ভারতীয় সেনা চিরকাল থেকেছে নিরপেক্ষ। রাজনৈতিক মঞ্চে যতই পট পরিবর্তন হোক না কেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যতই উথালপাথাল হোক, সেনাবাহিনী নিজ কর্তব্যে অবিচল ছিল। কখনও কোনও নেতা বা নেত্রীর ধামাধরা হয়নি। পাকিস্তান বা চিনের সঙ্গে যুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ, অনেকটাই ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেখানে দেশ ছিল আক্রান্ত। দেশের অখণ্ডতা রক্ষায়, বহিঃশত্রুকে ঠেকাতে নির্বাচিত সরকার যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঠিক সেভাবেই সক্রিয়তা দেখিয়েছে সেনাবাহিনী।
সময়টা আটের দশক। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী জনপ্রিয় সৈনিক, বীরচক্রে সম্মানিত আয়ুব খানকে রাজস্থানের ঝুনঝুনু থেকে প্রার্থী করেছিলেন। তিনি দু’দফায় সাংসদ হয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে ভারতীয় বায়ুসেনার স্কোয়াড্রন লিডার রাজেশ পাইলট চাকরি ছেড়ে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৫-র যুদ্ধে অংশ নেওয়া স্কুলের বন্ধু ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংকেও রাজনীতিতে টেনে এনেছিলেন রাজীব।
সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে!
সদ্য বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধান আর. কে. এস. ভাদুরিয়া। কারণ, দেশসেবার আরও একটা সুযোগ চান তিনি। বর্তমানের জনপ্রিয় সমাজকর্মী তথা রাজনীতিবিদ আন্না হাজারেও ১৯৬৫-র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে তিনি কোনও নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে যুক্ত হননি। অলিম্পিকে পদকজয়ী শুটার কর্নেল রাজ্যবর্ধন সিং রাঠোর সেনা থেকে আগাম অবসর নিয়ে রাজনীতির ময়দানে পা রাখেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হন। কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করা বিজেপির প্রবীণ নেতা ভুবন চন্দ্র খাণ্ডুরি ছিলেন মেজর জেনারেল। ’৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধে ছিলেন রেজিমেন্ট কমান্ডার, আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তিনি। ইস্টার্ন কমান্ডের প্রাক্তন চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব ফরজ রাফায়েল জ্যাকবও অবসরের পর বিজেপিতে যোগ দেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার প্রাক্তন বিদেশ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী যশবন্ত সিংও ছিলেন প্রাক্তন সেনা অফিসার। কানপুরের বর্তমান মেয়র, বিজেপির প্রাক্তন লোকসভা সদস্য জগৎবীর সিং দ্রোণ ছিলেন সেনার ক্যাপ্টেন। বিজেপিতে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিং। দেশের প্রতিটি মানুষের যে কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার, রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ‘সতর্ক’ ও ‘সংবেদনশীল’ হওয়া দরকার। কর্মরত অবস্থায় তাঁদের কাজে, সিদ্ধান্তে পক্ষপাতিত্ব ছিল কি? সংশয় তৈরি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
স্বাধীনতার পর প্রথম থেকেই অরাজনৈতিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। এবং সেই সিদ্ধান্ত যে কতটা যথাযথ, বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের দিকে তাকালেই তা মালুম হয়। পাকিস্তানে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক শীর্ষ নেতার ফাঁসি, নির্বাচিত সরকারের উৎখাত, সবই চলে দেশের সেনাবাহিনীর অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে। প্রতিবেশী বাংলাদেশও সেনা মদতে অস্থিরতার সাক্ষী। অভ্যুত্থান তো বটেই, সপরিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক খুনের নেপথ্যেও ছিল সেনাবাহিনী। আবার মায়ানমারেও নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে সামরিক জুন্টা প্রশাসন। নোবেলজয়ী নেত্রী আং সান সু চি দীর্ঘদিন ধরেই গৃহবন্দি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
স্বাধীনতার পর প্রথম থেকেই অরাজনৈতিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। এবং সেই সিদ্ধান্ত যে কতটা যথাযথ, বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের দিকে তাকালেই তা মালুম হয়। পাকিস্তানে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক শীর্ষ নেতার ফাঁসি, নির্বাচিত সরকারের উৎখাত, সবই চলে দেশের সেনাবাহিনীর অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে। প্রতিবেশী বাংলাদেশও সেনা মদতে অস্থিরতার সাক্ষী। অভ্যুত্থান তো বটেই, সপরিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক খুনের নেপথ্যেও ছিল সেনাবাহিনী।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পক্ষান্তরে ভারতীয় সেনা চিরকাল থেকেছে নিরপেক্ষ। রাজনৈতিক মঞ্চে যতই পট পরিবর্তন হোক না কেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যতই উথালপাথাল হোক, সেনাবাহিনী নিজ কর্তব্যে অবিচল ছিল। কখনও কোনও নেতা বা নেত্রীর ধামাধরা হয়নি। পাকিস্তান বা চিনের সঙ্গে যুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ, অনেকটাই ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেখানে দেশ ছিল আক্রান্ত। দেশের অখণ্ডতা রক্ষায়, বহিঃশত্রুকে ঠেকাতে নির্বাচিত সরকার যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঠিক সেভাবেই সক্রিয়তা দেখিয়েছে সেনাবাহিনী। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সাফল্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছিলেন। তাঁকে ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ বলেও অনেকে অভিহিত করেছেন। কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভ কিন্তু ছিল পুরোটাই ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেক শ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা প্রমুখ অধিনায়কের নেতৃত্বে গোটা বাহিনীর সাফল্য। কোনও রাজনৈতিক নেতা সেই সাফল্য ‘হাইজ্যাক’ করতে যাননি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: যিনি ভয়ে প্রাণত্যাগ করলেন নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কায়, তাঁর মৃত্যু একপ্রকার শাহাদত
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিন্তু বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হোক বা গালওয়ানে চিনা বাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনার অসম সাহসিকতা, সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রের নির্বাচিত সরকার বা শাসক দলের তৎপরতা যেন অন্য বার্তা দিচ্ছে। সেনার সাফল্যের সঙ্গে সরাসরি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের কীসের সম্পর্ক? জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে ভোট রাজনীতির অঙ্কে বাজিমাত করার চেষ্টা কমবেশি হয়তো সব দলই করে। তা বলে সরাসরি সেনাবাহিনীর পিঠে সওয়ার হওয়া বা তাদের রাজনীতির ময়দানে টেনে আনার চেষ্টা কিন্তু বিপজ্জনক হতে পারে।
উদ্বেগের আরও কারণ রয়েছে। যেমন ২৬ মার্চ কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহে নয়া ফৌজদারি দণ্ডবিধি ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। আমন্ত্রণপত্র বিলি হয়েছিল শ্রীনগরের সদর দপ্তর ৩১ সাব এরিয়ার জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) পিবিএস লাম্বার তরফে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। এই বিষয়ের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কী সম্পর্ক? এই বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তারা তৎপর কেন, সে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এবং উঠেছেও। তারপরই আদর্শ নির্বাচনবিধি চালুর অজুহাতে আলোচনা সভা বাতিল করা হয়।
সেনার চিরাচরিত পোশাক আমাদের মনে চিরস্থায়ী মর্যাদার আসন নিয়েছে। বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের, তাঁদের আত্মত্যাগকে দেশের মানুষ শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু দেশসেবায় যুক্ত থাকা অবস্থায় তাঁদের কারও মনে যদি গেরুয়া-সবুজ-লাল বা অন্য রংয়ের ছোপ ধরে যায়, এবং তা তাঁদের কর্তব্যে প্রভাব ফেলে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না।