দুই নারী একে-অপরকে চুম্বন করেন, তখন সেটি অনেকের চোখে যেন একটি ফেটিশিজমে পরিণত হয়। অনেক সময়, সেই চুম্বনকে কোনও মানবিক বা প্রেমময় অনুভূতি হিসেবে না দেখে, মানুষ সেটিকে একটি ‘বিশেষ আকর্ষণ’ বা ‘অস্বাভাবিক’ ঘটনা হিসেবে দেখে। শহরটা কিন্তু বদলাচ্ছে। প্রতিটি চুম্বনের সঙ্গে শহরটা একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। আর যত দিন যাবে, এই পরিবর্তনের কাহিনি আরও লেখা হবে।তোমাদের ভদ্রলোক-সংস্কৃতির দেওয়ালে ফাটল ধরছে, আর এই ফাটলের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসা।
প্রচ্ছদ শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
কলকাতা, এই শহরটা এক অদ্ভুত জায়গা। একদিকে সে রবি ঠাকুরের প্রেমের গান গায়, আর অন্যদিকে, যদি দু’জন মানুষ মেট্রোর প্ল্যাটফর্মে চুমু খেয়ে বসে, তবে তার মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট যেন বাতাসে বিস্ফোরণ ঘটায়। সম্প্রতি, কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের একটি ভিডিও নিয়ে এমনই এক কাণ্ড শুরু হল! দুই প্রেমিক-প্রেমিকার একটি সাধারণ চুম্বন ভিডিওতে বন্দি হল, আর সোশাল মিডিয়ায় নেমে এল এক জলোচ্ছ্বাস!
ভদ্রলোকদের মাথা গরম, ভাবখানা এমন যে, ‘এই দেখলে তো! কলকাতার সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেল!’ যেন ওঁরা হাওড়া ব্রিজের মাথায় বসে সংস্কৃতির পাহারা দেন। চুম্বনের মতো সাধারণ একটি জিনিস, যা পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণীর মধ্যেই অতীব স্বাভাবিক, সেটাই নাকি ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র কালো দিনে পরিণত হয়েছে!
…………………………
স্বস্তিকা মুখার্জি-র লেখা: ওই ছেলেমেয়ে দু’টির উচিত পরদিন ওই মেট্রো স্টেশনে গিয়ে আবার চুমু খাওয়া
…………………………
কিন্তু আজ আমি লিখতে বসেছি এমন একটি চুম্বনের গল্প, যা ঠিক এইসব ভদ্রলোকেরই বুকে কাঁপন ধরাবে। আজকের গল্পে নেই কোনও পুরুষ। আছে দুই নারী, একটি শহর, আর একটি চুম্বন।
শুরু করা যাক শহরটা দিয়ে। কলকাতা, তুমি তো বলো তুমি ‘সিটি অফ জয়’। কিন্তু সত্যিই কি সবাই এখানে আনন্দ পায়? সবাই কি সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করে? বিশেষ করে, যদি কেউ ভদ্রলোক সমাজের নির্ধারিত কাঠামো থেকে বেরিয়ে ভালোবাসতে চায়? নারীর সঙ্গে নারী, পুরুষের সঙ্গে পুরুষ, বা কোনও লিঙ্গপরিচয়ের সীমার বাইরে দাঁড়িয়ে যদি কেউ ভালোবাসতে চায়, তাহলে তুমি তাদের জন্য ঠিক কতটা জায়গা রাখতে পারো?
একটি চুম্বন। কত সহজ, কত জটিল! চুম্বন মানে তো কেবল ঠোঁটের স্পর্শ নয়। চুম্বন মানে সাহস, প্রেম, বিদ্রোহ, আর কখনও কখনও, দুটো ঠোঁটকে সম্মতি-সহ একসঙ্গে নিয়ে এসে সমাজকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া।
এবার একটু কল্পনা করুন। শীতের এক সন্ধে। প্রিন্সেপ ঘাটে নরম বাতাস, গঙ্গার ওপারে হাওড়া ব্রিজের আলো। দুই নারী হাত ধরে বসে আছেন। একজন হয়তো ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়লেন। অন্যজন চোখ বন্ধ করে নিলেন। একজনের ঠোঁট আরেকজনের ঠোঁটের সঙ্গে মিশে গেল।
এখানেই আসল মজাটা লুকিয়ে আছে। একজন পুরুষ যদি কোনও নারীকে চুম্বন করেন, তবে সেটা ‘রোমান্স’। আর দুই নারী যদি চুম্বন করেন, তবে সেটা ‘প্রচণ্ড সাহসী কাজ’।
কেন? কারণ ভদ্রলোক সমাজের চোখে দুই নারীর চুম্বন তো আর ‘স্বাভাবিক’ নয়। আরে, স্বাভাবিক কাকে বলে, সেটার সংজ্ঞা তো ঠিক করেছেন তারাই– আমাদের কলকাতার ভদ্রলোকরা। নিজেরাই বিধান দেন, নিজেরাই বিচার করেন। আর কিছু হলেই, ‘সংস্কৃতি শেষ!’
এই তো সমস্যার আসল জায়গা। কলকাতার ভদ্রলোক সমাজ মনে করে, তারা এই শহরের মন আর মস্তিষ্কের একমাত্র মালিক। তাদের অনুমোদন ছাড়া যদি কেউ কিছু করে, তবে সেটি অবশ্যই ‘অসভ্যতা’। আর ভালোবাসা? ওহো, সেটা তো তাদের নিয়ম মেনেই চলতে হবে।
এখন আসি আমার গল্পে। দুই নারীর চুম্বন, যা শুধু একটি চুম্বন নয়। এটি এক নির্লজ্জ বিদ্রোহ। এটি সেই সমাজের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ, যে সমাজ ভালোবাসাকে সীমাবদ্ধ করতে চায় লিঙ্গ ও সম্পর্কের নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে।
কিন্তু এই চুম্বনের মুহূর্তটি কেমন? যখন দুই নারী, এই শহরের সব চোখ, সব নিষেধাজ্ঞা, সব বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে, একে অপরকে স্পর্শ করেন? এটি একটি কাব্যিক মুহূর্ত। একটি শহরের সমস্ত নিয়মকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া এক জ্বলজ্বলে মুহূর্ত।
কিন্তু সেই মুহূর্তেই ভদ্রলোক সমাজের কোথাও যেন বুকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়। তারা সোশাল মিডিয়ায় যান, মিম বানান। ‘এদের উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার!’ বলে মন্তব্য করেন। তাদের আঙুলে জ্বলন্ত কি-বোর্ড।
আচ্ছা, আপনাদের প্রশ্ন করি। যখন রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে প্রেমের কথা বলেন, তখন কি সেই প্রেম শুধু কবিতার পাতায় আটকে থাকে? যদি কোনও নারী বাস্তব জীবনে আরেকজন নারীকে ভালোবাসেন, তবে কি সেই প্রেম শুধু কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে? আর যখন দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী একে অপরকে সম্মতি-সহ চুম্বন করেন, তখন কি সেই প্রেম শুধুই মনের অজান্তে হারিয়ে যায়? কীভাবে সমাজ তাকে কবিতার চমৎকার মাধুরীতে মুড়ে ফেলে? বাস্তবতার সঙ্গে প্রেমের এই প্রকাশের মিলন যদি এক পলকও আমাদের চোখে ধরা পড়ে, তবে সেই চুম্বন কি কবিতার মধ্যে আছেই? না, সেই প্রেম কি কেবল ‘অপসংস্কৃতি’-র ঢঙে পরিণত হবে?
যখন দুই নারী একে-অপরকে চুম্বন করেন, তখন সেটি অনেকের চোখে যেন একটি ফেটিশিজমে পরিণত হয়। অনেক সময়, সেই চুম্বনকে কোনও মানবিক বা প্রেমময় অনুভূতি হিসেবে না দেখে, মানুষ সেটিকে একটি ‘বিশেষ আকর্ষণ’ বা ‘অস্বাভাবিক’ ঘটনা হিসেবে দেখে। সেই চুম্বনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় যেন তা শুধুই এক ধরনের যৌন আগ্রহ বা উত্তেজনা সৃষ্টি করে, কিন্তু বাস্তবে, এটি একে-অপরের প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা, এবং গভীর সম্পর্কের প্রকাশমাত্র।
তবে, এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল সমস্যা হল, সমাজের একটি অংশে নারীর যৌনতা এবং প্রেম সাধারণত পুরুষের চোখে দেখা হয়, এবং দু’জন নারী যখন একে অপরকে ভালোবাসেন বা চুম্বন করেন, তখন সেটি যেন শুধুই যৌন আকর্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। যৌনতা কোনও নেতিবাচক ধারণা নয়; বরং এটি মানুষের সম্পর্ক এবং অনুভূতির একটি প্রাকৃতিক, গৌরবময় অংশ। কিন্তু যখন দুই নারীর প্রেম বা চুম্বন শুধুমাত্র যৌনতার ফিল্টারে দেখা হয়, তখন সেটি সম্পর্কের গভীরতা, মানবিকতা, এবং অনুভূতির আড়ালে পড়ে যায়। বাস্তবিকভাবে, একজন নারীর অন্য নারীকে ভালোবাসা বা চুম্বন করা, কোনও বিকৃত বা অস্বাভাবিক বিষয় নয়, বরং সেটি একটি আন্তরিক, প্রেমময় এবং বৈধ সম্পর্কের প্রকাশ। এভাবে, আমাদের উচিত এই সম্পর্কগুলিকে একটি মানবিক এবং গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা, যা যৌনতার প্রাকৃতিকতা এবং অনুভূতির মাধুর্যকে সম্মান করে।
আসলে, আপনাদের ভদ্রলোক সংস্কৃতি শুধুই মুখোশ। মুখে রোমান্সের বড় বড় কথা, আর ভিতরে অন্ধকার।
তবে শহরটা কিন্তু বদলাচ্ছে। প্রতিটি চুম্বনের সঙ্গে শহরটা একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। আর যত দিন যাবে, এই পরিবর্তনের কাহিনি আরও লেখা হবে। তোমাদের ভদ্রলোক-সংস্কৃতির দেওয়ালে ফাটল ধরছে, আর এই ফাটলের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসা।
শহর, তুমি কি আমাদের গ্রহণ করবে? নাকি তুমি চিরকাল ছায়ায় লুকিয়ে থাকতে বলবে? আমরা কিন্তু আর ছায়ায় থাকতে চাই না। আমাদের ভালোবাসা, আমাদের চুম্বন, সবটাই তোমার আলোর জন্য তৈরি।
কলকাতা, এবার তোমার পালা।
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved