পুথি থেকে, শোনা কথার জগৎ থেকে যখন ছাপা বইয়ের জগতে আমরা ঢুকে পড়েছিলাম তখন অনেকে ভাবছিলেন বইয়ের ভবিষ্যৎ নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো মানুষ ভাবছিলেন আগে একজন কথক কত বেশি শ্রোতার কাছে তার কথা পৌঁছে দিত, সে-তুলনায় বই আর সাময়িক পত্রের পাঠক তো কিছুই না। বইকে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয় তাহলে পাঠক লাগবে, অনেক পাঠক। তিনি অনেক পাঠক যাতে বই পড়ে সে চেষ্টা করেছিলেন। এখন তোদের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে বইকে যদি ভবিষ্যতে বাঁচাতে হয়, তাহলে কায়াহীন বই পড়ার অভ্যেস দ্বিগুণ-তিনগুণ করতে হবে। প্রয়োজনে কায়াহীন বইকে কানবই করে তুলতে হবে।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
বইমেলা চলছে। নিত্যানন্দ নিয়মিত বইমেলা যাচ্ছেন। বই বলে কথা! যতই রকিদের সঙ্গে ওঠা-বসা করুন, ভদ্রলোকের গুণাবলি পরিত্যাগ করতে তিনি নারাজ। বই কেনা ও বই পড়া ভদ্রলোকত্ব যাপনের অন্যতম উপায়। আজ তবু একবার বইমেলা না গিয়ে রকিবৃন্দের খোঁজ নেওয়ার জন্য রকমুখো হলেন।
কয়েকদিনের অনুপস্থিতির পর নেতাইকে আসতে দেখে রকিপঞ্চক রে রে করে এগিয়ে এল। তাদের অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে। একটু আধটু নেতাই-কথা শুনতে হয় বটে, তবে তারপর তেলেভাজায় সব উসুল হয়ে যায়। এ ক’-দিন নো-লার্নিং নো-তেলেভাজা দশা চলছিল। নেতাই আসছে মানে খরা কাটবে, কড়ার তেলে সাঁতার কাটা মালগুলি মুখের কাছে আসবে। রকি নম্বর ওয়ান বলে উঠল, ‘নেতাই তুমি খারাপ লোক।/ তোমার মাথায় উকুন হোক।।/ আমাদের দাবি মানতে হবে।/ তেলেভাজা খাওয়াতে হবে।।/ যে না খাওয়ায় তেলেভাজা।/ তার বংশ হবে বাঁজা।।’
নিত্যানন্দ বুঝতে পারলেন রকি-ওয়ান দু’-তিনটে লোক প্রচলিত মৌখিক ছড়া এদিক-ওদিক না-করে ও করে এই সংলাপটি পেশ করেছে। তিনি লোকায়ত কবিত্বে খুশিই হলেন। বললেন, ‘কী আর করি! বইমেলা চলছে। তাই রকে অ্যাবসেন্ট। তোমরা জেনে রাখো বই পড়তে হয়। নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়।’
রকি-টু বলল, ‘মাইরি নেত। এ তোমাদের বড়লোকদের বাতেলাবাজি। বই কিনতে পয়সা লাগে, বই রাখতে জায়গা লাগে। বই ব্যাপারটা একটু বড়লোকি ব্যাপার। তার চেয়ে এই যে এই ফোন হয়েছে না এতেই তো কত কিছু হয়। সেদিন শ্যালদা থেকে মেট্রো চেপে সল্টলেকে যাচ্ছিলাম, দেখলাম ফোনে কী সব পড়ছে। বই রাখার জায়গা বাঁচছে। আর নেতাই তুমি তো জানো, আমাদের সবারই একটা করে দামি-না-হোক মাঝারি দামি ফোন আছে। তোমার উচিত ছিল বইমেলার সময় আমাদের ফোনে পড়ার বই দেওয়া। তাই না করে নিজের স্বার্থে বড়লোকের বাচ্চা, তুমি বইমেলা চলে গেলে! এ মজাকি চলবে না।’ রকি-থ্রি, ফোর অ্যান্ড ফাইভ টুইক-টুইক করে সিটি দিয়ে রকি-টুকে সাপোর্ট করল।
নিত্যানন্দের কথাটা খুব পছন্দ হল না। বইয়ের স্পর্শ-গন্ধ তাঁর শরীরের অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তবু হঠাৎ মনে হল, নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বাইরে আসা যাক। রকিরা যা বলছে তা মেনে নিয়ে যুক্তি সাজানো যাক। বই কিনতে পয়সা লাগে, বই রাখতেও। বইয়ের ব্যক্তিগত মালিকানা বড়লোকি, কিন্তু বইয়ের লাইব্রেরি-মালিকানা তো বড়লোকি নয়। আগে তো পাড়ায়-পাড়ায় লাইব্রেরি ছিল। লোকে লাইব্রেরি থেকে বই ধার নিয়ে পড়ত। লাইব্রেরিতে বসে বিনিপয়সায় বই পড়ার ব্যবস্থাও করা হত। এ তো বড়লোকি নয়। সে-ব্যবস্থাটা অবশ্য উঠে গেছে প্রায়– পাঠাগার সংস্কৃতি গিয়েছে, ক্লাব সংস্কৃতি এসেছে। এখনও কোথাও কোথাও টিমটিম করে লাইব্রেরি বেঁচে আছে। লাইব্রেরি আর নানা রকম বই অবশ্য দেয় না, রাখেও না। কম্পিটিটিভ এক্জামের প্রস্তুতি জন্য বই রাখে! গল্পখোর আম-পাবলিক সিরিয়াল দেখে, একটু জাতের পাবলিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নানা রকম গল্প গেলে।
এসব ভাবতে গিয়ে নিত্যানন্দবাবু বাক্যিহারা। নেতাই চুপ করে আছে দেখে রকি-টু বলে উঠল, ‘মাইরি নেত তুই কেমন বইমেলা গিয়ে গিয়ে ভেবলে গেছিস। আগে তো এমনি বাক্যিহারা দশা তোর মোরা দেখি নাই।’ রকি-ওয়ান নিত্যানন্দের গালে চকাস-চকাস করে চুমু খেয়ে বলল, ‘ওরে নেত তুই ভাবিস নেরে/ কথা বল কথা বল।’
নিত্যানন্দবাবু এই তুই-তোকারির চক্করে আবার সরব হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘কোন খেলাটা খেলব কখন ভাবছি বসে সেই কথাটাই। তোদের কথা একদিক দিয়ে ঠিক। বই একপ্রকার বড়লোকি। তবে সেই বড়লোকিটুকু নিজের মতো করে কেউ যদি বজায় রাখে, তাতে তোদের কী?’
রকি-টু বলল, ‘আমাদের কিছু নয়। তবে বইয়ের চক্করে তুই আমাদের এখানে না-এলে, আমাদের চপ না খাওয়ালে আমাদের তো কিছু যাবে আসবেই।’
………………………………
নিত্যানন্দবাবু আবার চিন্তায় ডুবে গেলেন। বই শুধু বই। তাঁর ঘরে করে থৈ-থৈ। তিনি কি কায়াময় বইয়ের অভ্যেস আনলার্ন করতে কোনও দিন পারবেন! তিনি পারুন, আর না পারুন– সকলের চোখের সামনে নেমে আসুক অশরীরী বই, সকলের শ্রুতিতে বাজুক কানবই। সেটা হলে বেশ হয়। বই বড়লোকি কমে। একথা ঠিক ই-বই, কানবই কিনতে হবে। তবে একসময় সে হবে বেশ কমদামি।
………………………………
‘বুঝলাম। চপের দোকানে হাঁক দিচ্ছি। তবে তোদের একটা কথা আমার চোখ খুলে দিচ্ছে। ওই যে তোরা ফোনে পড়ার বই চাইলি তার থেকেই কথাটা মাথায় এল। বই না থাকলেও বই থাকবে। যেমন পুথি থেকে, শোনা কথার জগৎ থেকে যখন ছাপা বইয়ের জগতে আমরা ঢুকে পড়েছিলাম তখন অনেকে ভাবছিলেন বইয়ের ভবিষ্যৎ নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো মানুষ ভাবছিলেন আগে একজন কথক কত বেশি শ্রোতার কাছে তার কথা পৌঁছে দিত, সে-তুলনায় বই আর সাময়িক পত্রের পাঠক তো কিছুই না। বইকে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয় তাহলে পাঠক লাগবে, অনেক পাঠক। তিনি অনেক পাঠক যাতে বই পড়ে সে চেষ্টা করেছিলেন। এখন তোদের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে বইকে যদি ভবিষ্যতে বাঁচাতে হয়, তাহলে কায়াহীন বই পড়ার অভ্যেস দ্বিগুণ-তিনগুণ করতে হবে। প্রয়োজনে কায়াহীন বইকে কানবই করে তুলতে হবে। তোদের ফোনে অশরীরী বই আর কানবই ঢুকিয়ে দিতে হবে। কানে শোনার বই মানে কানবই তোরা না পড়ে শুনে জানবি। তাই বা কী খারাপ? খারাপ নয় ভালোই।’
রকি-ওয়ান বলল, ‘নেতাই ডার্লিং, বুঝলাম কিন্তু বুঝলাম না। একটু সহজ করে দিতে হবে।’
নিত্যানন্দবাবু বললেন, ‘বইয়ের অভ্যেস বদলে গেলে হাহাকার করার কিছু নেই। দূর ভবিষ্যতে ছাপা-বই বিষয়টি হয়তো থাকবে কিন্তু এভাবে থাকবে না। বইয়ের শরীর থাকবে না। বইয়ের শরীর বই দেখার যন্ত্রে মালুম হবে। তোরাও বই না পড়ে শরীর ছাড়া বই ফোনে পড়বি কিম্বা বই শুনবি। ভালো সরকার বই শোনার ও বই দেখার যন্ত্র-ব্যবস্থা পোক্ত করে সর্বসাধারণের মনের জানলা খুলে দেবে। বইমেলা আর হবেই না। প্রকাশনা ব্যবস্থার চরিত্র বদলাবে। কলেজ স্ট্রিটের গা-গতর হালকা হবে। বেশ ফুরফুরে লাগবে। ঠেলায় ঠেলায় বই যাবে না। বই স্পর্শের ইন্দ্রিয় সুখ বই দেখার ইন্দ্রিয় সুখ হয়ে উঠবে।’
রকি-দুনিয়া বলে উঠল, ‘নেতাই ডার্লিং, তোর সব কথা বুঝিনি। তবে একটা কথা বুঝেছি। এভাবে বইমেলা হবে না। তার মানে তুই আমাদের ছেড়ে বইমেলাতে যাবি না। আমাদের চপের হিস্যা আমরা পাবো।’
নিত্যানন্দবাবু আবার চিন্তায় ডুবে গেলেন। বই শুধু বই। তাঁর ঘরে করে থৈ-থৈ। তিনি কি কায়াময় বইয়ের অভ্যেস আনলার্ন করতে কোনও দিন পারবেন! তিনি পারুন, আর না পারুন– সকলের চোখের সামনে নেমে আসুক অশরীরী বই, সকলের শ্রুতিতে বাজুক কানবই। সেটা হলে বেশ হয়। বই বড়লোকি কমে। একথা ঠিক ই-বই, কানবই কিনতে হবে। তবে একসময় সে হবে বেশ কমদামি।
তাঁর চিন্তা রকিরা ভেঙে দিল। বইমেলা আর এমন করে হবে না, তিনিও চপ-খাওয়ানো ভুলে বইমেলা যাবেন না, এই মর্মে তারা দলবেঁধে স্লোগান দিচ্ছে, ‘বইমেলা তুমি খারাপ লোক/ তোমার মাথায় উইপোকা হোক/ বইমেলা ভ্যাক ভ্যাক/ নেতাই মোদের চপে থাক।’
নিত্যানন্দবাবু দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। এই স্লোগান তিনি সমর্থন করেন না। তিনি ফোন কানে দিয়ে দূরবর্তী চপওয়ালাকে বললেন, ছ’টা ডিমের ডেভিল আর ছ’টা চিকেন চপ।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………
আমরা ঘিরে আছি শোকতপ্ত অশ্রুসজল স্ট্যাচুর মতো, প্রতুলদা এসে গান ধরলেন ‘জন্মিলে মরিতে হবে রে, জানে তো সবাই, তবু মরণে মরণে অনেক ফারাক আছে ভাই। সব মরণ নয় সমান।’ সব কনভেনশন ভেঙে তিনি গাইছেন আর বাবাকে ঘিরে নাচছেন। খুব বিস্মিত হয়েছিলাম।