বিগত দুই-তিন বছর ধরে প্রায় নিয়মিতভাবে গণমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় নারীর ব্যক্তি-স্বাধীনতাবিরোধী পিতৃতান্ত্রিক কথাবার্তা বলে চলেছেন মমতাশঙ্কর, নন্দিনী ভট্টাচার্যরা। আর সেই রুচিকে মান্যতা দেওয়ার, প্রতিষ্ঠিত করার, সর্বোপরি এই ধরনের কথাবার্তার ‘বাজার’ তৈরি করতে উঠেপড়ে লেগেছে গণমাধ্যমগুলি। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম গর্ব মমতাশঙ্করের কথা বলেই হয়তো তা ভাবিয়ে তুলছে অল্পবয়সী আত্মবিশ্বাসী স্বাধীনচেতা মেয়েটিকে। সে কি ‘ডন কিহোতে’ হয়ে মমতাশঙ্কর নামক হাওয়াকলকে দৈত্য ভেবে লড়াই করবে, নাকি সত্যিকারের দৈত্যকে চিহ্নিত করে খুলে দেবে তার নয়া-পিতৃতান্ত্রিক মুখোশ?
বিগত দু’-তিন বছর ধরে মমতাশঙ্কর প্রায় নিয়মিতভাবেই নারীর ব্যক্তি-স্বাধীনতাবিরোধী পিতৃতান্ত্রিক কথাবার্তা গণমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় বলে চলেছেন। কখনও সেটা শাড়ির আঁচল নিয়ে, কখনও চরিত্রের ওপর নির্ভর করে কুপ্রস্তাব পাওয়া নিয়ে, কখনও শরীর দেখানো নিয়ে, কখনও চুমু খাওয়া নিয়ে। তাঁর সেই মন্তব্যগুলির প্রেক্ষিতে যুক্তিসংগত ভাবেই বারবার বিরোধিতা করা হচ্ছে, বারবার দেখানো হচ্ছে তিনি কতটা ‘পিতৃতান্ত্রিক’। এই পুরো ব্যাপারটা বৃত্তাকারে ঘটেই চলেছে।
মমতাশঙ্করের মন্তব্যের বিরতিকালে কখনও কখনও সেই জায়গা নিচ্ছেন নন্দিনী ভট্টাচার্যর মতো কেউ কেউ–যাঁরা দিনরাত ‘আজকের নারী’-কে গালিগালাজ করে চলেন। নন্দিনী ভট্টাচার্যকে তো পুরস্কৃতও করা হয়েছে ‘বর্ষসেরা নারী’ হিসেবে।
মমতাশঙ্কর, নন্দিনী ভট্টাচার্যদের পিতৃতান্ত্রিক কথাবার্তার চেয়েও আমাদের মনোযোগ সহকারে সেদিকে তাকানো দরকার– যাঁরা তাঁদের ‘লকার রুম’-সুলভ কথাবার্তাকে বারবার মানুষের সামনে নিয়ে এসে, এই ধরনের কথাবার্তা বলার অস্বস্তিকর অথচ অনায়াস একটি রুচিকে মান্যতা দিতে চাইছে। এদের মানসিকতা কী এবং এদের রুচি কেমন, তা বোঝার জন্য দু’-একটি মন্তব্যই যথেষ্ট ছিল। সেই রুচিকে গণমাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার কোনও সামজিক গুরুত্ব যে নেই– তা-ও আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি। এমনও নয় যে , মমতাশঙ্কর বা নন্দিনী ভট্টাচার্যদের কথাবার্তার বিপুল চাহিদা রয়েছে গণমাধ্যমে; তাই ‘বিক্রি’-র জন্য এঁদের একই ধরনের কথাবার্তা বারবার তুলে আনা হয়। তারপরেও এই ধরনের কথাবার্তার বাজার তৈরি করতে এত উৎসাহ কেন? এই অতি সক্রিয়তা কি আসলে পাল্টাতে থাকা সমাজব্যবস্থা ও সচেতন মানুষের রুচিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না-পেরে তাকে পরোক্ষভাবে আঘাত করতে চাওয়া?
এমন একটা সময়ে আমরা বাস করি যেখানে তথাকথিত সংস্কৃতিমনস্ক, উচ্চশিক্ষিত, ভদ্রলোকী পরিসরে ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ থাকার বা সাজার চাপে পড়ে যা-ইচ্ছে-তাই বলার অশালীন অভ্যাস কিছুটা হলেও কমেছে। এক প্রজন্ম আগেও ভদ্রসমাজে যতটা সহজে ‘চাষা কোথাকার’, ‘চুরি-চামারি’, ‘চামার’, ‘ক্যারেক্টারলেস মেয়ে’, ‘শরীর দেখিয়ে-বেড়ানো মেয়ে’, ‘মুসলমান হলেও ভদ্রলোক’, ‘কোটার ডাক্তার’, ‘হাফ-লেডিস’, ‘বউয়ের আঁচলের তলায় থাকা’ শব্দগুলো অনায়াসে আড্ডায় বলা যেত– এখন তা আর যায় না। ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাদের এখন এইসব বলার জন্য ‘লকার রুম’ পরিসরের আড়ালটুকু লাগে। সেই ‘লকার রুম’ হতে পারে ব্যক্তিগত জায়গায় একইরকম মানসিকতার মানুষদের ঘরোয়া আড্ডা, হতে পারে একইরকম মানসিকতার মানুষদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বা টেলিগ্রাম গ্রুপ। যে-সমস্ত কথা ‘ভদ্রলোক’ সাজার চাপে পড়ে এরা জনসমক্ষে বলতে পারছে না, সেইসব কথা, তারা বের করে দেয় এইসব ব্যক্তিগত পরিসরকে ক্যাথিটারের মতো ব্যবহার করে।
এই পরিসরগুলির সঙ্গে যৌন ফ্যান্টাসি, পর্নোটোপিয়া ইত্যাদি পরিসরের ফারাক রয়েছে। যৌন ফ্যান্টাসি এবং পর্নোটোপিয়ার মতো পরিসরে মানুষ একত্রিত হয় ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে। যে-ইচ্ছা সমাজের চাপে উচ্চারণ করা যায় না, সেই ইচ্ছাকে উচ্চারণ করার জন্য এই দুই পরিসর। এই দুই পরিসরের সঙ্গে ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ থাকার দায় নেই। ব্যক্তিগত পরিসরগুলির মধ্যে পার্থক্য গড়ে ওঠে মূলত ঘৃণাকে কেন্দ্র করে। খুব ধীরে হলেও, যেহেতু পালটাতে থাকা সমাজব্যবস্থায় প্রান্তিকদের স্বর খানিক হলেও শক্তিশালী হচ্ছে, সেহেতু ঘৃণার জন্ম হচ্ছে এই প্রেক্ষিতে।
…………………………………
সাবর্ণ হিন্দুত্ববাদী পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মমতাশঙ্কর ও নন্দিনী ভট্টাচার্যদের ওই সমস্ত পচাগলা কথাবার্তার। মমতাশঙ্কর নিজের সীমাবদ্ধ ভাবনার জগৎ নিয়ে থাকলে সমাজের কিন্তু তেমন ক্ষতি নেই। বাঙালি মধ্যবিত্তের পাড়ায় পাড়ায় এই সমস্ত চিন্তাভাবনার মমতাশঙ্কররা রয়েছেন। তাদের এই ধরনের রুচিকে পাড়ার অল্পবয়সী আত্মবিশ্বাসী স্বাধীনচেতা মেয়েটি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বাঁচে।
…………………………………
এই প্রান্তিকদের পরিসর এক ও অভিন্ন নয়। কেউ অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক, কেউ লিঙ্গ-রাজনীতিগত ভাবে প্রান্তিক, কেউ ধর্মগতভাবে প্রান্তিক, কেউ যৌন অভিরুচির প্রেক্ষিতে প্রান্তিক, কেউ ভারতীয় বর্ণব্যবস্থার প্রেক্ষিতে প্রান্তিক, কেউ জাতিগতভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিসরে প্রান্তিক। এই সমস্ত প্রান্তিকদের নিজেদের মধ্যে বিবিধ স্বার্থের সংঘাত রয়েছে, কিন্তু একটি ব্যাপারে এদের অভিন্ন যোগসূত্র রয়েছে। সেই যোগসূত্রটি হল– এরা কোনও না কোনও ভাবে ভারতে সাবর্ণ হিন্দুত্ববাদী পিতৃতন্ত্রের নিরঙ্কুশ আধিপত্য এবং আধিপত্যকামকে প্রতিরোধের আঁচ দিতে পেরেছে। এই আঁচের উত্তাপ ভালোভাবেই টের পায় আধিপত্যবাদী যে কেউ। তা কখনও বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে, কখনও বলিউড হতে পারে। এর মূলে– নিজের আধিপত্যকামী রুচিকে বরাবর ‘জনরুচি’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
এই ধরনের সাবর্ণ হিন্দুত্ববাদী পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মমতাশঙ্কর ও নন্দিনী ভট্টাচার্যদের ওই সমস্ত পচাগলা কথাবার্তার। মমতাশঙ্কর নিজের সীমাবদ্ধ ভাবনার জগৎ নিয়ে থাকলে সমাজের কিন্তু তেমন ক্ষতি নেই। বাঙালি মধ্যবিত্তের পাড়ায় পাড়ায় এই সমস্ত চিন্তাভাবনার মমতাশঙ্কররা রয়েছেন। তাদের এই ধরনের রুচিকে পাড়ার অল্পবয়সি আত্মবিশ্বাসী স্বাধীনচেতা মেয়েটি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বাঁচে। পাড়ার মমতাশঙ্করটির কুশিক্ষিত কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তার ক্রমাগত বিরোধিতা করতে গিয়ে সে তার স্বাধীন বাঁচার জন্য বরাদ্দ সময় ক্ষতিগ্রস্ত করে না।
কিন্তু পাড়ার মমতাশঙ্করটি যখন বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম গর্ব মমতাশঙ্করের কথা হয়ে ওঠে, তখন কিন্তু সেই স্বাধীনচেতা মেয়ে খানিক হলেও থমকায় এবং যৌক্তিক বিরোধিতার যুক্তিক্রম সাজাতে থাকে। একজন পিতৃতান্ত্রিক মানুষের পচাগলা চিন্তাভাবনা যে যুক্তিক্রমকে মেনে চলে না– এই সহজ সত্য তখন সেই স্বাধীনচেতা মেয়ে বিস্মৃত হয়। তার শক্তিক্ষয় হতে থাকে এবং খানিক হলেও তার স্বাধীনচেতা যাপনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে সক্ষম হয় সেই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি– যে মমতাশঙ্করের কথাবার্তাকে বারবার ব্যবহার করে চলে, নিজের পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যকে কোনও ভাবে টিকিয়ে রাখার মরিয়া প্রচেষ্টায়। স্বাধীনচেতা নারীর ভাবার সময় এসেছে। সে যখন এই আধিপত্যকামকে বারবার বৃত্তাকারে ফিরে আসতে দেখছে, সে কি ‘ডন কিহোতে’ হয়ে মমতাশঙ্কর নামক হাওয়াকলকে দৈত্য ভেবে লড়াই করবে, নাকি সত্যিকারের দৈত্যকে চিহ্নিত করে তার লড়াইয়ের পদ্ধতি পালটানোর কথা ভাববে?
প্রেক্ষিত ভেদে চিৎকার করে সরব উচ্চকিত প্রতিবাদের মতোই জরুরি আরেকটি পন্থা হল নীরবতার রাজনীতি। পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের নতুন ধরনের যে-সমস্ত পদ্ধতি, তাকে প্রতিরোধ করতে নারীকে অবশ্যই নৈঃশব্দ্যকেই ব্যবহার করতে হবে। মমতাশঙ্কর, নন্দিনী ভট্টাচার্যদের ওই সমস্ত কথাবার্তা এতটাই গুরুত্বহীন যে, তারা কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধের মুখে পড়ারও যোগ্য নয়। আর এদের ব্যবহার করে নিজেদের হারাতে থাকা পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য বজায় রাখতে মরিয়া ব্যবস্থারীতিকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার– তাদের নয়া-পিতৃতান্ত্রিক মুখোশ আমরা ধরে ফেলেছি।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..