ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুলে দুপুরের খাওয়ার এই প্রকল্পের যদিও গেরামভারী নাম আছে: ‘প্রধানমন্ত্রী পোষণ শক্তি নির্মাণ’ বা পিএম পোষণ। যা লোকমুখে মিড-ডে মিল। বিগত দুই বছরের তুলনায় এ বছর মিড-ডে-মিল প্রকল্পে বরাদ্দ কমেছে ২১৩.৫ কোটি। এত কম টাকায় পোষণ হবে কী করে? ২০২২ সালের ১ অক্টোবর থেকে মিড-ডে-মিলে পড়ুয়া পিছু বরাদ্দ ছিল প্রাথমিকে ৫.৪৫ টাকা এবং উচ্চপ্রাথমিকে ৮.১৭ টাকা। বাজারে মূল্যবৃদ্ধির যে আগুন লেগেছে তাতে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের হাতেই ছেঁকা লাগার জোগাড়, সেখানে বরাদ্দের এই সামান্য টাকায় ছেলেমেয়েদের মুখে পুষ্টিকর খাবার তুলে দেওয়া অসম্ভব!
শীর্ণ ক্ষয়িষ্ণু চেহারাটা দেখে বোঝার উপায় নেই মেয়েটি এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। কালো চামড়ায় ঔজ্জ্বল্য নেই; কালো চুল বরং লালচে, শুষ্ক হয়ে জানান দিচ্ছে অপুষ্টির। গ্রাম দিয়ে ঘেরা মফসলসের উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দি। বাঁধানো গাছতলায় বসে মেয়েটিকে দেখছিলাম। বালিকা বিদ্যালয়। দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে ট্যাপ খুলে মুখ ধুয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখে চোখ পড়ল। ইশারায় কাছে ডাকলাম। অপ্রতিভ ‘দশমী’ একটু ইতস্তত করলেও আমার কথার আন্তরিকতাতেই হয়তো কিছুটা স্বাভাবিক হল সে। ‘তুমি ক্লাস টেনের ছাত্রী, তোমাদের জন্য তো মিড-ডে-মিল বরাদ্দ নয়। তুমি খেলে কেন?’ এমন প্রশ্নে একটু অস্বস্তি হলেও মেয়েটির উত্তর, সে ক্লাস ফাইভ থেকেই নিয়মিত খায় এখানে। নাইনে ওঠার পরেও দিদিমণিরা অনুমতি দিয়েছেন। সে একা নয়, আরও অনেকেই তার সঙ্গে খায়। বাবা কি করেন? ‘ভ্যান চালায়, আর মা লোকের বাড়িতে বাসন মাজে।’ অন্য বান্ধবীদের বাবা-মা কি করেন? উত্তরে জানা গেল তারাও হত দরিদ্র পরিবারের সন্তান, একজনের বাবা আবার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে, অন্য কোথাও সংসার পেতেছে। একটি মুসলমান মেয়ের আব্বার পা ট্রেনে কাটা পড়ার পর তিনি ঘরেই বসে থাকেন, পঙ্গু-জীবন। তার মা ঠোঙা বানায়, দিদি সেলাই করে নাইটি।
এই মেয়েগুলো স্কুলে আসে একবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারবে বলে। ভাতের জন্য প্রয়োজনীয় চাল পাঠায় সরকার। বাকি যা কিছু কেনাকাটা স্কুলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। ডাল, আলুমাখা, সয়াবিন, ডিম। শেষের মহার্ঘ বস্তুটি অবশ্য একদিনের জন্য জোটে। ‘মাংস ভাত?’ ভোটের আগে খাইয়েছিল। গণতন্ত্রে নির্বাচন ব্যবস্থার তাহলে একটা ইতিবাচক দিক আছে! বছরে একটা ভোট এলে অন্তত একবার মাংস জোটে ওদের! তথ্য বলছে, মাংস, ফলের অতিরিক্ত বরাদ্দ ২০২৩-এর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ছিল। হয়তো সব স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের ভাগ্যে তা জোটেনি। মিড-ডে-মিল নিয়ে দুর্নীতিও তো নেতাদের উপরি উপার্জনের বড় সহায়। একটি মেয়েকে ডাকলাম। চেহারায়, পোশাকে অবস্থাপন্ন ঘরের বোঝা যাচ্ছে। ক্লাস সেভেনের পড়ুয়া। বাড়ি থেকে টিফিন দিয়ে দেন অভিভাবক। ভাতটা খুব মোটা, ডাল জলের মতো, তাই সে মিড-ডে-মিল খায় না। এক-আধদিন ডিমের লোভে খেয়েছে বলে মায়ের বকুনি খেতে হয়েছে। এটা শহর ও মফসসলের স্কুলের ছবি। প্রতিদিন সেখানে বেশ পরিমাণ খাবার নষ্ট হয়। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুমন সরখেলের পর্যবেক্ষণ: তাঁদের স্কুলে সারা বছর প্রতিদিন কমপক্ষে দুশো ছেলেমেয়ের জন্য রান্না হয়। এককণা ভাতও নষ্ট হয় না। গরিবের গরিব, তস্য গরিব ছেলেমেয়েদের দল যখন দুপুরবেলা পেট ভরে ভাত খায়, মাস্টারমশাইয়ের মনে হয় এখানেই নেমে এসেছে স্বর্গ।
সেই মিড-ডে-মিলেও থাবা বসাল কেন্দ্রীয় সরকার। এবারের বাজেটে। বিগত দুই বছরের তুলনায় এ বছর মিড-ডে-মিল প্রকল্পে বরাদ্দ কমেছে ২১৩.৫ কোটি। ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুলে দুপুরের খাওয়ার এই প্রকল্পের একটা গেরামভারী নাম আছে: ‘প্রধানমন্ত্রী পোষণ শক্তি নির্মাণ’ বা পিএম পোষণ। এত কম টাকায় পোষণ হবে কী করে? নীতিশ-নায়ডুকে তোষণ-করা বাজেটের পর প্রমাণিত প্রধানমন্ত্রী গদি বাঁচাতেই মরিয়া, এইসব খুচরো বিষয় নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। ২০২২ সালের ১ অক্টোবর থেকে মিড-ডে-মিলে পড়ুয়া পিছু বরাদ্দ ছিল প্রাথমিকে ৫.৪৫ টাকা এবং উচ্চপ্রাথমিকে ৮.১৭ টাকা। বাজারে মূল্যবৃদ্ধির যে আগুন লেগেছে তাতে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের হাতেই ছেঁকা লাগার জোগাড়, সেখানে বরাদ্দের এই সামান্য টাকায় ছেলেমেয়েদের মুখে পুষ্টিকর খাবার তুলে দেওয়া অসম্ভব! সেই অসম্ভবের নেই-রাজ্যে বরাদ্দ আরও কমালেন সীতারামন। তাঁর পদবির দুই পৌরাণিক চরিত্রও জানেন, এতে ছাত্র-ছাত্রীদের পাতে আর কিছুই দেওয়া যাবে না। আর কে না জানেন, ক্ষুধা তালিকায় আমাদের দেশ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন। সমীক্ষায় প্রকাশ, দেশের তিন জন শিশুর মধ্যে এক জন অপুষ্টিতে ভুগছে। এর জেরে স্কুলে প্রাথমিক স্তর থেকেই ড্রপ আউট শুরু হবে না? সেটা ঘটবেই, শুধু সময়ের অপেক্ষা: এমনটা মত অধিকাংশ শিক্ষকের। বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনন্দ হাণ্ডার মন্তব্য: ‘যে দেশের অবস্থান ক্ষুধা তালিকার শীর্ষে, সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের গ্রাস কমিয়ে দেওয়া অত্যন্ত লজ্জার। দেশের ১২ কোটি শিশুর প্রতি কেন্দ্রের এই বঞ্চনা ও নিষ্ঠুরতাকে ধিক্কার জানানোরও ভাষা নেই।’
নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে এই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য– অপুষ্টি দূর করা, স্কুলছুট শিশুদের পড়াশোনার জগতে ফিরিয়ে আনা, ধর্ম-জাতি-শ্রেণি নির্বিশেষে শিশুদের মধ্যে বৈষম্য দূর করা। সবকটি উদ্দেশ্যই যথেষ্ট সফল। সিকি শতাব্দীর দোড়গোড়ায় পৌঁছে এর মূলে কুঠারাঘাত প্রমাণ করে শিক্ষা, পুষ্টি, সম্প্রীতি– এদের কোনও গুরুত্ব নেই কেন্দ্রের কাছে। আর এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কোনও সর্বাত্মক প্রতিবাদ উঠে আসবে না। আমরা যে মহাবিবাহ অনুষ্ঠানের রবাহুত দর্শক। ‘অসভ্যতা’ বোঝার ক্ষমতাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সেই মফসসলী বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েটিকে বলতে পারলাম না, এরপর হয়তো সপ্তাহে একদিন একটি ডিমও পাবে না তারা। শীর্ণ মুখটায় শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ নেমে আসে যদি, সেই আশঙ্কায় নিজেকে সম্বরণ করে চলে এলাম। ঠিক তখনই স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজল।