এই বদ্ধ সময়ের বুকে বাংলাদেশের আন্দোলন ঝোড়ো বাতাস নিয়ে এসেছে। যাঁরা লড়াইয়ের থেকে আশা সরিয়ে নিয়েছিলেন, অসহায়তাকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন, বাংলাদেশ তাঁদের আলো দিলেন। তবে এই মিলের জায়গাটা হয়তো আরেকটু স্পষ্ট করা প্রয়োজন। আর এই মিল বুঝতে গেলে অমিলের জায়গাটা আরও ভালো করে বুঝতে হবে।
৭৮ তম স্বাধীনতা দিবস আসতে আর মাত্র সাত দিন। আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ৮ আগস্ট শহরের কিছু অংশে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়ার কথা। সময় গড়িয়ে গেল ৮ আগস্টের রাতে, বৃষ্টি হল না। ক্ষীণ এলোমেলো হাওয়ায় দু’-চারটে পাতা নড়ে উঠল সামান্য। বৃষ্টি হল না।
৭৮তম স্বাধীনতা দিবস আসতে আর মাত্র ছয় দিন। আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ৯ আগস্ট কড়া রোদে তেতে উঠেছে রাজ্য। এক মুঠোফোন থেকে আরেক মুঠোফোনে পাচার হচ্ছে যন্ত্রণা, হতাশা, ক্রোধের বার্তা। আর জি কর হাসপাতালে ডাক্তার-পড়ুয়ার ভয়াবহ নৃশংস ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় ম্লান কলকাতা সেদিন শিউরে উঠেছিল।
বহু মানুষ পথে নামেন। আঙুল ওঠে প্রশাসনের দিকে। একাধিক নাগরিক মিছিলে শহরের রাজপথ উপচে পড়তে থাকে।
মন বলে, কোথাও যেন, কেমন যেন মিল পাওয়া যাচ্ছে না?
১৪ আগস্ট রাতের দখলের ডাক দেয় মেয়েরা এবং প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষেরা। যে ‘রাত’ প্রশ্নের মুখে, সেই রাতের দখল নেবেন তাঁরা। এই ডাক সমাজমাধ্যমে প্রাথমিকভাবে সাড়া পেলেও, মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, অনুমান করা যায়নি। পরবর্তীতে এই আন্দোলনের ডাক বিদ্যুৎ গতিতে রাজ্য, দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে।
………………………………….
১৪ আগস্টের ‘রাত দখল’ কর্মসূচি এবং ১৮ আগস্টের ডুরান্ড ডার্বি বাতিলের পর ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান এবং মহামেডান স্পোর্টিং-এর সমর্থকদের মিছিল যে চেহারা নিয়েছিল, তা একথাই প্রমাণ করে। মাঠের সমস্তরকম শত্রুতা ভুলে ধর্ষণের বিচার চেয়ে তাঁরা এক হয়ে রাস্তায় হাঁটলেন। এটাই হয়তো গণ আন্দোলনের দিকে দুই পা এগিয়ে যাওয়া।
…………………………………..
সমাজের সচেতন, গণ আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা মানুষজন যে থাকবেন সে কথা অনায়াসেই আন্দাজ করা গিয়েছিল। তবে ১৪ তারিখ রাত এই সমস্ত অনুমানকে একপ্রকার ছাপিয়ে গেল। কাতারে কাতারে মানুষ, এই ডাকে সাড়া দিয়ে রাস্তায় নামলেন। ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসের রাতে অবরুদ্ধ হয়ে রইল গোটা রাজ্য।
মন বলছিল, মিল আছে…
সেদিন রাতে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হল। ছাতা মাথায় মানুষ গোটা রাত রাস্তায় রইলেন।
আর এরই মধ্যে পৃথিবী বাংলাদেশের গণ অভ্যুত্থান দেখে ফেলেছে। খেয়াল করে দেখুন। ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশের ছাত্র নাগরিক গণ অভ্যুত্থানের চিত্রগুলি। ছাত্রছাত্রীদের ডাকে পথে নেমে পড়েছিলেন শয়ে শয়ে মানুষ। গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে খেত মজুর এবং অসংখ্য ছাত্রছাত্রীরা।
পশ্চিমবঙ্গে ১৪ আগস্টের পরের দিনগুলো খেয়াল করলে হয়তো বাংলাদেশের আন্দোলনের সঙ্গে এর সম্পূর্ণ না হলেও, আংশিক সামঞ্জস্য লক্ষ করা যাবে।
পশ্চিমবঙ্গের এই আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে চোখে পড়ার মতো। রাজ্যের রাজনৈতিক ভাবে সোচ্চার বলে পরিচিত যে দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, তারা বাদেও অসংখ্য কলেজের ছাত্রছাত্রীদের এবার সক্রিয়ভাবে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু ইশকুলেও এই ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষকদের মিছিল করতে দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ গোটা উপমহাদেশের সামনে উদাহরণ হয়ে গিয়েছে। দেশের শাসকদের যেমন আশঙ্কার কারণ বাংলাদেশ, তেমনই আন্দোলনকারীদের কাছে সম্ভাবনার নাম হয়ে উঠেছে এই বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের আন্দোলন একটা পর্যায়ের পর যে গণমুখী চেহারা ধারণ করেছিল, পশ্চিমবঙ্গ সে পথেই রয়েছে বলা চলে।
১৪ আগস্টের ‘রাত দখল’ কর্মসূচি এবং ১৮ আগস্টের ডুরান্ড ডার্বি বাতিলের পর ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান এবং মহামেডান স্পোর্টিং-এর সমর্থকদের মিছিল যে চেহারা নিয়েছিল, তা একথাই প্রমাণ করে। মাঠের সমস্তরকম শত্রুতা ভুলে ধর্ষণের বিচার চেয়ে তাঁরা এক হয়ে রাস্তায় হাঁটলেন। এটাই হয়তো গণ আন্দোলনের দিকে দুই পা এগিয়ে যাওয়া।
একটা বড় অংশের মানুষ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দলমত নির্বিশেষে পথে নামছেন। নিজেদের অসহায়তা, নিরাপত্তাহীনতা, প্রবল রাগ উগড়ে দিচ্ছেন, রাস্তা অবরোধ করে রাখছেন।
বাংলাদেশের আন্দোলনেও এই ছবি দেখা গিয়েছিল, কোনও দলের ডাকে নয়, বিবেকের তাড়নায় মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছেন। দুই হাত টানটান করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন তাঁরা।
পশ্চিমবঙ্গের এই আন্দোলনকে সামনে থেকে দেখে যেন ফোনের পর্দায় দেখা বাংলাদেশের সেই ছবিগুলোই ভেসে আসছে। মানুষ যেন আর কিচ্ছুকে ভয় করছেন না।
গোটা দেশে যেন একরকম সহমর্মিতার আবহ সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে রাস্তায় আটকে পড়া মানুষ মিছিল বা প্রতিবাদ কর্মসূচিকে গালমন্দ করার বদলে বাস-অটো থেকে নেমে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন। অনভ্যস্ত, আনকোরা ভঙ্গিতে একটুও সংকোচ বোধ না করে বিচারের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেন।
আসলে এই বদ্ধ সময়ের বুকে বাংলাদেশের আন্দোলন ঝোড়ো বাতাস নিয়ে এসেছে। যাঁরা লড়াইয়ের থেকে আশা সরিয়ে নিয়েছিলেন, অসহায়তাকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন, বাংলাদেশ তাঁদের আলো দিলেন। তবে এই মিলের জায়গাটা হয়তো আরেকটু স্পষ্ট করা প্রয়োজন। আর এই মিল বুঝতে গেলে অমিলের জায়গাটা আরও ভালো করে বুঝতে হবে।
বাংলাদেশে কোনও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নেই। তাঁদের দেশে একটি সরকার, আমাদের দু’টি। একটি কেন্দ্রীয় সরকার, একটি রাজ্য সরকার। পশ্চিমবঙ্গের এই আন্দোলনের আক্রমণের মূলে রয়েছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, মুখ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশের আন্দোলন ছিল তাঁদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এটা মৌলিক পার্থক্যের জায়গা।
শেখ হাসিনাকে যেমন করে বাংলাদেশের আন্দোলনকে দমন করতে দেখা গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে এখনও পর্যন্ত সেভাবে গুলি চালিয়ে, গ্রেফতার করে আন্দোলন ঠেকাতে দেখা যায়নি। উপরন্তু বলা চলে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যেন বাংলাদেশ থেকেই শিক্ষা নিয়ে কতকটা বুঝে শুনে চালগুলো দিতে চাইছেন।
তবে এরই মধ্যে একটি কথা জানিয়ে রাখা জরুরি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে এসেছিলেন, ‘ওরা এখানেও বাংলাদেশের মতো করতে চাইছে…’।
আসলে, পশ্চিমবঙ্গের আন্দোলনের যে স্পিরিট তৈরি হয়েছে তাতে বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রভাব রয়েছে। সরাসরি হুবহু অনুকরণ নয়। বাংলাদেশ গোটা উপমহাদেশে যে লড়াইয়ের মন তৈরি করে দিয়েছে, তাই-ই এবার পশ্চিমবঙ্গে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর এইটাই মিলের জায়গা।
যে স্পর্ধা হারাতে বসেছিল পশ্চিমবাংলা, সেই স্পর্ধা যেন বাংলাদেশ তাদের ফিরিয়ে দিল। ডাক্তার পড়ুয়ার নৃশংস ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় তাই দায় এড়ানোর বদলে পথকেই বেছে নিলেন এপার বাংলার মানুষ। আর তাঁদের পথ দেখাল বাংলাদেশ।
রাস্তাই একমাত্র রাস্তা। তা যেন শেষমেশ ন্যায়বিচারের দোরগোরায় গিয়ে দাঁড়ায়।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved