এক পাশে মন্দির আর একপাশে মসজিদের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে রাজা প্রজাদের উদ্দেশে বললেন– সব কিছু পেরিয়ে, সকলের ওপরে আমাদের পরিচয় আমরা মাইসোরিয়ান। ১৯১৩ সালে মাইসোরের প্রত্যেকটা মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক করা হল প্রাথমিক শিক্ষা। আর তার ঠিক দু’বছর পর, ১৯১৫ সালে, তাঁর রাজত্বের অধীন সমস্ত ইস্কুলে দলিত বাচ্চাদের পড়াশুনো করার সুযোগ করে দিলেন! সেই দলিত, এই দু’দিন আগে যাদের চেয়ারে বসার, ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার, মায় শেষযাত্রায় শবদেহ নিয়ে যাওয়ার ‘অপরাধে’ হেনস্তা, মারধোর কিছুই বাদ যায়নি।
মাইসোর পাকের (Mysore Pak) নাম থেকে ‘পাক’ শব্দটা সরিয়ে তার জায়গায় ‘শ্রী’ বসানো হয়েছে অনেক মিষ্টির দোকানে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সামান্যতমও যোগাযোগ আছে এমন কোনও কিছু বরদাস্ত করা হবে না! এই হল মোদ্দা কথা। দু’-লাইনের খবর।
তা এ ধরনের প্রতিটি খবর বাজারে এলে যা যা হওয়া সম্ভব, ঠিক তাই তাই হয়েছে। একদল বলেছে, বেশ হয়েছে। আরেক দল বলেছে, বেশ হয়েছে দারুণ কনটেন্ট, হেবি মজা হবে। মজা হয়েওছে। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত শব্দভাণ্ডার উজাড় করে, ‘পাক’ অক্ষরযুগল জুড়ে আছে এমন সমস্ত রত্ন খুঁজে বের করে তার জায়গায় ‘শ্রী’ বসানোর খেলা। কেউ লিখেছেন– উকুলেলে পাকড়ে হাল্লা রাজার সেনা না গাইলে যথেষ্ট পেছনশ্রী হওয়া যায় না।
দু’-চারজন আবার প্রশ্ন করেছে, পাকিস্তান কি নিজেরাই নিজেদের নিয়ে যথেষ্ট মজা করে ফেলেনি? ভারতীয় সেনা পাকিস্তানের পাঠানো সমস্ত ড্রোন ধূলিসাৎ করেছে, পাকিস্তনের ভেতরে ঢুকে সমস্ত জঙ্গীঘাঁটি দুরমুশ করে এসেছে আর সেটার উত্তরে পাকিস্তান নিজের দেশে বিজয়-মিছিল বের করেছে আর ফেক নিউজ ছড়িয়েছে! একটা দেশ যে এভাবে গোটা পৃথিবীর সামনে নিজেই সং সেজে বসে আছে, সে মরার পর আবার মিষ্টির ঘা মারার খুব দরকার ছিল কি? আর যুদ্ধ না-হয় ছেড়েই দিলাম, একটাতেও কোনও দিন জেতেনি, কিন্তু ক্রিকেট? নিজের শর্ত অনুযায়ী আয়োজক দেশের মাটিতে একটাও ম্যাচ না খেলে ওদের কাছ থেকে ট্রফি জিতে ডাঁটের মাথায় চলে এসেছে। এ অপমান কি সহজে ভোলার! তা ছাড়া ‘পাক’ মানে তো রান্না! পাকশাল যেমন। ও মিষ্টি পাক দিয়ে দিয়ে তৈরি হয় বলে অমন নাম। তবে এই প্রশ্ন দু’-চার জনই করেছে বলে সেটা বিশেষ পাত্তা পায়নি। উলটে একটা জলভরা ‘কড়াশ্রী’ সন্দেশ দিন তো– ব্যাপারটার কাটতি বেশ ভালোর দিকেই। ভেবেই খারাপ লাগছে যে, মহারাজ কৃষ্ণরাজা উদেয়ার ও তার খাস খানসামা কাকসুরা মাডাপ্পার এই সমস্ত কথা জানা হল না!
১৯০২ থেকে ১৯৪০ মহারাজ কৃষ্ণরাজার মাইসোরে রাজত্ব করেছেন। বলা হয় মাইসোরের স্বর্ণযুগ। কৃষ্ণরাজা ছিলেন খাদ্যরসিক। এহেন মহারাজের রসনাতৃপ্তির কাজে সদা তৎপর মাডাপ্পা। এভাবেই নিত্যনতুন খাবার তৈরি করতে গিয়ে একদিন জন্ম হল মাইসোর পাকের, যা অচিরেই হয়ে উঠল ভারতবর্ষ নামটার সঙ্গে জুড়ে থাকা সমস্ত খাবারের মধ্যে একটি। তবে মহারাজের রুচি কেবল খাবারদাবারেই সীমাবদ্ধ ছিল না। খুবই আশ্চর্যভাবে মহারাজ তার প্রজাদের উন্নতিসাধন নিয়েও ভাবনাচিন্তা করতেন! স্ট্রেঞ্জ না! আরে আপনি মহারাজ! কোথায় আপনি রক্ত গরম করা বক্তৃতা দেবেন, বিরাট উঁচু আখাম্বা সৌধফৌধ বানাবেন, তবে না লোকে আপনাকে মনে রাখবে! যে ছিল সে বটে এক জাঁদরেল রাজা!
কোনও দিন কারওর কোনও প্রশ্নের উত্তর দেননি! ঠিক সেটাই করেছেন যেটা নিজের ঠিক মনে হয়েছে। তবে না আপনার নামে প্রবাদ ঘুরে বেড়াবে রাস্তায় রাস্তায়, যে রাজাবাবুর হাতের গুলি, চওড়া ছাতি দেখেই আর কেউ মাইসোরের আশপাশে আসবার সাহস পেত না। তবে না রাজা! তবে না রাজার বংশ! তবে না বাহুবলি! একটা করার মতো কিছু করা। মহারাজ কৃষ্ণরাজা কী করলেন? বাতি জ্বালালেন। ১৯০৫ সালে যখন আইনস্টাইন বিজ্ঞানজগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন, সেই একই বছরের আগস্ট মাসে বেঙ্গালুরু শহরের রাস্তায় আলো জ্বলে উঠল। সমগ্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথমবার। মহারাজ কৃষ্ণরাজার দৌলতে। অবশ্য এই ঘটনাটিকে বলা যেতে পারে সবে শুরু।
মহারাজ কৃষ্ণরাজা উদেয়ার ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু।
নিজের ধর্মের প্রতি তাঁর আস্থা ও বিশ্বাস এতটা বেশি ছিল বলেই বোধহয় ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টা তাঁর রাজত্বকালে শুধু একটা কথার কথা হয়ে থেকে যায়নি। বদলে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যেগুলো আজকাল আর সিনেমাতেও দেখতে পাওয়া যায় না। যেমন, বাংলা-সহ ভারতে শুরু হয়েছে অগ্নিযুগ। ব্রিটিশরা ক্রমাগত বুঝতে পারছে শেষের সে ‘সিন’ আসন্ন। এমতাবস্থায় যে কোনও শাসক যা করে ব্রিটিশরাও সেটাই শুরু করল। দেশের সমস্ত মানুষের ভেতর জাতপাত, ধর্ম ইত্যাদির নামে ভেদাভেদের বীজ বুনতে শুরু করল। আর ব্রিটিশরা সাধারণত টেকসই জিনিসই বানায়। সেটা হাওড়া ব্রিজই হোক, অথবা আজও চর্তুদিকে ভেদাভেদের গাছগুলোর মাথাচাড়া দেওয়াই হোক। তবে যে মানুষগুলোর জন্যে ব্রিটিশদের পদর্যুস্ত করে আজ আমরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন দেশের নাগরিক বলে পরিচয় দিতে পারি– তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কৃষ্ণরাজা উদেয়ার।
সন ১৯২২, এক পাশে মন্দির আর একপাশে মসজিদের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে প্রজাদের উদ্দেশে বললেন– সব কিছু পেরিয়ে, সকলের ওপরে আমাদের পরিচয় আমরা মাইসোরিয়ান। হ্যাঁ, আজকের দিনে শুনতে অদ্ভুত লাগলেও ১৯১৩ সালে মাইসোরের প্রত্যেকটা মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে প্রাথমিক শিক্ষা। কী ‘অত্যাচারী’ রাজা খালি একবার ভাবুন তো দিকি! পড়াশুনো নাকি করতেই হবে! আর এর ঠিক দু’বছর পর, ১৯১৫ সালে মহারাজ যা করলেন ও জিনিস ‘রাজরাজড়ার খেয়াল’ না হলে করা যায় না। তাঁর রাজত্বের অধীন সমস্ত ইশকুলে দলিত বাচ্চাদের পড়াশুনো করার সুযোগ করে দিলেন! সেই দলিত, এই দু’দিন আগে যাদের চেয়ারে বসার, ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার, মায় শেষযাত্রায় শবদেহ নিয়ে যাওয়ার ‘অপরাধে’ হেনস্তা, মারধর কিছুই বাদ যায়নি। মাত্র দু’দিন আগে! মহারাজ বললেন, তাদের বাচ্চারাও উচ্চবর্ণের লোকেদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়ালেখা পড়বে। উচ্চবর্ণরা তো রাজদ্রোহিতা করে না। তাই তারা নিজের বাচ্চাদের ইশকুল থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করল। দলিতদের পাশে বসলে যদি এই ছোট বয়সেই জাত চলে যায় তখন? কিন্তু মহারাজ কৃষ্ণরাজা নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়লেন না। কখনও নড়েননি। হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে সকলের উন্নতিসাধন করে গেছেন শুধু। সর্বধর্ম নির্বিশেষে যোগ্যদের রাজকীয় পদমর্যাদা দিয়েছেন।
স্বয়ং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী মহারাজকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘রাজর্ষি’, যে শব্দের মানে সন্ত রাজা।
তাই পাকিস্তানের মতো একটা সবরকমভাবে শেষ হয়ে যাওয়া, জঙ্গি-মদতকারি দেশের প্রতি রাগ দেখাতে গিয়ে আমরা যেন মহারাজ কৃষ্ণরাজা উদেয়ারের স্মৃতি বিজড়িত কোনও কিছুকে অসম্মান না করে ফেলি। ভারতীয় হিসেবে এটুকুই যা চাওয়ার।
প্রেম তো ফুরনোর নয়, এদিকে প্রেমিকাকে দেওয়ার মতো কোটেশন ফুরিয়ে যাচ্ছে, কেলেঙ্কারি ব্যাপারস্যাপার! তা ছাড়া ‘চন্দ্রবিন্দু’র নতুন গানে রাত গভীর হচ্ছে, তা যে কীরকম দেখতে, নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়ার এই সুযোগ, আমার অজান্তে কেউ আমার মোজার মধ্যে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল বোধহয়।