঞ্জীবনী সুধা। তাই নিজেকে আটকে রাখার দরকার নেই। ছাতা চাই না, রেনকোট চাই না, গামবুট চাই না, বৃষ্টি আসলে তরিবৎ করে বেরতে পারলেই কেল্লা ফতে। সঙ্গে থাক খুচরো পয়সা, ভিজে গেলেও ক্ষতি নেই, পলিথিনে মুড়ে বৃষ্টিতে দোলাতে দোলাতে বাড়ি ফেরা যাক পেঁয়াজি আর আলুর চপ নিয়ে।
তারপর অবশ্যম্ভাবী মনে পড়ে যায় সেই সময়ের কথা, যখন তুমি নিজেকে বাঁচাতে না, বাঁচাতে হবে– এমন কোনও সম্ভাবনা তোমার মধ্যে ছিল না। তখনও তুমি অবাক হতে, রাতের খাবার কিনতে বেরনোর সময় তুমি জানতে যে কালবৈশাখী আসবে। এসেছিল আবহাওয়া দপ্তরের হিসাব মেনেই। সব জানা থাকলেও ঝড় আসার মুহূর্তটার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিলে। দোকানের চালা উড়ছে, গোটা পাড়ায় ধুলোর ঝড়, রুটির দোকান তড়িঘড়ি গোটানোর তোড়জোড় চলছে, চায়ের দোকানের আগুন নিভেছে, রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে এঁটো বাসন, রিকশাওয়ালা প্লাস্টিকে মুড়িয়ে ফেলছে সাধের রিকশাটা, হলুদ ল্যাম্পপোস্টের (তখন শহরে হলুদ আলোই জ্বলত) আলো দুলছে, দোকানের সামান্য ছাদের তলায় সবাই গুটিসুটি হয়ে ঢুকে পড়েছে, দুটো কুকুর সেদিন আত্মহারা (এমনিতে ওরা ভীতু)। তবুও তোমরা দুই বন্ধু রাস্তার মাঝে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গাছেদের প্রকাণ্ড দাপট আর ধুলোর ঝড় দেখছ। একটু একটু ঠান্ডা বাতাসের প্রবেশ হচ্ছে। চোখের সামনে রাস্তা ভরে যাচ্ছে গাছের পাতায় আর রাধাচূড়া ফুলে। তোমরা জানতে তোমরা আড়াল নেবে না, ছাদ নেবে না। ধুলোর ঝড়ে তাকানো দায়, ঝরা ফুল আর ঝরা পাতার ওড়াউড়িতে তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলে আজ রাতের খাবারের চিন্তা থাক।
এই বিস্ময়-দৃশ্যে আর এক চরিত্রের আসা বাকি তখনও। তখনও তোমরা জানো রাতে বৃষ্টি হবে, মেসবাড়িতে দারুণ ঘুম হবে, পাশের পুকুরের জলে রাস্তা ভরে যাবে, তাই একটু ঘুরপথে ঢুকতে হবে। ঠিক সেই সময় গাছের পাতার ঝড়ের মধ্য দিয়ে একটা কালো ঘোড়া ছুটে যায়। সেই দৃশ্যটি সেদিন তত স্পষ্ট হয়নি। বরং আজ জানো সেদিন কালো ঘোড়াটি নিশ্চিত ছুটে গেছিল। আর তোমরাও জেনেছিলে সারা রাত শহরে হাঁটবে, শ্মশানযাত্রীদের সঙ্গ নেবে, হেঁটে চিনে নেবে ট্রামরাস্তার নকশা, শহর থেকে ততক্ষণে উড়ে গেছে বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং, তোমরা চায়ের দোকান খুঁজে পেয়েছিলে সেদিনও, সঙ্গে বেকারির বিস্কুট আর ডিমসেদ্ধ। কত লোকের সঙ্গে সেদিন তোমাদের পরিচয় হয়েছিল, যারা কোনও দিন ডেকে কথা বলবে না ভেবেছিলে, সেদিন তারা কথা বলেছিল। রাতশেষে যে পাড়া দিয়ে ফিরতে একটু ভয় ভয় করছিল, সেই পাড়া থেকেই সেদিন ভেসে আসছিল এক কণ্ঠ– ‘এসো নীপবনে, ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে।’
পৃথিবীর দীর্ঘতম বৃষ্টির রাতে, পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম প্রেমের আকুতি।
নানা অনুদান বা সুযোগ-সুবিধের পরেও শহর-গ্রাম-মফস্সলের বড় অংশে সরকার-পোষিত স্কুলগুলোতে ভর্তির হার অত্যন্ত কম। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকাতেও গজিয়ে উঠছে বেসরকারি স্কুল। সেখানে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত বিষয়-শিক্ষক আদৌ আছেন কি না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছেন না, দৌড়চ্ছেন ছেলেমেয়ে ভর্তি করতে। হু হু করে বাড়ছে পড়ুয়া সংখ্যা, অনেকসময় সাধ্যের অতিরিক্ত ব্যয়েও। কেন এই প্রবণতা?
যাঁরা আধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচাতে চেয়েছিল, বেশিদিন বাঁচতে পারেননি নিজেরা। ‘স্বামী’ ও ‘সংসার’ নামক বিষাক্ত গহ্বর তাঁদের টেনে নিয়েছিল। এই লেখা ফরোগ ফরোখজাদ ও সিলভিলা প্লাথকে নিয়ে। তাঁদের চেতনার রং ধারণ করে জ্বলেছে আলো– পুবে-পশ্চিমে। আমরা চোখ মেলেছি আকাশে– আমরা শুনছি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই দুই নক্ষত্রের সংলাপ।