পশ্চিমে যখন এইচআইভি-র প্রভাব ক্রমশ বেড়ে চলেছে তখন ভারতে এই রোগ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন নির্মলা। সরকারি অর্থানুকূল্য, ল্যাবরেটরি কিংবা সমর্থন কিছুই মেলেনি। বরং সবদিক থেকেই আইচআইভি নিয়ে একরকম ঔদাসীন্য দেশের মানুষের স্বাস্থ্যকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পারত। ড. নির্মলা সেলাপ্পান ও ড. সুনীতি সলোমনের গবেষণা তা হতে দেয়নি। ‘ভিজিল্যান্স হোম’-এর যৌনকর্মীদের রক্ত পরীক্ষা করে নির্মলা প্রথম প্রমাণ করলেন এইচআইভি-র উপস্থিতি। নড়েচড়ে বসল সরকার। শুরু হল ভারতের বুকে এইচআইভি গবেষণার প্রথম ধাপ।
শ্বশুরবাড়ির লোক তেমন কিছু না বললেও প্রতিটি দিন কলেজের আগে নাকেমুখে দুটো খাবার গুঁজে ‘ভিজিল্যান্স হোম’-এ স্বামীকে নিয়ে ছোটা তার মধ্যে কিঞ্চিত অপরাধবোধের জন্ম দিচ্ছিল। তার স্বামী, বীরাপ্পন রামমূর্তি অবশ্য এত কিছু ভাবতেন না। যে-গ্রামে তাঁদের বেড়ে ওঠা সেখানকার মেয়েরা ঘরের পাশাপাশি বাইরের কাজে যথেষ্ট দক্ষ। তাছাড়া, নির্মলা ছাত্রী হিসেবে তুখোড়।
’৮০-র প্রথম দিকে গোটা দেশেই মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হাতেগোনা। নতুন একটা বিষয়। সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ভালো ছাত্রছাত্রীরাই পড়বার সুযোগ পায়। এমনকী, পরবর্তীকালে যারা ডাক্তার হতে চায়, তারাও স্নাতক স্তরে মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়ে। নির্মলার কেরিয়ার তখন খানিক সেইরকম দিকেই এগোচ্ছে। নির্মলা সকালে উঠোন নিকিয়ে, কিছু খাবার করে, কোনও রকমে চুলটা বেঁধে একটা সাধারণ সুতির শাড়ি পরে রামমূর্তির স্কুটারে উঠে বসত।
তখন শরৎকাল হলেও তামিলনাড়ুতে সারা বছর গরম থাকে। ঘামতে ঘামতে নির্মলা গিয়ে পৌঁছত ‘ভিজিল্যান্স হোম’। কারা থাকত সেখানে? কিছু যৌনকর্মী আর রাস্তার মেয়ে-ভিখিরি! পুলিশ আটকে রাখত। হয়তো তেমন কোনও অপরাধ নয়। কিন্তু বেল হয়নি বলে অসহায় এই মানুষগুলো এখানে আটকা পড়ে থাকত। নির্মলা হাতে করে কিছু ফলমূল তাদের জন্য নিয়ে যেত। তার থেকে বেশি খরচ করার মতো অর্থ নির্মলার ছিল না।
সে গবেষণার কাজ শুরু করেছে ঠিকই তবে সরকারি অর্থানুকূল্য কিছু তখনও পায়নি। কিংবা বলা যায়, সে যে-বিষয়ের ওপর গবেষণা শুরু করেছে, তার গাইড ড. সুনীতি সলোমন ছাড়া আর কেউ-ই তাকে সেই ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছে না। কী করেই-বা দেবে? ‘এইডস’ বলে যে অচেনা একটি রোগ তখন দেখা দিয়েছে– যাতে নাকি মানুষ রোগা হয়ে, সারা গায়ে দগদগে ঘা হয়ে মারা যাচ্ছে– তখনও তার কোনও সম্ভাবনা ভারতে নেই। ভবিষ্যতে হয়তো থাকবেও না। রোগটা মারাত্মক ছোঁয়াচে। সব থেকে বড় কথা একে অপরের সঙ্গে সেক্স করলেই এই রোগ হয়! তার মানে চুমু খেলে, হাত ধরলে, গায়ের সঙ্গে গা লাগলেই এ-রোগ বাঁধবে? অবশ্য ভারতে রোগটা কখনওই আসবে না। ওসব পশ্চিমে, যেসব দেশে যৌনতা বেশি, বেলেল্লাপনা বেশি, নেশা বেশি, নোংরামি বেশি– সেসব জায়গায় হয়!
এগুলো আসলে মানুষের পাপের ফল, আর কিছুই নয়। ভারত ঋষি-মুনিদের দেশ। এখানে যৌনতা নিয়ে মানুষের এত বাড়াবাড়ি নেই। তাছাড়া বোম্বের মতো ব্যবসাভিত্তিক শহরে অনেক মানুষের ওপর পরীক্ষা হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায়নি। আর মাদ্রাজ তো এসবের অনেক দূরে। এইরকম একটা রোগ যা দেশেই নেই, সেটাকে নিয়ে গবেষণা করে লাভ কী?
অতএব, নির্মলাকে উৎসাহ দেবার লোক নেই। ড. সলোমন একটি সূত্র দিয়েছিলেন, ‘দ্যাখো! রোগ দেশে থাকুক আর না-ই থাকুক, তুমি বিজ্ঞানের ছাত্রী। তুমি যে-কোনও বিষয় নিয়েই গবেষণা করতে পারো। হয়তো দেখলে এটা নিয়ে খুব এগনো গেল না কিন্তু অন্য কোনও দরজা খুলে গেল। ইউ গো অ্যাহেড। ফার্স্ট চেক উইথ দ্য পিপল হু কাম টু কিয়োরিং ভেনেরিয়াল ডিজিজেজ। ইউ ক্যান আস্ক সেক্স-ওয়ার্কার্স, গে-মেন অ্যান্ড ইভেন আফ্রিকান স্টুডেন্টস’। নির্মলার সব মনখারাপ কেটে গিয়েছিল সলোমন ম্যামের আশীর্বাণীতে। সে কাজে লেগে পড়েছিল।
মাদ্রাজ জেনারেল হাসপাতালে যেসব মানুষ নানা ধরনের যৌনরোগ, যেমন– সিফিলিস, গনোরিয়া ইত্যাদির চিকিৎসা করাতে আসত, তাদের রক্তের স্যাম্পল জোগাড় করতে আরম্ভ করল সে। এখানে শহরের বেশিরভাগ যৌনকর্মীরাই চিকিৎসার জন্য আসত। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল নির্মলার। তারাই ‘ভিজিল্যান্স হোম’-এর হদিশ দিয়েছিল নির্মলাকে। তাও ছ’মাস আগে। তারপর সবরকম পারমিশন জোগাড় করে নির্মলা রক্তের স্যাম্পেল তৈরির কাজ শুরু করেছিল ‘ভিজিল্যান্স হোম’-এ।
যে-কোনও রোগের গবেষণায় যত বেশি স্যাম্পল জোগাড় হয় তত ভালো। ড. সলোমন বলেছিলেন, “অন্তত দু’শোটা”। এই যে এখন প্রত্যহ স্বামীর স্কুটারে চেপে সকাল সকাল ‘ভিজিল্যান্স হোম’-এ হাজিরা দিচ্ছে নির্মলা, প্রায় তিনটি মাস অতিক্রান্ত, তাতে মাত্র ৮০টা স্যাম্পল জোগাড় করা গেছে। কোনও গ্লাভস নেই, সেফটি-গিয়ার নেই, মাস্ক নেই। নির্মলা সম্পূর্ণ খালি হাতে সিরিঞ্জ নিয়ে রক্তের স্যাম্পল এক জায়গায় করে। আর সেসব রাখে কোথায়? কোথায় আবার, নিজের বাড়ির ফ্রিজে! ল্যাবরেটরির সুবিধা কি এত সহজে মেলে!
………………………………….
মাদ্রাজ জেনারেল হাসপাতালে যেসব মানুষ নানা ধরনের যৌনরোগ, যেমন– সিফিলিস, গনোরিয়া ইত্যাদির চিকিৎসা করাতে আসত, তাদের রক্তের স্যাম্পল জোগাড় করতে আরম্ভ করল সে। এখানে শহরের বেশিরভাগ যৌনকর্মীরাই চিকিৎসার জন্য আসত। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল নির্মলার। তারাই ‘ভিজিল্যান্স হোম’-এর হদিশ দিয়েছিল নির্মলাকে। তাও ছ’মাস আগে। তারপর সবরকম পারমিশন জোগাড় করে নির্মলা রক্তের স্যাম্পেল তৈরির কাজ শুরু করেছিল ‘ভিজিল্যান্স হোম’-এ।
………………………………….
সকালে ‘ভিজিল্যান্স হোম’ থেকে সংগৃহীত স্যাম্পেল সে বাড়িতে রাখতে আসে, তারপর আবার কলেজে যায়। সেটা ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে। তার দু’-তিনমাস বাদে, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ, নির্মলা আর বীরাপ্পন বাড়ি থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিকেল কলেজে সেই ৮০টা মতো সংগৃহীত রক্তের স্যাম্পল নিয়ে হাজির হয়। নতুন গবেষণা, অচেনা বিষয়, তাই সেখানকার পদস্থ ড. জ্যাকব জন তাঁর দু’জন ছাত্র– ড. জর্জ বাবু আর ড. এরিক সিমো-কে নির্মলার সাহায্যের জন্য দেন। পুরো পরিকল্পনা ছিল ড. সলোমনের; কারণ তিনি জানতেন ভেলোরে যেসব ল্যাবরেটরির সুবিধা পাওয়া যাবে, নিরীক্ষার সুযোগ মিলবে, তা তৎকালীন তামিলনাড়ুর অন্য কোনও জায়গায় সম্ভবপর নয়।
পরীক্ষার কাজ স্থির হল সাতদিন পর। নির্মলা আর বীরাপ্পন সেদিন ভোর-ভোর হাজির। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ পরীক্ষা শুরু হল। সে পরীক্ষা শেষ হতে হতে দুপুর। মাঝখানে পাওয়ার-কাট। এর মধ্যে নির্মলা, বীরাপ্পন, জর্জ আর এরিক একটু চায়ের বিরতি নিল। ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরে এসে টেস্টকিটের ঢাকনা তুলতেই ড. জর্জ বাবু থ মেরে গেলেন। নির্মলা ততক্ষণে পুরোটা উপলব্ধি করেছে। কারণ সে দেখে নিয়েছে স্যাম্পলগুলোয় হলদেটে রঙ এসেছে। ছ’টা স্যাম্পলের ছ’টিই এইচআইভি পজিটিভ!
নির্মলার প্রফেসর ড. সুনীতি সলোমনের কাছে খবর গেল। নির্মলা একটা গোটা টিম নিয়ে দু’দিন পর ‘ভিজিল্যান্স হোম’-এ গিয়ে হাজির। সেদিনের সব স্যাম্পল পাঠানো হল আমেরিকায় পরীক্ষার জন্য। দু’সপ্তাহ পর খবর এল নির্মলার নিরীক্ষা, গবেষণায় ভুল নেই। এর আগে কতবার নির্মলা নিজেই ভেবেছে একটা হেরে যাওয়া খেলা খেলছে সে। সত্যিই হয়তো ভারতে এইচআইভি বা এইডস নেই। কিন্তু তার জেদ, পরিশ্রম, নাছোড় মানসিকতা তাকে জয় এনে দিল।
তবে ওটুকুই। সে গবেষণা শেষ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আরও ১০০টা স্যাম্পল সংগ্রহ তখনও বাকি! প্রায় এক বছর পর সে তার থিসিস জমা করল ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে– ‘সারভাইলেন্স ফর এইডস ইন তামিলনাড়ু’। ততদিনে নির্মলার কাজের ওপর নির্ভর করে ‘দ্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ’ তামিলনাড়ুর স্বাস্থ্যমন্ত্রী এইচ ভি হান্ডে আর ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে পুরো ব্যাপারটা সম্বন্ধে অবগত করেছে।
অবশেষে ভারত সরকারিভাবে মেনে নিল এইডস এবং এইচআইভি দেশে আছে। আরও গবেষণা শুরু হল। ভয়ের আবহ তৈরি হল। দেশের যৌনকর্মী ও সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা এমনিতেই প্রান্তিক ছিলেন, তাঁদের ওপর হিংসা-হেনস্থার ঘটনা বাড়ল। তারপর দেখা গেল এইচআইভি আর এইডস এক জিনিস নয়। রোগটির ভয়াবহতা আছে কিন্তু তার প্রতিরোধও সম্ভব। কন্ডোম আছে। এখন ‘প্রেপ’ এসেছে। ভারতে আজ ২০ লক্ষ মানুষ এইচআইভি আক্রান্ত। কিন্তু আমরা জানি, সঠিক মাত্রায় ওষুধ খেলে এইচআইভি তো এইডস হতে পারেই না; বরং রক্তে শর্করা নিয়ে মানুষ যতদিন সুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে, তার থেকেও সুরক্ষিতভাবে এইচআইভি নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব।
ভারতে খুব কম মানুষ এইডসে মারা যায়। তার বহুগুণ আজও মারা যায় টিউবারকুলোসিসে। আর হ্যাঁ, চুমু খেলে বা আক্রান্তকে স্পর্শ করলে এইচআইভি সংক্রামিত হয় না। কিন্তু এতসব সম্ভব হত না, যদি আজ থেকে ৪০ বছর আগে মাত্র ৩২ বছর বয়সী একটি মেয়ে সামাজিক সংস্কারকে পাত্তা না দিয়ে, লজ্জাশরম ভুলে যৌনকর্মীদের মাঝে তার অকুতোভয় গবেষণা না চালাত। অনেক জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারত সরকারের চোখ বন্ধ করে রাখা মানসিকতায়। সবাই বলেছিল এইডস ভারতে নেই। বিজ্ঞানের ছাত্রী সেলাপ্পান নির্মলা তাও এগিয়ে পড়েছিল।
কী হয়েছিল তারপর নির্মলার?
ড. সেলাপ্পান নির্মলা ‘কিং ইনস্টিটিউট অফ প্রিভেন্টিভ মেডিসিন’-এ বহু বছর চাকরি করেছেন। ভ্যাকসিন গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১০ সাল নাগাদ তিনি অবসর গ্রহণ করেন। কেরিয়ারের শুরুতে যেমন কোনও সরকারি অর্থানুকূল্য পাননি; তেমনই সারা জীবনেও এই বিজ্ঞানী পাননি কোনও সরকারি পুরস্কার বা স্বীকৃতি। ক’টা লোক জানেন ড. সেলাপ্পান নির্মলার যুগান্তকারী গবেষণার কথা? সদ্য নারীদিবস পার হল। এমন মহীয়সী ভারতীয় নারীদের কথা যেন আমরা না ভুলি।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………
এই লাল অবশ্য, দেশে দেশে, মুক্তির রং হিসেবে, ছড়িয়ে পড়লেও, তার রং, ফ্যাকাশে হতেও সময় লাগেনি। ঘন লাল, মাঝারি লাল, হালকা লাল, গোলাপি লাল, আগ্রাসী লাল, একসময় সাম্রাজ্যবাদী লালও হয়ে ওঠে, একনায়ক লাল, ফ্যাসিস্ট লাল– এমনভাবেই লাল তার এক ধরনের রাজনৈতিক চেহারা নিল, আমরা দর্শক বনে গেলাম।